যেভাবে পোস্টার হলো বাংলা ছবির মেন্যু কার্ড
দেশভাগের নয় বছর পরের ঘটনা। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ'। সে ছবির পাবলিসিটির দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুভাষ দত্ত। পাবলিসিটি বলতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আর গানের বইয়ের কভার। পোস্টার হয়েছিল কি না তা নিয়ে এখনো তর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন বোদ্ধার দল। আমরা তাই ১৯৫৯ সালের 'জাগো হুয়া সাভেরা' (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি অবলম্বনে নির্মিত এজে কারদারের উর্দু চলচ্চিত্র) ছবির পোস্টারকেই শুরু ধরছি। এই পোস্টারটির ডিজাইনও করেছিলেন সুভাষ দত্ত।
হ্যা, 'সুতরাং'য়ের সুভাষ দত্তই তিনি। দিনাজপুরে লিলি টকিজ দিয়ে তার শুরু। সেখানে কোলকাতা, বোম্বের (এখনকার মুম্বাই) চলচ্চিত্রগুলোর পোস্টার বা শো-কার্ডের কাজ করতেন। তারপর '৫১ সালে চলে যান বোম্বেতে। পামার্ট নামের এক পাবলিসিটি ফার্মে কাজ নেন। সেখানে মারাঠি শিল্পীরা ওয়াটার কালার, স্প্রে, পেন্সিল-চারকোল দিয়ে পোস্টার, ব্যানার, শো-কার্ড বা বুকলেট বানাত। দেখতে দেখতে তিনি সেসব কাজ শিখে নেন। পরে '৫৩ সালে ঢাকায় এসে চাকরি নেন এভারগ্রিন পাবলিসিটিতে ১১০ টাকা বেতনে। আরো পরে তিনজন অবাঙালির সঙ্গে মিলে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কামার্ট নামের এক পাবলিসিটি হাউজ। রাজধানীর বুকে (১৯৬০), হারানো দিন (১৯৬১), বিনিময় (১৯৭০), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭), রূপালি সৈকতে (১৯৭৯) সহ আরো কিছু ছবির পোস্টার এঁকেছিলেন। এছাড়াও নিজের পরিচালিত সব ছবির পোস্টার তো করেছেনই।
আরো তিন জন
শুরুর দিকের আরো দু'জনের একজন হলেন আজিজুর রহমান এবং নিতুন কুণ্ডু । ঢাকার সার্ক ফোয়ারাসহ দেশের আরো কিছু আধুনিক ভাস্কর্যের নকশাকার তিনি। 'অটবি' নামের আসবাবপত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা। সুভাষ দত্ত তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। আর এভারগ্রিন পাবলিসিটিতে কাজও যুগিয়ে দিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ছবি আঁকায় তার মুন্সিয়ানা দেখে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে নেন। আজিজুর রহমানও পড়েছেন আর্ট কলেজে। তবে চলচ্চিত্র তার কাছে ছিল নেশার মতো। তিনি চলচ্চিত্রের পোস্টার দেখলে দাঁড়িয়ে পড়তেন আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। পরের দিকে তিনি হয়েছিলেন দেশের নামকরা পরিচালক ও প্রযোজক। সেকালের পাবলিসিটি হাউজগুলো বিড়ি, সিগারেট, সুগন্ধি তেল, জর্দার কৌটার লেবেল বা সাইনবোর্ডের কাজও করত। হাউজগুলোতে ভারত থেকে আসা অবাঙালি মুসলিমরাও যুক্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে লাদলা আর দুলারা নামের দুই ভাই ছিলেন নামকরা।
ষাটের দশকে ঢাকায় কমার্শিয়াল আর্টিস্টদের তিনটি দলের সন্ধান পাওয়া যায়। একদল চলচ্চিত্র পোস্টার ডিজাইন করত, দ্বিতীয় দলটি চলচ্চিত্রের ব্যানার পেইন্টিং আঁকত আর তিন নম্বর দলটি রিকশা বা ট্রাকে পেইন্টিং করত। ষাটের দশকের খুব নামকরা পোস্টার আঁকিয়েদের মধ্যে আছেন গিরিন দাস যার ওস্তাদ ছিলেন গুলফাম। সত্তর আর আশির দশকের চলচ্চিত্র পোস্টারেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন গিরিন দাস। জোয়ার এলো (১৯৬২), নয়নতারা (১৯৬৭), অবুঝ মন (১৯৭২), আলোর মিছিল (১৯৭৪), সুজন সখী (১৯৭৫), দস্যু বনহুর (১৯৭৮), আলতাবানু (১৯৮২), বেদের মেয়ে জোসনাসহ (১৯৮৯) অনেক নামীদামী ছবির পোস্টার তিনি করেছেন।
যেভাবে হতো পোস্টার
পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত দুই ধরনের পোস্টার ছিল- হাতে আঁকা ও রিটাচিং। পুরোপুরি হাতে এঁকে পোস্টার করতে সময় লাগত অনেক বেশি। আজিম, সুজাতা, রোজী অভিনীত জহির রায়হানের 'বেদের মেয়ে' ছবির হাতে আঁকা পোস্টারটি দারুণ আকর্ষণীয়। ওই তিন পাত্রপাত্রীই কেবল আছেন পোস্টারে। আজিম আর সুজাতার মুখাবয়ব আছে আর রোজীর ছবিটি পোস্টারের নীচে ডানদিকে মাথায় সাপের খাঁচা নিয়ে দাঁড়িয়ে। বেদের মেয়ে লেখাটি মনে হয় টিন কেটে ছাপ দেওয়া। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের তিনতলার দেয়ালে লাগানো আছে পোস্টারটি। উন্মুক্ত ওই গ্যালারিতে জীবন থেকে নেয়া, দেবদাস, বেদের মেয়ে জোসনারও পোস্টার দেখা যায়।
রিটাচিং বলে পরিচিত পোস্টারগুলো হতো স্টিল ফটোগ্রাফি আর আঁকাআঁকি মিলিয়ে। হার্ডবোর্ডে পোস্টারের লে আউট তৈরি করে প্রথমে পাত্রপাত্রীর ছবি লাগিয়ে তারপর দেখা হতো খালি জায়গা কোথায় কোথায় আর ব্যাকগ্রাউন্ড হবে কতটা জায়গা জুড়ে। বেশি আঁকা হতো পশ্চাৎপট ও খালি জায়গাগুলো। তবে যেহেতু স্টিল ফটোগুলোও এনলার্জ করা হতো পোস্টারের প্রয়োজনে তাই নায়ক-নায়িকার চোখে-মুখে-নাকে বা পোশাকেও ব্যাপকভাবে তুলি-কলম চালনা করতেন আঁকিয়েরা। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাধারণত জলরঙের ব্যবহার করা হতো। এরপর সাদা-কালো স্টিল ফটোগুলোকে ট্রান্সপারেন্ট (স্বচ্ছ) কালার দিয়ে রঙিন করা হতো। ওই সময় তাই পোস্টার নকশায় শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাজ করতে পারতেন।
মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন এবং তানিয়া সুলতানার লেখা বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পোস্টারের বিবর্তন বইতে চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান জানাচ্ছেন, দর্শকদের চলচ্চিত্রের গল্প বলার জন্যই তো পোস্টার। তাই গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যগুলো উঠে আসতো পোস্টারে। পোস্টারে ব্যবহার করার কথা ভেবেও একটি শট ফ্রিজ করে নিয়ে নিতেন পরিচালক। তখনকার ঢাকার বিখ্যাত পাবলিসিটি হাউজ হলো- এভারগ্রিন, জুপিটার, এলাইড, চিত্রকর।
পোস্টার প্রিন্ট
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পোস্টার প্রিন্ট ছিল দুরূহ কাজ। পোস্টারের ডিজাইন হয়ে যাওয়ার পর একটি বোর্ডে সেটি সেট করে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হতো। এরপর নেগেটিভকে পজেটিভ করা হতো। ক্যামেরা ফিল্মের নেগেটিভ হতো সাদা-কালো। রঙিন পোস্টারের বেলায় নেগেটিভের ওপর ফিল্টার ব্যবহার করা হতো। পোস্টারে রঙের বিভিন্নতা ফিল্টারের মাধ্যমে তৈরি করা হতো। যেমন চার রঙের পোস্টার হলে নেগেটিভটা প্রথমে লাল রঙের ফিল্টার দিয়ে কাজ করা হতো। এসময় অন্য রঙগুলো আসতো না। তারপর একে একে অন্য রঙের ফিল্টার দিয়ে কাজ করা হতো। তারওপর পোস্টার পেপারের মাপ ছিল ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি আর ছাপানো যেত ২২ ইঞ্চি বাই ৩৫ ইঞ্চিতে। অতো বড় কিছু ক্যামেরায় ধরার ফিল্মও ছিল না। তাই নেগেটিভকে পজিটিভ করার সময় ওপর ও নীচ দুই অংশে ভাগ করা হতো।
১৯৬৫ সালে প্রথম দেশে অফসেট প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে আসা হয়। আগে অফসেট প্রিন্ট করিয়ে আনা হতো কলকাতা থেকে। অফসেট প্রিন্টিংয়ে পোস্টার ঝকঝকে হতো। বিদেশ কুমার ধরের নকশায় অফসেটে প্রথম ছাপা হয় উর্দু ছবি 'পুনম কি রাত' (১৯৬৬) এর পোস্টার। ধর বলছিলেন, একজন শিল্পী যেভাবে পোস্টার নকশা করতেন, ইমদাদুল হক তা হুবহু প্রিন্ট করতে পারতেন। প্রিন্টিংয়ে তার ধারণা ভালো ছিল। তবে প্রেসটি বেশিদিন চলেনি কারণ এর খরচ ছিল বেশি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পোস্টারগুলোতে স্ট্যাটিক ইমেজ বেশি ব্যবহার করা হতো। বেশি চরিত্র থাকতো না পোস্টারে। 'চান্দা' (১৯৬২) ছবির পোস্টার নিয়ে আজিজুর রহমান যেমন বলছিলেন, ছবির প্রেমিক যুগলকে কেন্দ্র করে পোস্টারটি করা হয়েছিল আর নীচে আছে ভিলেনের ছবি। অথচ ছবিটি চান্দা নামের এক নারীর আখ্যান কিন্তু পোস্টারে সে অনুপস্থিত।
তখন শিল্পীদের স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছবি মুক্তি পেত কম। মোট ৪০০ বা ৫০০ পোস্টার তৈরি হতো। খরচ হতো মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা। উল্লেখ্য 'মুখ ও মুখোশ' থেকে ১৯৭১ সালে পর্যন্ত মোট মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ২০৮টি। পরবর্তীকালের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী যেমন মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানও চলচ্চিত্রের পোস্টার এঁকেছেন।
গিরিন দাসের শিষ্য
পোস্টার ছিল প্রচারণার বড় হাতিয়ার তবে একমাত্র নয়। লবি কার্ড বা প্রেস কার্ডও তৈরি করতেন প্রযোজকরা। আজিজুর রহমান ম্যাচ বাক্সের গায়েও সিনেমার প্রচারণা চালিয়েছেন। সিনেমার নাম এঁকে বাজারে পলিব্যাগও ছাড়া হতো। ষাট ও সত্তর দশকে মুক্তির সময় চলচ্চিত্রের গান, গল্প, পাত্রপাত্রী ও কলা-কুশলীদের নাম লিখে একটি বই সিনেমা হলের বাইরে পাওয়া যেত। দর্শকরা ছবিটি দেখার আগে বা পরে বইটি কিনতেন।
চলচ্চিত্র পোস্টার শিল্পের দিকপাল বলা হয় গিরিন দাসের শিষ্য বিদেশ কুমার ধরকে, বিকেডি নামে যিনি অধিক পরিচিত। ১৯৬৫ সাল থেকে এখনো কাজ করছেন বিকেডি। তার মামা ছিলেন পিতলরাম সুর। পিতলরাম ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রথমদিকের একজন দেয়ালচিত্র নির্মাতা। মামার কাছ থেকে বিকেডি তেলরঙের ব্যবহার শিখেছিলেন। জলরঙ শিখেছিলেন জ্যোতিম্ময় সুরের কাছ থেকে। আর গিরিন দাস তাকে শিখিয়েছেন সবকিছুর সমন্বয়। চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন ১৯৬১ সালে। পয়ষট্টি থেকে নিজেই ওস্তাদ হয়ে গিয়েছিলেন। একাত্তরে দেশ ছাড়তে চাননি, শেষে পরিবারের চাপে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এই শর্তে যে, দেশ স্বাধীন হলে আর একদিনও থাকবেন না পরভূমে। কোলকাতা গিয়েও আঁকাআঁকিই করেছেন। একটা পূজার মন্ডপের নকশাও করেছিলেন যেটি পুরো পশ্চিমবঙ্গে প্রথম হয়ে স্বর্ণকমল পেয়েছিল।
বিকেডি আলিবাবা (১৯৬৭), আলো তুমি আলেয়া (১৯৭৫), মনিহার (১৯৭৬), আনারকলি (১৯৮০), আলিফ লায়লা (১৯৮০), লাইলী মজনু (১৯৮৩), আওয়ারা (১৯৮৫), বাল্যশিক্ষা (১৯৮৬), আয়না বিবির পালা (১৯৯১), দাঙ্গাসহ (১৯৯২) অনেক চলচ্চিত্রের পোস্টার এঁকেছেন। তার মনিহার ছবির পোস্টার পরে নির্বাচনী পোস্টার হিসাবে অনেকবার নকল হয়েছে। এতে গলার হারের মূল লকেটে প্রধান পাত্রপাত্রী আর পরের ছোট ছোট লকেটে অন্যান্য চরিত্রগুলোর ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর 'আয়না বিবির পালা'র পোস্টারের জন্য তিনি প্রযোজক সমিতির পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ পোস্টারে দেখা যাচ্ছে পথশ্রান্ত ইলিয়াস কাঞ্চন দীঘিতে পানি পান করতে যেয়ে অঞ্জু ঘোষের চুল তুলে আনেন হাতে। পোস্টারটি তখন দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল।
বিকেডি সবসময় নতুন কিছু করতে চাইতেন। অন্যরা যে পথে হাঁটে তিনি সেদিকে যেতে চাইতেন না। তাই বিকেডিকে বলা হয় বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের প্রধান পোস্টার কুশীলব। তবে লুৎফর রহমান পরিচিতি পেয়েছেন অফবিট পোস্টার নির্মাতা হিসেবে। তিনি আমজাদ হোসেন এবং আলমগীর কবিরের অনেক চলচ্চিত্রের পোস্টার করেছেন। যেমন ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), ভাত দে (১৯৮৪) ইত্যাদি।
সত্তরের দশকে চলচ্চিত্র পোস্টারে স্ট্যাটিক ইমেজের বদলে গতিশীল ইমেজ প্রাধান্য পেয়েছে। ইমেজের ব্যবহারও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। এর আগে ছবি হতো মূলত সামাজিক-রোম্যান্টিক ঘরানার। স্বাধীনতার পরে 'রংবাজে'র হাত ধরে অ্যাকশন ঘরানার ছবি নির্মাণ শুরু হয়। তাছাড়া এসময় পোস্টারের আঙ্গিক ও নকশা পরিবর্তনে বিদেশি প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্রেরও প্রভাব আছে। তখন অনেক হলেই বিদেশি প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র মুক্তি পেত। ওইসব ছবির পোস্টারে গল্প বলার চেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আকর্ষণীয় দেহাবয়ব বড় করে দেখানো হতো। তা দেখে চলচ্চিত্রের প্রযোজক পরিবেশকগণ তেমন তেমন পোস্টার একে দিতে বলতেন। ওই ধারায় ১৯৭৬ সালে আজাদ রহমান 'গোপন কথা' (পোস্টারে লেখা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) নামের একটি ছবিই বানিয়ে ফেলেছিলেন। পোস্টারে আরো লেখা ছিল বাংলা ভাষায় উপমহাদেশের প্রথম যৌন শিক্ষামূলক ছবি। যাহোক, ঐ সত্তরের দশকেই ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে থাকে যেমন দাতা হাতেম তাই, বাদশা, বাহাদুর ইত্যাদি। এসব চলচ্চিত্রের পোস্টারে সাপ, জ্বিন, পরি, দেও-দানো ইত্যাদির সঙ্গে সশস্ত্র অশ্বারোহী, ধাবমান ঘোড়া, সমরাস্ত্র ইত্যাদি অনেক কিছুর উপস্থিতি দেখা যায়। তিয়াত্তরে ঢাকায় আবার অফসেট প্রিন্টিংয়ে (ফাইন আর্ট প্রেস, উদয়ন প্রেস ) পোস্টার ছাপা হতে শুরু করে। তাদের ক্যামেরা, পজিটিভ, প্লেট ও প্রিন্টিং প্রতিটির আলাদা আলাদা সেকশন ছিল। তাই প্রযোজক পরিবেশকদের নানান জায়গায় দৌড়াতে হতো না। সত্তর ও আশির দশকের আরো যারা চলচ্চিত্র পোস্টার তৈরিতে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ শোয়েব, মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু, জ্বিন বাবুল অন্যতম।
আশির দশক
কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছাড়াও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট আরো কিছু ব্যক্তির পোস্টারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন যেমন নাজির হোসেন। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রের স্টিল ফটোগ্রাফার। বিকেডি জানাচ্ছেন, পোস্টার ডিজাইনে নাজির হোসেনের ধারণা অনেক পরিস্কার ছিল। তিনি মেঘের অনেক রঙ, কোহিনুর, কেয়ামত থেকে কেয়ামত ইত্যাদি ছবির পোস্টার করেছিলেন। এছাড়া এফডিসির সেট ডিরেক্টর সবুজও বেশ কিছু ছবির পোস্টার করেছেন যেমন আপন পর, আবার তোরা মানুষ হ ইত্যাদি। আশির দশকে রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ফ্যান্টাসি ছবির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই আলিবাবা, আলিফ লায়লা, বাগদাদের চোর, আবে হায়াত, নসীব, ইনসাফ ইত্যাদি ছবির পোস্টারে আরব দেশীয় পোশাক পরিহিত ও নৃত্যরত লাস্যময়ী নারীদেহ, তরবারি, ঘোড়সওয়ার, বন্দুক যুদ্ধ, আগুন, দরবেশ, সাপ, দরগা, বানর নাচ শোভা পেয়েছে। পাল্লা দিয়ে ফোক ফ্যান্টাসিও তৈরি হয়েছে ওই সময়ে যেমন চন্ডিদাস ও রজকিনী (১৯৮৭), বেহুলা লখিন্দর (১৯৮৮) ইত্যাদি।
এছাড়া চাষী নজরুল ইসলাম এবং আমজাদ হোসেন সাহিত্য ও গ্রামনির্ভর চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। যেমন- দেবদাস (১৯৮২), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬) ইত্যাদি। ফোক ফ্যান্টাসিতে সাপের উপস্থিতি বেশ ছিল। ছিল মানুষরূপী সাপ, বীণ, বীণ বাজিয়ে নারী, সাপের খেলা ইত্যাদি। সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রে অবশ্য প্রধান চরিত্রগুলোর ছবিই বেশি উপস্থাপিত হতো। এই দশকের সামাজিক ছবিগুলোর পোস্টার খুব আকর্ষণীয় হয়েছে। যেমন ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), বিনি সুতোর মালা (১৯৮১), জন্ম থেকে জ্বলছি (১৯৮১), কসাই (১৯৮০) ইত্যাদি। এসব পোস্টারে পারিবারিক আবহ ফুটিয়ে তুলতে ফুলের বাগান, গরুর গাড়ি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এসব পোস্টারে লাল ও কালোর আধিক্য ছিল বেশি, তাতে বেদনার আবহ তৈরি হয়েছে।
এই দশকের শেষে রাজনৈতিক কারণেই সম্ভবত আবার সামাজিক অস্থিরতা ফিরে আসে। চলচ্চিত্র পোস্টারেও তার প্রকাশ দেখা যায় যেমন রক্তাক্ত মুখচ্ছবি, মোটর সাইকেল, সন্ত্রাস, ত্রিশূল ইত্যাদি।
পোস্টারে পাত্রপাত্রীর নাম
'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পোস্টারের বিবর্তন' বইয়ে আজিজুর রহমান জানাচ্ছেন, সাধারণত নারীদের প্রতি সম্মান রেখে আগের শিল্পীরা তাদের নাম আগে দিতেন এবং শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন কোন শিল্পীকে কোথায় উপস্থিত করবেন বা কতটা গুরুত্ব দিবেন।
চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বলেছেন, পোস্টার হচ্ছে একটি খাবারের মেন্যু কার্ডের মতো। এখানে সব শিল্পীর নাম ও ছবি দেওয়া ভালো। তাহলে একেক দর্শক একেক শিল্পীর ছবি দেখে চলচ্চিত্রটি দেখতে যাবে। কার নাম আগে যাবে এই নিয়ে অনেক নায়ক, নায়িকা ইগো দেখাত। একটা ছবিতে যদি দুইজন সুপারস্টার থাকত তবে কার নাম আগে দেয়া হবে তা নিয়ে সুপারস্টার, পরিচালক, প্রযোজকের মধ্যে সংঘাত বেধে যেত।
গীতিকবি, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিচারপতি (১৯৮৬) ছবির ঘটনা যেমন বলা যায়। এই ছবির দুজন সুপারস্টার আলমগীর ও সোহেল রানা। পরিচালক পোস্টার ডিজাইনারকে আলমগীরের নাম আগে দিতে বলেন। পরে সোহেল রানা ওই ডিজাইনারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই সিদ্ধান্ত কে দিয়েছে?
দিন বদলায় খুব
কালার ফটোগ্রাফি আসার পর চলচ্চিত্র পোস্টারের নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। আশির দশকের গোড়ার দিকেও কিন্তু পোস্টার সেন্সর হতো না কিন্তু শেষ দিকে পোস্টারও সেন্সর করাতে হতো। কারণ তখন নতুন নতুন কোম্পানি প্রতিযোগিতায় নামে, তারা দর্শক টানতে পোস্টারে খোলামেলা ছবি দিতে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তখন পুরোনো পোস্টার শিল্পীরাও আবেদনময়ী পোস্টার বানাতে থাকে। নব্বই দশকের পোস্টারেও তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ওই দশকের প্রথম দিকে টিনএজ প্রেমের ছবি হয় অনেক যেমন চাঁদনি, চোখে চোখে, জ্যোতি, অন্তরে অন্তরে, হৃদয়ের আয়না ইত্যাদি। এগুলোর অনেকগুলোই ছিল ভারতীয় ছবির রিমেক। প্রেম আর প্রেম ঘিরে দ্বন্দ্বই ছিল পোস্টারের মুখ্য বিষয়। প্রেম ভালোবাসার প্রতীক হিসাবে হৃদয় বা লাল গোলাপের ছবি দেওয়া হতো বড় করে। এছাড়া থাকত বিয়ের সাজে বর কনে, সরিষা ক্ষেত, শাপলা বিল ইত্যাদি।
সহিংসতা নির্ভর ছবিও তৈরি হয়েছে এ দশকে। কাজী হায়াৎ গডফাদার, অসৎ পুলিশ বা প্রতিবাদী নায়কনির্ভর কয়েকটি ছবি তৈরি করেছেন এ সময়। ছবিগুলো ছিল মূলত মান্নানির্ভর। যেমন দাঙ্গা, ত্রাস, শান্ত কেন মাস্তান, ধর, আম্মাজান ইত্যাদি। এসব ছবির পোস্টারে রক্তাক্ত ছুরি, অস্ত্র হাতে ধাবমান যুবক, চিৎকার ইত্যাদি লক্ষ্যণীয়। সামাজিক অ্যাকশন এবং মারশাল আর্ট নির্ভর ছবিও হয়েছে এ দশকে যেমন টপ রংবাজ, অপহরণ, কমান্ডার, ভণ্ড, ম্যাডাম ফুলি ইত্যাদি। ওইসব ছবির পোস্টারে মার্শাল আর্ট ভিত্তিক মারামারির ভঙ্গিমা প্রাধান্য পেয়েছে।
সরেজমিন পোস্টার দর্শন
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ গ্রন্থাগারে পোস্টার দেখার সুযোগ আছে। তার মধ্যে কয়েকটি ছবির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:
অমর প্রেম: ১৯৭৭ সালের ছবি। পরিচালক আজিজুর রহমান। রাজ্জাক-শাবানা প্রধান পাত্রপাত্রী। পোস্টারটির বেশিরভাগ হাতে আঁকা। ছবির টাইটেল লাইন সবার নীচে। ওপরে পাত্রপাত্রীর যুগল ছবি আর পশ্চাৎপটে বনের গাছ ফুড়ে চাঁদের হাতছানি।
কুয়াশা: ছবির নামলিপির ওপরেই কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম। ১৯৭৭ সালে নির্মিত ছবিটির পরিচালক আজিজুর রহমান। আনোয়ার হোসেন এ ছবির নায়ক। নায়িকা হলেন অলিভিয়া। কালো কোট পরা নায়ক পোস্টারের প্রধান বিষয়। তাছাড়া আছে সুড়িখানায় নৃত্যদৃশ্য। আছে টেলিফোন, ওয়াকিটকি, মদপাত্র। সবমিলিয়ে ২০টি চরিত্র জায়গা নিয়েছে পোস্টারে।
নদের চাঁদ: শেখ নজরুল ইসলাম ছবিটির পরিচালক। ১৯৭৮ সালে নির্মিত। নামলিপি গীতল, ছন্দময়। ফারুক আর সুচরিতা প্রধান পাত্রপাত্রী। গ্রামবাংলার পটভূমিতে পোস্টারে আছে কুমির, মাছ ধরার জাল ইত্যাদি।
শীষনাগ: এফ কবির চৌধুরীর পরিচালনায় ছবিটি ১৯৭৯ সালে তৈরি। অলিভিয়া আর ওয়াসিম অভিনীত এ ছবি। বড় করে সাপ আছে পোস্টারে। আছে তলোয়ারবাজি, রাজপ্রাসাদ, ঘোড়া, মৎস্য দৈত্য, ময়ূর, পরী ইত্যাদি।
সুলতানা ডাকু: এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত ১৯৮১ সালের ছবি। রোজিনা আর জাভেদ প্রধান পাত্রপাত্রী। নারীপ্রধান ছবি। ব্যাটম্যানের মতো পোশাক পরিহিতা নারী চরিত্র ছবির পোস্টারের নীচ অবধি। তার কোমরে ছুরি, হাতে তলোয়ার। দুই পায়ের মাঝে দেখা যায়- ঘোড়ায় চড়ে ধাবমান দস্যুদল।
লাভ ইন সিঙ্গাপুর: ববিতা আর মাহমুদ কলি অভিনীত ছবিটি ১৯৮২ সালে নির্মাণ করেন আজিজুর রহমান বুলি। ছবির পোস্টারে প্যান্ট আর টপস পরা ববিতাকে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে একাই দেখা যায়। হাতে তার ভ্যানিটি ব্যাগ।
দোস্ত দুশমন: দেওয়ান নজরুলের ছবি। ১৯৭৭ সালে নির্মিত ছবিটিতে অভিনয় করেছেন শাবানা, ওয়াসিম, সুচরিতা, জসিম প্রমুখ। পোস্টারে ছবিটির নামলিপিতে আগুনের আভা আছে। পোস্টার দেখলেই মনে হয় রাগী একটা ছবি, বিস্ফোরণের আবহ পুরো ছবি জুড়ে।
রানী চৌধুরানী: নূর মোহাম্মদ মনি ১৯৯০ সালে অঞ্জু ঘোষ আর মাহমুদ কলিকে নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেন। পোস্টারে অঞ্জুকে দেখা যায় দুই হাতে দুই পিস্তল নিয়ে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পোস্টারে লাল, নীল, কালো, হলুদ রঙের প্রাধান্য বেশি।