পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থান নয়, বরং ধ্বংসের মাধ্যমেই দেশে নগরায়ন হচ্ছে: বাপা
দেশে নগরায়ন প্রক্রিয়া পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে নয়, বরং পরিবেশকে ধবংসের মাধ্যমেই সামনের দিকে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবাদীরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে নগরায়ন সংকটের সম্মুখীন। দেশব্যাপী ক্রমাগত দখল এবং দূষণে শহরগুলোর সবুজ ও জলজ অংশসমূহ বিলীন হয়ে পড়ছে। ফলে উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান, ও চিত্ত-বিনোদনের মুক্ত সুযোগসমূহ অপসৃত হচ্ছে।"
বুধবার (১২ জুন) বাপা আয়োজিত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় তিনি আরও বলেন, "এককালের ছিমছাম, উদ্যান ও পার্ক সমৃদ্ধ, খাল-ঝিল ও পুকুরে পরিপূর্ণ, সবুজ ও সজল এই শহরগুলো সময়ের সাথে সাথে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। পরিবেশের সাথে সহাবস্থান নয়, বরং পরিবেশকে ধবংসের মাধ্যমেই দেশে নগরায়ন প্রক্রিয়া ধাবিত হচ্ছে।"
সভাপতির বক্তব্যে বাপা'র সহ-সভাপতি মহিদুল হক খান বলেন, "দেশের পরিবেশকে সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতির কথা সরকার বড় গলায় বললেও বাস্তব চিত্র অন্য। প্রতিনিয়তই আমরা পরিবেশকে ধ্বংস হতে দেখছি। আমরা বর্তমান পরিবেশ মন্ত্রীর নিকট প্রত্যাশা করি, তিনি দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।"
বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক, ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, "নগর কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তার মূল্যায়ন ও জবাব চাই। এসডিজি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে, আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।"
তিনি বলেন, "আমাদেরকে আগে পার্ক ও মাঠের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। দুটো এক জিনিস না। কিছু স্বার্থান্বেষী মাঠ ও পার্কের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে চায় না।"
তিনি যথাযথ ড্যাপ বাস্তবায়ন এবং দেশের উপজেলার মাস্টার প্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়নের দাবি জানান।
বাপা'র যুগ্ম সম্পাদক ড. আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, "একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। পরিবেশ মন্ত্রীর ১০০ দিনের কর্ম পরিকল্পানার কথা বলা হলেও কার্যত কোনো কর্মসূচি দেখা যাচ্ছেনা।"
এসব ক্ষেত্রে পরিবেশগত সুশাসন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
"নির্মাণ কাজের সময় ব্যাপবভাবে বায়ুদূষণ সৃষ্টি হয়। ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দূষণরোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে," বলেন ড. আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, "দেশের নগরগুলোকে সুন্দর করতে হলে প্রথমে দেশের কর্তাব্যক্তিদের মনের পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতাই পারে দেশের পরিবেশ সুরক্ষা করতে।"
বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন "পরিবেশ অধিদপ্তর অকার্যকার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের ফলে ঢাকার দূষণ বেশি হচ্ছে এবং এই দূষণ কমানোর জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা প্রয়োজন।"
এছাড়া, ঢাকাসহ সকল জেলার খেলার মাঠ ও পার্কগুলোকে দখলমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে বাপার পক্ষ থেকে ৬টি প্রস্তাবনা ও দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে— নগর এলাকাসমূহের পাশাপাশি সকল সড়ক ও মহাসড়কে বৃক্ষশুমারী পরিচালনা এবং বৃক্ষ সংক্রান্ত ডেটাবেজ প্রণয়ন করে বৃক্ষ কর্তন নিয়ন্ত্রণ করা; বন ও বনভূমি সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনা ও আইনভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা; ভারসাম্যপূর্ণ এবং দেশজ বৃক্ষ রোপণ ও লালনের কর্মসূচি কার্যকর করার পাশাপাশি 'নগর বন' সৃষ্টির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা।
প্রস্তাবনার মধ্যে এছাড়াও রয়েছে— ব্যক্তি ও কর্পোরেট ভিত্তিক সবুজায়ন ও বনায়ন উদ্যোগকে প্রণোদিত ও কখনো কখনো বিশেষভাবে উৎসাহিত করা; অকৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সুনিশ্চিত করা; নগরব্যাপী বিদ্যমান পুকুর, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণপূর্বক নগরীর বাসযোগ্যতা উন্নয়নে সমন্বিতভাবে 'নীল অন্তঃসংযোগ' গড়ে তোলা।
এছাড়া, বাপার পক্ষ থেকে সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিতার নগরদর্শন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে আশু উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।