শুরু করুন বিসমিল্লাহর চিকেন চাপ ও বটি কাবাব দিয়ে, তারপর আছে আরও সাত রকম
রাত যত বাড়ছে, তত জমজমাট হয়ে উঠছে ঘরটি। গরম তেলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মশলা দিয়ে মাখানো এক-একটি মাংসের টুকরো। সেই ভাজা মাংসের গন্ধ এসে নাকে ঢুকছে আর পেটকে খিদের জানান দিচ্ছে। একদিকে পরোটা ও পোড়া মাংসের ধোঁয়া ওঠা গন্ধ, অন্যদিকে গালগল্প আর আড্ডায় মশগুল বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বয়সের মানুষ।
১৯ বছর ধরে রসনাবিলাসীদের কাবাবের প্রাণকেন্দ্র হয়ে আছে পুরান ঢাকার আলাউদ্দীন রোডের নাজিরাবাজারে অবস্থিত বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর। সুলভ মূল্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য অনন্য এ কাবাব ঘর। তরুণদের ভিড় বেশি হলেও সব শ্রেনীর মানুষদের আনাগোনা আছে এখানে।
ঢাকা শহরে এখনও শীত পুরোপুরি না নামলেও, মাঝেমধ্যে শীতের ঠান্ডা আমেজ পাওয়া যায় ঠিকই। এমন একটা সময়ে আপনার ভোজনবিলাসী মন যদি কাবাবের দাবি তোলে, তবে বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরকে রাখতেই পারেন আপনার পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম চিকেন চাপ। হোম ডেলিভারিগুলোতেও চিকেন চাপের চাহিদা তুঙ্গে। এছাড়া বটি কাবাব, বিফ চাপও বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে গরুর বটি কাবাব ১০০ টাকা, গরুর চাপ ৯০ টাকা, খাসির গুদ্দা কাবাব প্রতি হাফ ১৪০ টাকা, খাসির খিরি কাবাব হাফ ১৩০ টাকা, গরুর মগজ ভুনা ১২০ টাকা,খাসি মগজ ভুনা ১২০ টাকা, মুরগির ব্রেস্ট চাপ ১১০ টাকা, টিকিয়া ৫ টাকা, পরাটা ৮ টাকা ও সালাদ ফ্রি পাওয়া যায়।
সালাদের প্রসঙ্গে না বললেই নয়। শসা বা টমেটো-গাজর না, শুধু পেঁপে আর কাঁচামরিচ কুচি কুচি করে কেটে এক ধরনের মশলার সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। আপনি যদি শুধু সালাদের সঙ্গেও পরোটা খান তাতেও আপনার কম কিছু মনে হবেনা। পরোটার মোড়কে একটু কাবাব আর সাথে টক মিষ্টি ঝাল সালাদ আপনার রুচিতে আরও পরিপূর্ণতা এনে দেবে।
ঢাকার কলাবাগান থেকে বিসমিল্লাহ্ কাবাব ঘরে খেতে এসেছেন এক চিকিৎসক দম্পতি। তারা বলেন, "এখানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আসছি। তবে ছাত্রজীবনে এখানে খাবারের দাম আরও কম ছিল। এখন নিত্যপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের দামও ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে। কিন্তু স্বাদ ও মানের কথা ভাবলে আর লোভ সামলাতে পারিনা।"
কামরুন নাহার নামের আরেক বেসরকারি চাকরিজীবি জানান, "দামে কম, জায়গাটাও পরিষ্কার ও মোটামোটি স্বাস্থ্যকর এখানে, তাছাড়া পরোটা ও চাপগুলো নরম হওয়ায় বাচ্চারা খুব পছন্দ করে খায়। তাই ছুটির দিনে স্বামী এবং দুই বাচ্চা নিয়ে প্রায়ই চলে আসি এখানে।"
নাজিরাবাজারেই পরপর রয়েছে বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরের দুটি দোকান। প্রথমটির যাত্রা ১৯৮৭ সালে মো. খোরশেদের হাত ধরে। বাবার মৃত্যুর পর দু ছেলের মধ্যে ১৯৯৫ সালে বড় ছেলে হাবিবুর রহমান ব্যবসাটির হাল ধরেন। তবে হাবিবুর রহমান এবং রবিন দুই ভাই মিলেই বর্তমানে হোটেলটি দেখাশোনা করছেন। দ্বিতীয় শাখাটি হয় ৭ বছর আগে। দ্বিতীয়টি প্রথমটির তুলনায় একটু বড়। একসঙ্গে ৪০ জন বসতে পারে নতুনটিতে।
কথা হয় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, "আমাদের এখানে কাস্টমারদের মধ্যে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মন্ত্রী,আমলারাও আছেন। তারা সচরাচর না এলেও হোম ডেলিভারি নিয়ে যান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিক্যালের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের একটা ফিক্সড কাস্টমার এসব শিক্ষার্থীরা।"
কথা হয় হাবিবুর রহমানের ছোট ভাই রবিনের সঙ্গেও। তিনি জানান, "আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি হল, বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর বিদেশী শিক্ষার্থীদের খুবই প্রিয় একটি জায়গা। তারা এখানে প্রায়ই আসে এবং খুব তৃপ্তি নিয়ে খায়। কাস্টমারদের একটি ফিক্সড উৎস তারা।"
নতুন নতুন আরও অনেক হোটেল হবার পরেও কাবাবের প্রতিযোগিতায় কেন তাদেরকে একনামেই চেনে মানুষ তার উত্তরে রবিন বলেন, "আমাদের বিশেষত্ব আসলে মশলায়। আমরা মাখানোর সময় কিছু মশলা ব্যবহার করি যার কারণে কাবাবগুলো অনেক নরম আর রসালো হয়। আমাদের চিকেন চাপটি পরিমাণে অনেক বড় হয়।"
করোনায় ব্যবসার হাল-হকিকতের কথা জিজ্ঞেস করলে তারা দুই ভাই-ই আফসোসের সুরে তাল মেলান। বলেন, "করোনার সময় আড়াই মাস থেকে চার মাসের মতো বন্ধ ছিল হোটেল। ফলে ব্যবসা পড়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল। আমাদের আয়ের একটি ফিক্সড উৎস এসব শিক্ষার্থীরা। এখন সবকিছু খুলে গেলেও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে কাস্টমার সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া এসব খাবার হলো কিছুটা বিলাসিতার খাবার। তাই চাহিদাও কমে গেছে অনেক।"
কীভাবে যাবেন?
নাজিরাবাজার এলাকা জুড়ে রয়েছে সব প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খাবারের দাবারের দোকান। বিউটি লাচ্ছি, হাজী নান্না বিরিয়ানিসহ রয়েছে আরও অসংখ্য বিরিয়ানি, লাচ্ছি জুস আর কাবাবের দোকান। সাথে কোনায় কোনায় ল্যাম্পপোস্টের মতো আছে ছোট ছোট মিষ্টি শাহী পানের দোকান। এতকিছুর ভিড়েও কিন্তু যে কেউ আপনাকে চিনিয়ে দিতে পারবে বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরের দোকানটি। গুলিস্তান এসে বংশালের প্রধান সড়কে ঢুকে হাতের ডান দিকে আলু বাজার হয়ে ঠিক শেষ মাথায় চৌরাস্তার বাম পাশে তাকালে বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরটি দেখা যাবে। অপরদিকে বঙ্গবাজার এসে কাজী আলাউদ্দিন রোডে ঢুকেই শেষ মাথার চৌরাস্তায় এটি দেখা যাবে।
যদিও দোকানের সাইনবোর্ড, পার্সেলের প্যাকেট বা খাবারের তালিকা অনুযায়ী দোকান খোলা বিকেল ৪টা থেকে রাত ১২/১টা পর্যন্ত। তবে আশেপাশের সবার সঙ্গে জানা যায়, দোকানটি প্রায় সারারাতই খোলা থাকে। মূলত কাস্টমারদের ভিড় বাড়তে থাকে রাত ১০টার পরই।
একদিকে প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে মন ভরে গালগপ্প, নাজিরাবাজারের জমজমাট, উৎসবমুখর পরিবেশ আর অন্যদিকে পরোটার মোড়কে একটু কাবাব আর সাথে টক মিষ্টি ঝাল সালাদ আপনার স্বাদে আর মনে এনে দেবে এক অসাধারণ পরিপূর্ণতা। পরিশেষে এটুকু বলা যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের মতো ধোঁয়া ওঠা মাংসের কাবাব আর গরম গরম পরোটার স্বাদ পেতে কাবুল না হলেও, পুরান ঢাকার আলাউদ্দীন রোডের নাজিরাবাজারে বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরই হতে পারে আপনার জিভের তৃপ্তিস্থল।