যে বিরিয়ানি শুধু সকালেই পাওয়া যায়
পুরান ঢাকাবাসী মাত্রই বিরিয়ানির প্রতি তাদের দুর্বলতা স্বীকার করবেন—এ কথা সর্বজনবিদিত। কাচ্চি অথবা তেহারীর ঘ্রাণ যেন পুরান ঢাকার অলিগলিতে মিশে আছে। সাধারনত বিরিয়ানিকে ভারী খাবার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। আর ভারী খাবার দুপুর কিংবা রাতেই গ্রহণ করার চল আছে আমাদের দেশে। কিন্তু বিরিয়ানির মতো ভারী খাবার দিয়েই যদি দিন শুরু করা হয় তাহলে কেমন হবে? পুরান ঢাকার এমনই এক বিরিয়ানির খোঁজ পাই সোহেল ভাইয়ের কাছে। একদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে ঠিক করি এমন প্রভাতী বিরিয়ানি দিয়েই আজ নাস্তা সম্পন্ন করবো।
এই প্রভাতী বিরিয়ানির দোকানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো নাম নেই। তবে রয়েছে ব্যাপক সুনামের সাথে পরিচিতি। দোকানের নাম না থাকলেও দোকানটিকে সবাই 'শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানি' নামেই জানে। ঢাকার চকবাজার শাহী জামে মসজিদের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। মসজিদের বিপরীতে ৬ নং বণিক সমিতির গলি দিয়ে সোজা ঢুকে হাতের বামেই শাহ সাহেবের বিরিয়ানির দোকান। দোকানের কোনো নামফলক না থাকলেও চিনতে অসুবিধা হবে না। মার্কেটের যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেও জেনে নেয়া যাবে।
বিরিয়ানি রান্না এবং বিক্রি করার দিকে তাকালে একে 'প্রভাতী বিরিয়ানি' বলা যেতে পারে। শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানিও খুব ভোরে রান্না করা হয়। আর সকাল নয়টার মধ্যেই কারবার শেষ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এমন নামকরণ করটা মন্দ হয় না। চকবাজার শাহী মসজিদে যখন পৌঁছেছি তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। মার্কেটের পাইকারী দোকানগুলো তখন খুলতে শুরু করেছে। এক মুসল্লি ভাইকে জিজ্ঞাসা করতে জানালেন বিরিয়ানি বিক্রি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। তার কথা শুনে দেরি না করে শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানির দোকানের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানি খেতে কেমন?
এত সকালে বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাস নেই। গিয়েছিলাম কৌতূহলের বশে। বসার জায়গা পেয়েই এক প্লেট বিরিয়ানি নিলাম। ফুল প্লেট বিরিয়ানি ১৬০ টাকা। আর হাফ প্লেট ৮০। তবে, হাফ প্লেট নেয়ার চেয়ে ফুল প্লেট নেয়াটাই সমীচীন বলে মনে হলো। ফুল প্লেটেও বিরিয়ানির পরিমান খুব বেশি বলা যাবে না। আবার একজনের জন্য মন্দও না। চিনিগুড়া চাল দিয়ে এই বিরিয়ানি রান্না করা হয়। মুখে নিতেই খাবারে অদ্ভুত এক স্বাদ পেলাম। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, এই বিরিয়ানিতে দুধ ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য বিরিয়ানিতে হাত দিলে বেশ নরম অনুভূত হবে। আবার, সাথে দেয়া সালাদ আর সালাদের পানির কারনেও এমন হতে পারে। বিরিয়ানিতে তেলের পরিমান একেবারেই কম। দোকানের কর্মচারী নুরু মিয়ার সাথে কথা বলেও তাদের বিরিয়ানির রেসিপি জানতে পারলাম না। তবে শাহ সাহেবের বিরিয়ানি স্বাদে অপূর্ব! একথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
এটি বিরিয়ানি নাকি তেহারী ? এমন একটা বিতর্ক অনেকের কাছেই রয়েছে। আবার শুধু ছবি দেখে মনে হতে পারে এটি পোলাও! আমরা জানি তেহারীর তুলনায় বিরিয়ানিতে অপেক্ষাকৃত বড় মাংস থাকে। আর তেহারিতে সাধারনত টুকরো মাংস দেয়া হয়। কথা বলে জানতে পারি, এখানে খাসির বিরিয়ানিতে মাংস টুকরা করে দেয়া হয়। তবে, মোরগ বিরিয়ানি খেয়ে বোঝা গেলো এতে মশলার পরিমান খুবই সীমিত। আবার ঝালও কম। এদিক থেকে একে বিরিয়ানি বলাই শ্রেয়। আবার, মোরগ বিরিয়ানির সময় যেহেতু রান্না করা মাংস দিয়ে বিক্রি করা হয়, সেদিক থেকে একে পাক্কি বিরিয়ানিও বলা যেতে পারে।
এমন এক দ্বন্দ্বের অবসান করতে তেহারি-বিরিয়ানি সম্পর্কে নুরু মিয়াকে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, "যে যা ই বলুক, শুরু থেকেই আমরা একে বিরিয়ানি বলেই বিক্রি করছি। এটি বিরিয়ানিই। তবে, রান্নায় আমাদের নিজস্ব রীতি অনুসরণ করি বলেই এমন আলাদা স্বাদের বিরিয়ানি তৈরী করতে পারি। চকবাজারে অন্য কোথাও এই বিরিয়ানি আপনি পাবেন না''।
আমার পাশে বসে এক ভদ্রলোক খাচ্ছিলেন। খাওয়া শেষ হলে তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি সপ্তাহে কমপক্ষে চার দিন স্থানীয় বন্ধুদের সাথে এখানে নাস্তা করতে আসেন। কম তেলযুক্ত বলে এই বৃদ্ধ বয়সেও স্বাচ্ছন্দ্যে এক-দেড় প্লেট বিরিয়ানি খেতে পারেন তিনি।
এখানে খেতে আসা নাজির হাসানের কথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই। তিনি চকবাজারে পাইকারি চুরি বিক্রেতা। গত ৫ বছর ধরে তিনি এই শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানি দিয়ে নিয়মিত নাস্তা করছেন। নাজির বলেন, "এটি স্বাদে অন্য হোটেলের বিরিয়ানির চেয়ে ভালো। না খেয়ে কখনোই এর স্বাদ সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন না"। তিনি বললেন এই দোকানে ব্যবসায়ীরাই খেয়ে থাকেন।
দোকানের অবস্থা
দোকানের সামনে যেতেই চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। ছোট পরিসরের এই দোকানের চারপাশে উপচে পড়া ভীড়! আমি ভেবেছিলাম বেলা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে হয়তো লোক বাড়বে। কিন্তু দোকান খুলতেই নাকি এই ভীড় জমে গেছে। প্রতিদিন মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘন্টার জন্য দোকান খোলা থাকে। মাত্র একটি পাতিলে করেই বিরিয়ানি আনা হয়। বেলা নয়টার মধ্যেই বেচাকেনা শেষ!
দোকানের অবস্থান একেবারে সরু গলির ভিতরে। জায়গা না পেয়ে যে কোথাও যে বসবো তার ব্যবস্থা নেই। আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে যদি বিরিয়ানি শেষ হয়ে যায়! এজন্য আসন শূন্যতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কয়েকজন খেয়ে উঠতেই ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসে পড়লাম। দোকানের একমাত্র খাবার বিরিয়ানি। সাথে মোরগের লেগ পিস। দোকানের এক কোনায় নুরু মিয়া সিলভারের একটি পাতিলে বিরিয়ানি নিয়ে বসে আছেন। বর্তমানে দোকানের দেখাশোনার দ্বায়িত্ব তার হাতেই। 'শাহ সাহেব' এখন আর দোকানে বসেন না। তার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। থাকেন রহমতগঞ্জে। মাঝেমধ্যে সপ্তাহে একবার আসেন।
বলে রাখি এ দোকানে কোনো চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দোকানের মেঝেটাই বেশ উচু করে বানানো। মেঝেতে বসেই সবাই বিরিয়ানির স্বাদ নেন। দেখে গ্রামের কোনো অনুষ্ঠানে মেজবানি খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বসে খাওয়ার আসবাব বলতে এই মেঝে ছাড়া কিছুই নেই। তবে এ নিয়ে খেতে আসা ব্যক্তিদের মাঝে কোনো হতাশা কিংবা ক্ষোভ কোনোটিই নেই। দোকানের বয়স প্রায় অর্ধ-শতক। শুরু থেকেই এখন পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা টিকে আছে।
এই দোকানের ক্রেতা মূলত স্থানীয় অধিবাসী, বিশেষ করে চকবাজারের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। সকালে কেউ কেউ আমার মতো প্রাতঃভ্রমণে বের হন, ব্যবসায়ীরা দোকান খুলেন আর শাহ সাহেবের বিরিয়ানি দিয়ে নাস্তা সেরে নেন। আবার, লোকমুখে কিংবা ইন্টারনেটের বদৌলতে কেউ কেউ এখানকার কথা শুনে চলে আসেন। যদিও এরকম লোকের সংখ্যা বেশ কম। স্থানীয়রাই মূলত এখানে খেতে আসেন। সপ্তাহের তিন-চার দিন শাহ সাহেবের বিরিয়ানিই তাদের নাস্তা। এখানে বসে খেতে না চাইলে পার্সেল করে নিয়ে যাওয়া যাবে। খুব বেশি পার্সেল নিতে পারবেন বলে মনে হলো না। পাশের দোকানের এক ব্যবসায়ী জানালেন এতে করে নাকি দোকানের সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত ক্রেতারা যাতে অসন্তুষ্ট না হন সে কারণেই এমন ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানান তিনি। তবে, অগ্রিম অর্ডার করার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি দোকানে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ২০০ প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি করা হয় এখানে। সে হিসাবে মাসে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকার কারবার করেন শাহ্ সাহেব। সপ্তাহের সোমবার আর বৃহস্পতিবারে মোরগ বিরিয়ানি পাওয়া যায়। অন্যান্য দিন খাসির মাংসের বিরিয়ানি বিক্রি করা হয়। শুক্রবারে এবং অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে শাহ সাহেবের বিরিয়ানির দোকান বন্ধ থাকে।