‘সিক্রেট মসলায়’ সেলিম কাবাব ঘরের জাদু
ভোজন রসিক বাঙালি মাত্রই লোভনীয় কাবাবের কথা জানেন। যদিও এর উৎপত্তি নয় বাঙালির রসনায়, বরং সমগ্র মধ্য এশিয়ার জনপ্রিয় খাবার এটি। মধ্যযুগে পৃথিবীব্যাপী তুর্কি শাসন বিস্তারের সাথে সাথে এই খাবারটিরও বিস্তার ঘটেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে কাবাব খাওয়ার প্রচলন শুরু হয় মোগলদের মাধ্যমে। কালক্রমে তা বাংলায় এসে পৌঁছায়।
কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশে যে কয়টি কাবাবের দোকান স্বগৌরবে ব্যবসা করে চলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের সেলিম কাবাব ঘর। বন্ধু মহলসহ অনেকের কাছে এই কাবাবের অনেক নাম-ডাক শুনেছি, কিন্ত কখনো যাওয়া হয়নি। সেদিন এককাজে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার পর এই কাবাবের কথা মনে পড়ে। আগেভাগেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম আজকে এই স্বাদ একটু পরখ করে দেখা যাক।
সলিমুল্লাহ রোডের একেবারে উত্তরের মাথায় এটি অবস্থিত। দোকানের কাছাকাছি যেতেই দোকানের সামনে উপচে পড়া ভীড় চোখে পড়লো। টিনের চালার মোটামুটি মাঝারি একটা দোকান। ভেতরে রাস্তার পাশের অংশে এক লোক কাবাব পোড়ানোয় দ্রুত হাত চালাচ্ছেন এবং অন্য অংশে কিছু কর্মচারী লুচি, পুড়ি, চিকেন চাপ বানাচ্ছেন। অপর পাশে বেঞ্চসহ চারটি টেবিলে বিছানো। ভীড় ঠেলে দোকানের ভেতরে ঢুকে কাউন্টারে গিয়ে ম্যানেজারকে খাবারের ব্যাপারে হালকা পাতলা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি জানালেন এখানে সবচেয়ে বেশি চলে তাদের বিফ শিক কাবাব। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটি সিট খালি হওয়ায় বসার সুযোগ পেলাম। এরপর তাদের বিখ্যাত বিফ কাবাব অর্ডার দিলাম।
খেতে যেমন ছিলো
এখানে প্রতি প্লেট বিফ কাবাব ১২০ টাকা করে। দাম অনুযায়ী প্লেটে কাবাবের পরিমাণ ভালোই ছিলো। সাথে মন মতো লুচি নিতে পারবেন। তবে তার জন্য আলাদা দাম দিতে হবে, প্রতিটি ৫ টাকা করে। পাশাপাশি বোরহানির পানির সাথে মেশানো সালাদও দেওয়া হলো। একসাথে সবগুলো সামনে আনা হলো। কয়লার আগুনে পোড়ানো কাবাবে মসলার পরিমাণ বেশি না থাকলেও সেখান থেকে আলাদা ঝাঝেঁর একটা গন্ধ আসছিলো। কৌতুহলবশত প্রথমেই তাদের কাবাবের স্বাদ নেওয়ার জন্য কাবাবের এক টুকরো মুখে গুঁজে দিলাম। খুবই নরম ছিলো, দাঁতে চাপ দেওয়ার সাথে সাথে নাক মুখে মসলার হালকা ঝাঁঝটা নাড়া দিচ্ছিলো। অন্যরকম এক স্বাদ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাবাবের চেয়ে একটু আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো। লুচি ও সালাদের সাথেও কাবাবটি খেতে মন্দ লাগছিলো না। সেটাও একটি আলাদা স্বাদ তৈরি করছিলো।
খেতে খেতে হঠাৎ কানে ভেসে আসা দোকানদার ও এর কর্মচারীদের হিন্দি/উর্দুতে কথা বলা আমাকে বিশেষ কৌতুহলী করে তুললো। জানতে পারলাম এটার প্রতিষ্ঠাতা একজন বিহারী মুসলিম।
সেলিম কাবাবের ইতিহাস
সেলিম কাবাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মোহাম্মদ সেলিম খান। তার জন্ম ভারতের বিহারে। ভারত ভাগ ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সেলিম কাবাব প্রতিষ্ঠার সংস্পর্শ রয়েছে। ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর অনেক বিহারী মুসলিম পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সেলিম খান। বাস করতে থাকেন মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে জীবন বাঁচাতে সেলিম খান আবার ভারতের বিহারে চলে যান। তবে বাংলাদেশের প্রতি টানের কারণে তিনি যুদ্ধের পর আবার এ দেশে ফিরতে চান। কিন্তু সে সময় তার আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিলো না, এদেশে এসেই বা তিনি কী কাজ করে জীবন ধারণ করবেন তাও ভেবে পাচ্ছিলেন না। তখন বিহারের এক হেকিম (কবিরাজ) তাকে এই কাবাবের রেসিপি শিখিয়ে দেন । আলাপকালে সেলিম কাবাবের এমন যাত্রার কথা জানাচ্ছিলেন তার ছেলে মোহাম্মদ লিয়াকত খান।
তিনি বলেন, "আমার বাবা যখন স্বাধীনতার পর আবার দেশে ফিরে আসতে চান তখন পরিচিত এক হেকিম বাবাকে বলেন, সেলিম তুমি যেহেতু বাংলাদেশে চলে যাচ্ছো, তোমাকে আমি এমন একটি জিনিস শেখাবো যেটা করে তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। তখন তিনি আমার বাবাকে এই কাবাবের মসলা ও রেসিপি বানানোটা শিখিয়ে দেন। বাবাকে সবকয়টি মসলা ধরে ধরে তিনি শিখিয়ে দেন কোনটা কতটুকু পরিমাণ দিতে হবে।"
মশলা তৈরি শেখোনোর পর সেই হেকিম সেলিম খানকে নাকি ওসিয়ত দিয়ে বলেছিলেন, "সেলিম তোমার কাবাব সবচেয়ে বেশি চলবে।"
সেলিম খান মারা গিয়েছেন ১৯৯৩ সালের দিকে, তখন লিয়াকত খান সবে ক্লাস থ্রিতে পড়েন। এই ছোট্ট বয়সেই ব্যবসা ও পরিবারের হাল ধরেন তিনি। লিয়াকত খান ছাড়াও সেলিম খানের আরও চার মেয়ে ছিলো। তাদের মধ্যে একজনকেও তিনি বিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি। লিয়াকত খান কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেলিম কাবাব ঘরকে সামানে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পরিবারে সবার ভরণপোষণের পাশাপাশি চার বোনকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। তবে তার এই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটাও সহজ ছিলো না। বিহারী হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময় মানুষের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে কটু কথা।
তিনি বলেন, "অবাঙালী হওয়ার কারণে সবসময় আমার দিকে খারাপ মন্তব্য ছুটে আসতো। পাকিস্তানকে আমরা কখনো চোখেও দেখিনি। আমার বংশেরও কেউ কোনোদিন পাকিস্তানে যায়নি। আমরা ভারতীয় বিহারী মুসলিম। আমার বাবা মা সরাসরি ভারত থেকে এদেশে এসেছেন। আমাদের জন্ম হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। তারপরও আমাদের নানান কথা শুনতে হয়েছে।"
তবে বর্তমানে মানুষজনের মাঝে এমন আচরণ কমে আসায় তিনি আগের চেয়ে স্বস্তিতে আছেন। তার এই ব্যাবসার সাফল্যের জন্য তিনি এলাকাবসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
সবকিছু ঠিক মতো চলতে থাকলেও ২০১০ সালে লিয়াকত খানের জীবনে নেমে আসে বিশাল আরেক দুর্যোগ। সড়ক দুর্ঘটনায় তার ঘাড়ের অংশের মেরুদন্ড ভেঙে যায়। অপারেশন করে তার ঘাড়ে স্ক্র লাগানো হয়েছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর এখন তিনি মোটামুটি সুস্থ। এই অবস্থাতেও তিনি সবকিছু চালাচ্ছেন নিজের হাতে।
ব্যাক্তি জীবনে সাত সন্তানের জনক লিয়াকত খান বলেন, "চলাচল করতে আমার কষ্ট হয়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এখনো আমি সবকিছু নিজের তত্ত্বাবাধনে চালাচ্ছি। মসলা আমি নিজে বানাই এবং বাকিসবকাজ লোক দিয়ে করাই।"
মসলায় জাদু
অন্যান্য কাবাব থেকে সেলিম কাবাবকে আলাদা করেছে এর মসলা বলে জানিয়েছেন লিয়াকত খান। এই মসলা বানানোর কৌশল তার বাবাকে শিখিয়েছিলো সেই বিহারের হেকিম। তার বাবার কাছ থেকে তিনি এটা পেয়েছেন এবং আজ পর্যন্ত সেটা ধরে রেখেছেন।
মসলা সম্পর্কে লিয়াকত খান বলেন, "আমার বাবার কাছ থেকে যে মসলাটা বানানো আমি শিখেছি তা আজ পর্যন্ত আমি ধরে রেখেছি। আর এই মসলা বানানোর কৌশলটা কারো কাছে প্রকাশ করা হয় না। এটা আমি গোপন করে রাখি।"
তবে তিনি জানিয়েছেন কাবাবের জন্য তার তৈরি মসলায় কোনো প্রকার ক্যামিকেল, সোডা, ফুড কালার, টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় না । এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি করা হয়।
নিজ খাবার সম্পর্কে লিয়াকত খান জানান, "যে খাবারটি আপনি খাচ্ছেন, সেটি আমার সন্তানও খাচ্ছে। আপনার প্রতি মায়া দেখানোর আগে আমার সন্তানের প্রতি আমার মায়া। এটি আপনার ক্ষতি করলে, আমার সন্তানেরও ক্ষতি করবে।"
এই মসলাটা শেখানোর জন্য অনেক সময় লিয়াকত খানের পেছনে লোক লাগানো হয়েছে। তাকে মোটা অঙ্কের টাকা সাধা হয়েছে এটা যেন তিনি শিখিয়ে দেন । কিন্তু তিনি তার মসলার স্বকীয়তা আজও ধরে রেখেছেন।
তিনি বলেন, "অনেকেই আমাকে বলতো, লিয়াকত তুমি এদেশে থেকে কী করবে? আমাদের মসলাটা শিখিয়ে দাও, তার বদলে তোমাকে আমরা বেশ কিছু টাকা দিই। সেগুলো নিয়ে তুমি ইন্ডিয়ায় চলে যাও।"
বর্তমান হালচাল
১৯৮০ সালে সেলিম খানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা হওয়া সেলিম কাবাব ঘর প্রায় ৪২ বছর যাবত ব্যবসা করে চলেছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর ডেকোরেশন যেমন ছিলো বর্তমান সময়ে এসেও প্রায় তেমনই রয়ে গেছে। টিনের ছাপড়া ঘর, এক পাশে কাবাব বানানো হচ্ছে, অপর পাশে কিছু টেবিল বেঞ্চ। তবে এই ছোট্ট দোকানটিতেই বিকাল ৪টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত কাস্টোমারদের ভীড় লেগে থাকে। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার খেয়ে যান। প্রথম অবস্থায় মূলত মোহাম্মদপুর এলাকায় বাসিন্দাদের জন্য খাবার তৈরি করা হলেও বর্তমানে প্রচার প্রসারের কারণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রতিদিন এখানে খেতে আসেন।
মোহাম্মদপুরের স্থানীয় অধিবাসী রাতুল ইসলাম, পেশায় একজন সরকারি চাকুরীজীবী। খাচ্ছিলেন আমার পাশের টেবিলেই। এই কাবাবের স্বাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এই কাবাব আমরা ছোট বেলা থেকেই খাচ্ছি। বর্তমানে বিভিন্ন ফুড ব্লগের প্রচারের কারণে বাহিরের লোক বেশি আসেন। আমরা এলাকার স্থানীয় কিন্তু মাঝে মাঝে আমরাই এসে জায়গা পাই না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। এটা আমরা খুশি মনে স্বীকার করে নিই। কারণ এই সেলিম কাবাবের জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ আমাদের এই সলিমুল্লাহ রোডে আসছেন। এটা আমাদের জন্য একটা গর্ব।"
খাবারের জন্য বাহিরে অপেক্ষা করছিলেন সেলিনা ইয়াসমিন নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী, এসেছেন মিরপুর থেকে। তার কাছে খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "অনলাইনে সেলিম কাবাব সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারি। এরপর বেশ কয়েকার এখানে এসেছি। মোটামুটি কম দামের মধ্যে অনেক ভালো একটি খাবার।"
সেলিম কাবার ঘর খোলা থাকে বিকাল ৪টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত। এখানে বর্তমানে মোট ১১ জন কর্মচারী কাজ করেন। একটা সময় প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ মানুষের জন্য খাবার তৈরি করা হতো। অন্য সবকিছুর মতো কোভিডের ধাক্কা লেগেছে লিয়াকত খানের এই খাবারের ব্যবসাতেও । বর্তমানে দৈনিক ১৭০-১৮০ জনের খাবার তৈরি করা হয়।
বিফ শিক কাবাব ছাড়াও এখানে আরো কয়েক প্রকারের খাবার পাবেন। যেমন- চিকেন শিক কাবাব, চিকেন চাপ, বিফ চাপ, বিফ বটি কাবাব, মগজ ফ্রাই। এগুলোর প্রত্যেকটি পেয়ে যাবেন মাত্র ১০০ টাকা করে। গরুর শিক কাবাবের পর এখানে সবচেয়ে বেশি চলে চিকেন চাপ ও মগজ ফ্রাই।
অনলাইনে পাওয়া যায়?
লোকবলের অভাবে সেলিম কাবাব থেকে হোম ডেলিভারি দেওয়া হয় না । কিছুদিন আগে ফুড ডেলিভারি কোম্পানির মাধ্যমে তাদের খাবারগুলো অনলাইনে পাওয়া গেলেও বর্তমানে সেই সেবাও বন্ধ আছে। লিয়াকত খান এসব ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলোর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মূলত ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলো এখান থেকে খাবার নিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করতো মাস শেষে। এই টাকা তুলে আনতে হতো ব্যাংক থেকে। আর সেখানেই হতো বিপত্তি, দেখা যেতো যেই পরিমাণ বিল হতো, তার অর্ধেক টাকা তারা ব্যাংকে রাখতো। ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলোর কাছে এর ব্যাখ্যা চাইলে তারা ট্যাক্স, পরিবহন ব্যয় ইত্যাদির কথা বলতো। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছিলো সেলিম কাবাব ঘর।
লিয়াকত খান বলেন, "তারা তাদের ইচ্ছা মতো মূল্য ছাড় দিয়ে আমার কাছ থেকে খাবার নিয়ে বিক্রি করতো। মাস শেষে বিল আনতে গিয়ে অর্ধেকেরও কম টাকা হাতে পেতাম। যেখানে বিল হতো ৩৬ হাজার সেখানে আমাকে দেওয়া হতো ১৬-১৭ হাজার। আমাদেরে এই ব্যবসায় ১২% লাভ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। সেখানে তাদের মাধ্যমে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি দিয়ে বিক্রি করা অসম্ভব।"
তবে ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলো সেলিম কাবারের টাঙানো মূল্য তালিকা অনুযায়ী খাবার কিনে নিয়ে অনলাইনে বিক্রি করলে কোনো আপত্তি নেই লিয়াকত খানের।
এছাড়া সেলিম কাবাবের ক্যাটারিং সার্ভিস চালু রয়েছে। ১২০ জনের উপরে হলেই বিয়েসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে গিয়ে তারা কাবাব বানিয়ে দিয়ে আসেন।