চার হাজার গ্রাহক আর ২০ দেশের বাঙালি ও বিদেশিদের পছন্দ থ্রেডের জামদানি
২০১৮ সালের মাঝামাঝি মাত্র ১০ জন তাঁতীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে থ্রেড। জামদানির ঐতিহ্যবাহী বুননকৌশলের সঙ্গে নকশায় নতুনত্ব নিয়ে হাজির হন থ্রেডের সত্ত্বাধিকারী সাদিয়া আফরিনা। সীমিত পরিসরে শুরুতেই আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পান। বেড়ে যায় তার কাজের উৎসাহও।
পরের বছরই অনলাইনে আসে থ্রেড। ফেসবুকের এক ক্লোজড গ্রুপে থ্রেডের শাড়িগুলো তুলে ধরেন আফরিনা। দিন যত যায়, বাড়তে থাকে গ্রাহক সংখ্যা। তবে এবার তিনি ব্যবসায়িক কৌশলে কিছুটা নতুনত্ব আনার পরিকল্পনা করেন।
ইউনেস্কো স্বীকৃত বাংলাদেশি কালচারাল হেরিটেজ জামদানি। শৈল্পিক বুননের সঙ্গে জামদানিতে মিশে রয়েছে আভিজাত্য। বাংলাদেশের এই অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দেশের বাইরে বসবাসরত বাঙালিসহ নতুন প্রজন্মের কাছে কীভাবে জনপ্রিয় করে তোলা যায় তা নিয়ে আফরিনা ভাবতে শুরু করেন। তার নজর পড়ে ফ্যাশন সচেতন গ্রাহকদের দিকে। এই গ্রাহকরা সাধারণত দেশের বাইরের ডিজাইনারদের পোশাক নিয়ে আগ্রহী। তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই থ্রেডকে তিনি নতুন করে সাজিয়ে তুলেন।
যেভাবে যাত্রা শুরু
নিজ দেশের পণ্য ও ঐতিহ্যকে বজায় রাখার বিষয়টি আফরিনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রতি এই সূক্ষ্ম আবেগের জন্ম অবশ্য ছোট থেকেই। ব্যবসায় স্নাতক আফরিনা আন্তর্জাতিক একটি এনজিওতে কাজ করার সময় নিজের ভেতর এক ধরনের তাড়না বোধ করতেন। এই তাড়না দেশের জন্য কিছু করার, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। থ্রেড তাকে সেই সুযোগ এনে দেয়।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় এক প্রদর্শনীতে গিয়ে আফরিনা দেখেন, অধিকাংশ জামদানিই বাংলাদেশি তাঁতীদের হাতে বোনা। ভিনদেশেও ক্রেতারা খুব আগ্রহ নিয়ে চড়া দামে সেসব জামদানি কিনছিলেন। সেখান থেকে বেশকিছু ছবি তুলেন। এরপর তিনি আরও কিছু জায়গা থেকে জামদানির ডিজাইন ও মোটিফ সংগ্রহ করেন। সনাতন নকশাগুলো পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জামদানির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেন আফরিনা। থ্রেড শুরু করার আগে এভাবেই ধীরে ধীরে কাজের প্রস্তুতি নেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যারা জামদানির নকশা নিয়ে কাজ করছেন, তাদের কাজও আফরিনাকে অনুপ্রাণিত করে।
কিন্তু শুধু পরিকল্পনা করলেই চলে না। মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করাটাও সহজ নয়। আফরিনা যখন নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা করছেন তখন দেশের জামদানি তাঁতীরা চরম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে বেশ কয়েকজন তাঁতীর সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। বাড়িতে এসে তারা জামদানি দিয়ে যেতেন। জামদানি শিল্পী হয়েও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাদের জীবনযাপন ছিল করুণ। এই তাঁতীরাও একদিন আফরিনাকে জিজ্ঞেস করেন, তাদের জন্য কিছু করা সম্ভব কি না। আফরিনা জানতেন তার স্বপ্ন পূরণে ক্ষয়িষ্ণু এই কারিগরদের রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেখান থেকেই তার পরিকল্পনায় যুক্ত হয় আরও একটি লক্ষ্য- তাঁতীদের পুনর্বাসন।
১০ জন নিয়ে শুরু করে বর্তমানে থ্রেডের কারিগরের সংখ্যা ১২০ জনেরও বেশি। নারীরাও এখানে সমানতালে কাজ করে চলেছেন। অধিকাংশ তাঁতীই দক্ষ কারিগর। তবে থ্রেড নতুনদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। থ্রেডের মূল চালিকাশক্তি এই জামদানি কারিগররা বলেই মনে করেন আফরিনা।
হঠাৎ করোনার আঘাত
২০২০ সাল থেকে এক্সক্লুসিভ পণ্যে মনোযোগ দেয় থ্রেড। বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও অংশ নিতে শুরু করেন আফরিনা। কিন্তু কোভিড আঘাত হানার পর হুট করেই সব বদলে যেতে শুরু করে। সরবরাহ ঘাটতির কারণে সাময়িকভাবে বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়। তবে তাঁতী ও অন্যান্য কর্মীদের সাপ্তাহিক বেতন দেওয়া অব্যাহত রাখেন আফরিনা।
আঘাত সামলে উঠতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগে যায়। তবে কোভিডের আরেকটি ইতিবাচক দিক ছিল বলে আফরিনা মনে করেন। লকডাউনের ফলে বাইরের পণ্য দেশে আসতে পারত না। দেশের বাইরে ভ্রমণের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়ে। সেসময় দেশীয় পোশাক ও ডিজাইনাররা নতুন করে সামনে আসার সুযোগ পান।
কোভিডের সময় আশেপাশে অনেকেই আফরিনাকে সমাজসেবামূলক কাজের কথা বললেও তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুনরায় কারখানা চালু করেন। তাঁতীদের রেশন কিংবা ত্রাণ দেওয়ার পরিবর্তে তাদের নিয়মিত আয়ের সংস্থান নিশ্চিত করাটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।
জামদানির জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে বর্তমানে তাঁতীপাড়াতেও বেড়েছে ব্যস্ততা। তবে থ্রেড তাঁতীদের শুধু জামদানি কারিগর হিসেবেই দেখেনি, একইসঙ্গে শিল্পী হিসেবে আত্মবিশ্বাস গড়তে বরাবরই উৎসাহের জোগান দিয়ে আসছে।
থ্রেডের এক্সক্লুসিভ কালেকশন
আধুনিকতার ছোঁয়ার সঙ্গে পুরোনো মোটিফের সংমিশ্রণে জামদানিতে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে থ্রেড। খাদি, হাফসিল্ক এবং সুতির জামদানি নিয়েই তাদের কাজ বেশি।
বুননের মান এবং নকশার ঘনত্ব এই দুটো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একেকটি জামদানি বুনতে এক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানান আফরিনা।
এক্সক্লুসিভ শাড়িগুলোর মধ্যে আছে সাচ্চা জরি ও খাদি জামদানি। সাচ্চা জরির কাজ পুনরুদ্ধারেও কাজ করেছে থ্রেড ।
থ্রেডের শাড়িগুলো শুরু হয় ১০ হাজার টাকা থেকে। কাজের মান, ব্যবহৃত কাঁচামাল ও বুননের সময়ের ওপর মূল্য নির্ভর করে।
জামদানির অধিকাংশ নকশাই সুপ্রাচীন। তবে প্রথাগত নকশার বাইরেও মোটিফে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে থ্রেড। বিবি রাসেল, মুনিরা এমদাদের মতো সুপরিচিত ডিজাইনাররাও থ্রেডের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
অনেক সময় গ্রাহকরা নিজেরাও পছন্দমতো নকশায় শাড়ি গড়িয়ে নিতে চান। তবে সেক্ষেত্রে সময়ের প্রয়োজন পড়ে। থ্রেডে একেক কারিগর সাধারণত দক্ষতা অনুসারে একেক ধরনের নকশার কাজ করে থাকেন। এভাবেই বজায় নকশার বিশেষত্ব।
হাতে বোনা প্রতিটি জামদানি পণ্যই গুণগত মানসম্পন্ন। আফরিনা মনে করেন শোরুম নিয়ে আসার আগে কাজে অবকাঠামো ও কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করা জরুরি।
নিয়মিত গ্রাহকদের ওপর নির্ভর করেই বড় হচ্ছে থ্রেড
২০২০ সালের শেষদিকে থ্রেড সফলভাবে জামদানি প্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। বর্তমানে থ্রেডের গ্রাহক সংখ্যা কয়েক হাজার। তার নিয়মিত গ্রাহকরা অন্য যেকোনো পোশাকের চেয়ে জামদানিকেই প্রাধান্য দেন বলে জানান আফরিনা।
দেশি গ্রাহক ছাড়াও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ২০টি দেশে বসবাসরত বাঙালি ও বিদেশিরা থ্রেড থেকে জামদানি নিচ্ছেন।
গ্রাহকরাই বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থ্রেডের পরিচিতি ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। জামদানিতে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য অন্যদের কাছেও তুলে ধরছেন তারা। আর এভাবেই থ্রেড পাচ্ছে নিত্যনতুন গ্রাহক। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীরা থ্রেডকে আপন করে নিয়েছেন।
সব বয়সীদের কথা মাথায় রেখেই শাড়ি বানানো হয়। আফরিনা জানান অনেক মেয়েই থ্রেডের কাজে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে জীবনের প্রথম জামদানিটি কিনেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত জামদানি পরার দিকে ঝুঁকছেন। আর এখানেই থ্রেডের সাফল্য বলে তিনি মনে করেন।
থ্রেডের ফেসবুক গ্রুপের সদস্যসংখ্যা চার হাজার। এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ফেসবুক নির্ভর হলেও সামনে শোরুম চালু করার পরিকল্পনার কথাও জানান। থ্রেড বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজনও করে থাকে। গ্রাহকরা চাইলে এসব প্রদর্শনীতে এসে সরাসরি শাড়ি ও অন্যান্য জামদানি পণ্য দেখার সুযোগ পাবেন।
জামদানি পণ্যে বৈচিত্র্য
বাংলাদেশের বহু অবস্থাপন্ন গ্রাহকই এখন বিদেশি ডিজাইনার পোশাক ছেড়ে দেশীয় শাড়িকে বেছে নিচ্ছেন। বাঙালি মেয়েদের জামদানি প্রীতিও যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। তবে সে কারণে নতুন প্রতিন্দ্বন্দ্বীও পাচ্ছে থ্রেড। গত ২-৩ বছরে কয়েকশ অনলাইন জামদানি বিক্রেতা এসেছেন বলে জানান আফরিনা। কিন্তু এই বিক্রেতারা নকশা ও মান ধরে রাখতে না পারলে সময়ের সঙ্গে পুরো জামদানি শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।
ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চারজন সহযোগিতা করলেও গ্রাহকদের একা হাতেই সামলান আফরিনা। থ্রেড নিয়েই এখন কর্মব্যস্ত জীবন পার করছেন।
তবে বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করা চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে করেন আফরিনা। অন্যান্য উদ্যোক্তারা আইডিয়া ও পণ্যের অনুকরণ করে ব্যবসা শুরু করে বলে তার অভিযোগ। সেক্ষেত্রে নতুন আইডিয়া নিয়ে আসা উদ্যোক্তাদের অবমূল্যায়ন ঘটে বলে তিনি মনে করেন।
নিজেদের অনন্য রাখতে তাই জামদানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনেছে থ্রেড। এখানে জামদানি ব্রাইডাল সেটসহ জামদানি লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি, ওড়না, সেলওয়ার কামিজ, জামদানি জ্যাকেটের মতো ভিন্নধর্মী জামদানি পোশাকও মিলবে।
আফরিনা জানান, থ্রেডের এতদূর আসার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তার গ্রাহকরা। তাদের কারণেই থ্রেড আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছে।
গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে গুণগতমান বজায় রেখে বর্তমান গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আফরিনা। আর তাই এখন পর্যন্ত সবকিছু সীমিত পরিসরেই রাখছেন। তবে ২০২৩ সাল নাগাদ প্রথম শোরুম চালু করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
"আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে শোরুম চালু করা। একইসঙ্গে পোর্টফোলিও প্রসারেও কাজ করবে থ্রেড," বলেন তিনি। কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ পণ্যে আরও বৈচিত্র্য আনার ইঙ্গিতও দেন আফরিনা।
থ্রেডকে নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্রাহকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে আফরিনা জানান, "কাজের গুণগত মান বজায় রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। খুব বেশি কাজ হলে মান ধরে রাখাটাও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।"
তবে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে সব ধরনের মানুষের কাছে থ্রেডের জামদানি পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছার কথাও জানান আফরিনা। সেক্ষেত্রেও জামদানির সূক্ষ্মতা, নান্দনিকতা ও মান বজায় রাখাই হবে মূল শর্ত।