রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভাবে প্রিন্টিং ব্যবসায় ধস, আর্থিক ক্ষতির মুখে ছোট প্রিন্টিং প্রেস
যেখানে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে অবস্থিত প্রিন্টিং দোকানগুলোর আশপাশে প্রায়ই মেশিনের গুঞ্জন আর তাজা কালির গন্ধ পাওয়া যেত, সেখানে এখন এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে।
শ্যামলীর সাইন এক্সপ্রেসের মালিক সোহরাব হোসেনের জন্য অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর ছিল বছরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়। তবে এই বছর তার প্রিন্টারগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে রয়েছে।
নিজের ছোট কিন্তু পরিপাটি অফিসে বসে, চারপাশে পড়ে থাকা অব্যবহৃত ভিনাইল শিটের রোল এবং অলস প্রিন্টারগুলোর দিকে তাকিয়ে সোহরাব বলেন, "আমরা প্রতি মাসে এই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ থেকে দশটি ইভেন্টের পোস্টার, ব্যানার এবং লিফলেট প্রিন্ট করতাম। কিন্তু এ বছর আমরা একটাও অর্ডার পাইনি।"
সোহরাবের পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনেক ছোট এবং মাঝারি আকারের প্রিন্টিং ব্যবসার জন্য একটি সাধারণ চিত্র। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যে দেশে প্রিন্টিং শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য ব্যবসা এনে দেয়, সেখানে বর্তমান পরিস্থিতি একটি বড় ধাক্কা। রাজনৈতিক র্যালি, প্রতিবাদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের কল্যাণে প্রায়ই সাইন এক্সপ্রেসের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার অর্ডার পেত।
তবে এ বছরের পরিস্থিতি ভিন্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে অনেক অনুষ্ঠান হয় বাতিল হয়ে গেছে, অথবা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো একসময় ছোট প্রিন্টিং প্রেসগুলোর রক্ষাকবচ ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্রেসগুলো প্রায় নীরব। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটিকে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ মনে হচ্ছে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যবসার জন্য জরুরি
প্রিন্টিং প্রেস শুধু বই এবং বিজনেস কার্ডের জন্য নয়; এগুলো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নির্বাচনের বছর আসলে বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উত্তেজনা বাড়লে প্রিন্টিং প্রেসগুলো ২৪ ঘণ্টা কাজ করে, প্রচারণার পোস্টার, ইভেন্ট ব্যানার এবং অন্যান্য প্রচারমূলক সামগ্রী তৈরি করে।
সোহরাব ব্যাখ্যা করে বলেন, "নির্বাচনের আগের মাসগুলো সাধারণত একটি সোনালি সুযোগের মতো। এমনকি ছোট ইভেন্ট যেমন র্যালি বা স্থানীয় কমিউনিটি মিটিং-এ প্রিন্ট করা পেশাদারি পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।"
কিন্তু মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এই ব্যবসায় একটি প্রভাব ফেলেছে। অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় সোহরাবের মতো প্রিন্টিং প্রেসের মালিকরা তাদের আর্থিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন।
তবে, যেসব প্রেস বই প্রিন্টিংয়ে মনোযোগী, সেগুলো এখন ব্যস্ত। কারণ সামনেই আয়োজিত হবে বই মেল। বাংলা বাজার এবং ফকিরাপুলে প্রেসগুলো বই ছাপানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
বাংলাবাজারের পটুয়াতুলি লেনের একটি প্রেসের ম্যানেজার জহির ইফতেখার বলেন, "আমাদের হাজার হাজার কপি ছাপানোর কাজ মেলার আগে শেষ করতে হবে। আর আমাদের কাছে মাত্র দুই মাস সময় আছে।
তিনি বলেন, "যদিও এই বছর সম্ভবত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্ডার আগের তুলনায় কম। আর কাগজ থেকে শুরুর করে কালি পর্যন্ত দাম বেড়েছে। তাই বইয়ের দামও হয়ত বাড়বে।"
রাজধানীর নীলখেত এলাকার রায়হান প্রিন্টার্সের মালিক মো. রায়হান ফারুকও একই ধরনের গল্প শোনালেন।
রায়হান বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বছর ধরে একটি রাজনৈতিক হটস্পট। ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক পেপার এবং বই ছাপানোর পাশাপাশি আমরা অনেক রাজনৈতিক দলের লিফলেট, পোস্টার এবং ব্যানারও প্রিন্ট করতাম। ছাত্রলীগ নেতারা নির্বাচনের সময় বা অন্যান্য ইভেন্টের সময় তাদের পোস্টার প্রিন্ট করাতে চাইতেন। তাতে আমাদের ভালো ব্যবসা হত।"
তবে তিনি আশাবাদী, অর্ডার আসতে শুরু করবে। তিনি বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হবে। যদিও এখন আমরা এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, একবার নির্বাচন ঘোষণা হলে ছাত্র রাজনীতির দলগুলো আমাদের কাছে আসবেই।"
অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে অনিশ্চয়তা
ব্যবসার স্থবিরতা সোহরাবকে তার কর্মীদের বেতন দেওয়ার এবং তার ব্যবসাকে চাঙ্গা রাখার ক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত করে তুলেছে। সোহরাব বলেন, "আমার দুজন কর্মী আছে, যারা তাদের জীবিকার জন্য আমার ওপর নির্ভরশীল। নিয়মিত অর্ডার না থাকায় তাদের সময়মতো বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।" তার কণ্ঠে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।
এই এলাকার অন্যান্য প্রিন্টিং দোকানগুলোর মধ্যে একই ধরনের উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই তাদের পণ্য পরিষেবা সম্প্রসারণ করেছে– বিয়ের কার্ড, রেস্টুরেন্ট মেনু অথবা ছোট আকারের কর্পোরেট সামগ্রী প্রিন্ট করতে শুরু করেছে। তবে, রাজনৈতিক প্রিন্টিংয়ের মতো এগুলো তেমন আয় বা মুনাফা দেয় না।
সোহরাব বলেন, "যদি বই এবং অন্যান্য অ্যাকাডেমিক পণ্য প্রিন্ট করতে পারতাম, তবে হয়ত এতটা চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু বই প্রিন্টিং ব্যবসা মূলত বাংলাবাজারে চলে এবং সে ব্যবসায় ঢোকা অনেক বেশি ব্যয়বহুল; অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন।"
এই ধীরগতির প্রভাব শুধু প্রিন্টিং প্রেসগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো সরবরাহ চেইনকেই প্রভাবিত করছে। কাগজ, কালি এবং অন্যান্য উপকরণের সরবরাহকারীরা এখন অর্ডারের পরিমাণ কমে যাওয়ার কথা বলছেন। ব্যানার টানানো এবং পরিবহণ বিশেষজ্ঞ কর্মীরা এখন কম সুযোগ পাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এই প্রবণতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এটি শহরাঞ্চলে, বিশেষত ঢাকা এবং চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল ছোট ব্যবসাগুলোকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সোহরাব সতর্কভাবে আশাবাদী। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, "বাংলাদেশে রাজনীতি অনিশ্চিত। শুধু একটি বড় ঘটনা ঘটলেই সব কিছু এক রাতে বদলে যেতে পারে।"