পুরোনো কাপড় আর গার্মেন্টসের ঝুটকে যেভাবে টেকসই নয়া-ফ্যাশনে রূপ দিচ্ছে ‘চল’
আপনি পোশাক বানাচ্ছেন, কিন্তু আপনার এই পোশাক বানাতে কোন পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না। কি অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন, যেখানে পরিবেশ দূষণের বড় একটা অংশ পোশাকখাত থেকে হয়- সেখানে একথা বলা তো অবাস্তব! কিন্তু এমন এক অভিনব চিন্তা থেকেই দুই বছর আগে 'চল'-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখনো তারা সেই পরিবেশবান্ধব নীতি কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে।
'চল'-এর পোশাকগুলো তৈরি হয় পুরোনো কাপড় ও ফেলে দেওয়া গার্মেন্টস এর বর্জ্য (ঝুট) থেকে। তাদের এই প্রকল্পে সহযোগী ডিজাইনার হিসেবে আছেন যুক্তরাজ্য নিবাসী শামা কুন, বর্তমানে রয়েছেন কানাডায়। তিনি নিজেকে একজন গতানুগতিক ফ্যাশন ডিজাইনার পরিচয় দেওয়ার থেকে 'নৈতিক ও টেকসই' ফ্যাশন ডিজাইনার বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি শিল্প- পোশাকখাত। প্রতিবছর এ খাত থেকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে আমরা লাভবান হচ্ছি, তেমনি তার মাশুল গুণতে হচ্ছে পরিবেশ দূষণ দিয়ে। কিন্তু পরিবেশকে কীভাবে দূষণমুক্ত রেখে পোশাক বানানো যায় তার ওপর কয়েক বছর গবেষণা চালিয়েছে 'চল'- এর একদল তরুণ উদ্যোক্তা। এরপর তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ডিজাইনার ও মডেলদের সাথে নিয়ে একত্রে কাজ শুরু করেন। মূলত সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে ফ্যাশন ব্র্যান্ড 'চল'। আর তাদের সব পোশাকই বিশেষ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ হাতে বানানো হয়।
'চল' নামকরণ যেভাবে:
'ট্রেন্ড' ইংরেজি এই শব্দটির সাথে কম বেশি আমরা সকলেই পরিচিত। যখন নতুন কিছু চলছে বা সময়ের সাথে যাচ্ছে তাকেই বলা হয় ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ডের বাংলা অর্থই হচ্ছে- চল। আবার যদি বলি, তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে কোন শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়-সেখানেও চল শব্দটিই চলে আসে। যেমন কাজী নজরুল তার কবিতায় বলেছিলেন, চল চল চল। চল মানে যেমন চলাকে বোঝায়, তেমনি বোঝায় নতুন কিছু করার উদ্যম। এমন ভাবনা থেকে উদ্যোক্তারা তাদের এই নতুন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নামকরণ করেন।
একে শুধু ফ্যাশন ব্র্যান্ড না বলে; বরং নৈতিক ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা একটি ফ্যাশন উদ্যোগ বলাটাই বেশি উপযোগী হবে। কারণ 'চল'-এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পোশাকের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও পরিবেশ সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
উদ্যোক্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন সবাই তাদের সাথে চলতে শুরু করবে এবং তাদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
#'চল' এর পথচলার গল্প:
বিশ্বের অনেক দেশেই এখন পরিবেশের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও কীভাবে ভিন্ন কিছু করা যায়- তা থেকে শুরু হয় ৩ তরুণ উদ্যোক্তার পথচলা। প্রথমে তারা 'পারা' নামের একটি টেকসই স্থাপত্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখানে তারা পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য নির্মাণ করতেন। যেমন কড়াইল বস্তিতে তারা বাঁশ দিয়ে শিশুদের জন্য একটি প্লেগ্রাইন্ড তৈরি করেছেন। পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে করতেই কীভাবে পোশাকশিল্প থেকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা যায় সেই চিন্তা শুরু করেন। যেই ভাবনা সেই কাজ- শুরু হলো এ বিষয়ে তাদের গবেষণা। গবেষণায় তারা দেখলেন, পুরোনো কাপড়কে রিসাইকেল করে তা পুনরায় ব্যবহার করলে পোশাক শিল্পের দূষণ কমানো সম্ভব। তাছাড়া গার্মেন্টেসের ফেলে দেওয়া বর্জ্য আমাদের মাটি, পানির বড় একটি অংশ দূষিত করছে।
এরপর তারা দেশ-বিদেশের কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনারকে সাথে নিয়ে শুরু করেন 'পারা'-র আরেকটি প্রকল্প 'চল' এর পথ চলা। 'চল' এর ৩ উদ্যোক্তা হলেন- রুহুল আবদিন, কাজী আরিফিন ও সারারা খান। তাদের সাথে বিদেশি সহযোগী হিসেবে আছেন প্রবাসী ফ্যাশন ডিজাইনার শামা কুন।
শামা কুন সবসময় তার কাজে নৈতিক ও টেকসই দিকটিকে প্রাধান্য দেন। তার কাজেও মেলে এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। তিনি নিজ অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে পুরোনো শাড়িকে নতুন ও সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দিচ্ছেন।
নৈতিক এবং টেকসই এ ফ্যাশন ডিজাইনার তার ডিজাইনে কাঁথার নকশাকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছে। কাঁথাকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের চিন্তাটি আসে তার শৈশব থেকে। শামা ছোটবেলায় দেখেছেন বড়দের নকশিকাঁথা ব্যবহার করতে। সেই থেকে কাঁথার সাথে তার গড়ে উঠেছে গভীর সখ্যতা।
তিনি কাজের মাধ্যমে নিজ দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কথা ভেবেছেন। তাছাড়া কাঁথা যেহেতু বহুকাল ধরে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে, তাই একে নতুন করে তিনি তার ডিজাইনে তুলে ধরেন।
'চল'-এর আরেকজন ফ্যাশন ডিজাইনার হচ্ছেন রোকেয়া উল্লাহ। তিনি রিক্সা পেইন্টকে নতুন আঙ্গিকে ফ্যাশনে তুলে ধরছেন। 'চল' এর তৈরি ব্লাউজে রংতুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন রিক্সা পেইন্ট।
নৈতিক ও টেকসই ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে দাবি করে কেন?
পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই ব্র্যান্ডটি সকল কাজ ও পোশাক তৈরি করে থাকে। কিন্তু এইজন্যই কি তাদের নৈতিক ও টেকসই ব্র্যান্ড বলা চলে? এই ব্যাপারে সারারা খান, ফ্যাশন ব্র্যান্ডটির সহ-পরিচালক নিজে জানান, "টিকে থাকার জন্য আমরা বাণিজ্যিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ফাস্ট ফ্যাশনের দিকে না এগিয়ে কীভাবে সেটিকে টেকসই করা যায়- সেদিকে গুরুত্ব দান"।
তিনি বলেন, "আমাদের কাজে সবসময় একটা স্বচ্ছতা রেখে চলি। একেই আমরা নৈতিক বলছি। আমাদের এখানকার কর্মীদের তাদের কাজের সম্মানী হিসেবে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেই। কাজের সময় তাদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়কে আমরা যথাসম্ভব গুরুত্বের সাথে দেখি। আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের ও পিছিয়ে থাকা নারীদের কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর করে তুলতে সাহায্য করছি। এক্ষেত্রে কর্মীদের কাজের স্বাধীনতা ও সুবিধাগুলো আমরা যথাসম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করি"।
কর্মীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ঢাকার কড়াইল বস্তির কিছু নারীদের নিয়ে আমরা 'চল' এর যাত্রা শুরু করি। এই নারীরা কাঁথা সেলাইয়ে কাজে বেশ পারদর্শী। এছাড়াও আমাদের কিছু কর্মী কুষ্টিয়া থেকে কাঁথার কাজ করে পাঠান, যেগুলোকে পরবর্তীতে আমাদের ডিজাইনার শামা কুন তার প্রতিভা দিয়ে ফ্যাশনেবল পোশাকে রূপ দেন"।
"আমরা পোশাক শুধু ফ্যাশনের জন্য তৈরি করি না। 'চল'-এর খোলা রাস্তায় করা ফ্যাশন শো ও ফটোশ্যুটগুলোর মাধ্যমে সবসময় আমরা একটি সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি। ২০২০ সালের নভেম্বরে আমরা বেগম বাজারে একটি মিউজিক ভিডিও ফ্যাশন শো করি; সেখানে আমাদের বার্তা ছিল সমাজের গৎবাধা বিশ্বাসকে ভাঙ্গা। আমরা ফটোশ্যুট ও ফ্যাশনের শো'তে- শ্রেণি, পেশা, শরীরের গড়ন, ত্বকের রং ইত্যাদির বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং লিঙ্গ নিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফ্যাশন শোতে অংশ নিতে মডেলদের পাশাপাশি ট্র্যান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।"
সারারা খান আরও বলেন, "তারা অনেকেই আমাদের এই ফ্যাশন প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছেন। ফটোশ্যুটের জন্য এমন স্থানই বেঁছে নিয়েছিলাম যেখানে আমাদের দেওয়া সামাজিক বার্তা আরও ভালোভাবে ফুটে উঠবে। আমরা ভেবে দেখলাম, নারীরা কোন জায়গাগুলোতে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়- সেখান থেকে আমরা বাস টার্মিনালে ও পুরান ঢাকার মতো ভিড়পূর্ণ রাস্তায় মডেলদের নিয়ে ফটোশ্যুট করি। নারী দিবসে আমাদের একটি বার্তা ছিল- 'এটা আমার পোশাকের সমস্যা না, তোমার দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা'। লিঙ্গভেদে আমরা পোশাকগুলো তৈরি করে থাকি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের পোশাক পরতে পারবে। এছাড়াও আমরা সময়ের সাথে যুগোপযুগী ডিজাইন ও আরামদায়ক বিষয়টি খেয়ালে রেখে পোশাক তৈরি করি" ।
যেভাবে তৈরি হয় পোশাক:
যেখানে পুরোনো শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায় সেখানেই ছুটে যান ব্যতিক্রমী ব্র্যান্ডটির উদ্যোক্তারা। পুরানো কাপড়কে তাদের কর্মীরা বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ধুয়ে শুরু করে রিসাইকেল প্রক্রিয়া। যেমন পুরোনো শাড়ি তারা পোশাকের ওপরের দিকে রেখে ভিতরের দিকে লুঙ্গি কেটে ব্যবহার করেন। পোশাকগুলোর ওপরে করা হয় কাঁথার নিপুণ নকশা। আর এসব কাজে কোনোরকম যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
এছাড়াও তারা কিছু গার্মেন্টস মালিকদের সাথে কথা বলে তাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে রিসাইকেল করে ডেনিম ব্লাউজ ও শীতের জনপ্রিয় পোশাক ডেনিম জ্যাকেট বানাচ্ছে। ঋতুকে মাথায় রেখে তৈরি হয় 'চল' এর পোশাক। শীত মৌসুমে তাদের সংগ্রহে ছিল লম্বা ট্রেঞ্চকোট, জাম্পস্যুট, বম্বার জ্যাকেট, কিমোনো, হুডি কামিজ ইত্যাদি। এখন গ্রীষ্ম মৌসুমে তারা নিয়ে এসেছে আরামদায়ক সুতি জামা, কামিজ ও ব্লাউজ।
উদ্যোক্তা সারারা খান বলেন, "আমরা আশাবাদী আমাদের এই পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে একদিন মূল ধারার পোশাক শিল্পের মালিকরাও এগিয়ে আসবেন। তারাও আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে রিসাইকেলের মাধ্যমে তাদের কারখানায় পোশাক বানাবেন। সামগ্রিকভাবে এ উদ্যোগ সকলে গ্রহণ করলে একসময় পরিবেশ দূষণ অনেক কমে আসবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে তারাও রিসাইকেল করা কাপড় পরতে শুরু করবে এবং তাদের সহযোগিতা আমাদের প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নেবে। জার্মানি ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের দেশে আইন করে প্রতিটি কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ২৫% টেকসই পণ্য রাখার নীতি চালু করবে। পরিবেশ রক্ষায় প্রতিটি দেশসহ আমাদের দেশেও এই আইন দ্রুত কার্যকর হবে। আমরা আশাবাদী এই কাজে ভবিষ্যতে সরকারিভাবে প্রণোদণা ও উৎসাহ পাব, যা আমাদের 'চল' কে অনেক দূরে পৌঁছে দিবে"।