নসফেরাতু- ড্রাকুলার ১০০ বছর
নসফেরাতু মুক্তি পেয়েছিল ১৯২২ সালে। তখনো চলচ্চিত্র কথা বলতে শেখেনি মানে নির্বাক যুগের এই চলচ্চিত্র 'নসফেরাতু: আ সিম্ফনি অব হরর' তৈরি হয়েছিল জার্মানীতে। এটি একটি প্রকাশবাদী ভৌতিক ছবি। এফডব্লিউ মুরনাউ পরিচালিত ছবিটিতে ম্যাক শ্রেক কাউন্ট অরলকের চরিত্রে অভিনয় করেন যে আসলে কি না ভ্যাম্পায়ার। ১৮৯৭ সালে লেখা ব্রাম স্টোকারের উপন্যাস 'কাউন্ট ড্রাকুলা' অবলম্বনে তৈরি এ ছবিতে যদিও তা বলা-কওয়া হয়নি।
গেল শতকের শুরুতে জার্মানীতে শুরু হয়েছিল এক্সপ্রেশনিস্ট মুভমেন্ট (প্রকাশবাদী আন্দোলন)। এটি ছিল একটি শিল্প আন্দোলন। কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর বহিরঙ্গের চেয়ে অন্তরঙ্গের প্রকাশ ঘটানো এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। এ আন্দোলন বিশেষত চলচ্চিত্রে অনেকগুলো নতুন টুল (উপকরণ) যোগান দিয়েছে। এর সূচনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে খুব অভাবে পড়ে পুরো জার্মানী। ফিল্ম স্টুডিওগুলো বাস্তবভিত্তিক ছবি নির্মাণের খরচ যোগাতে পারছিল না। সে তুলনায় এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার ছবিতে খরচ পড়ছিল কম। ওসব ছবিতে ছায়া, বিশেষ ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল আর প্রাসাদমতো সেট তৈরি করাটাই কাজ ছিল। তাতে কেবল খরচই কম হচ্ছিল না ভয় সঞ্চারও সহজ হতো এতে। মনস্তত্ত্ব ছিল বেশিরভাগ ছবির বিষয়। তাতে স্বপ্নের আবহ তৈরি করার কাজ ছিল বেশি। ওই সময় জার্মান স্টুডিওগুলোর টিকে থাকার এছাড়া বিকল্পও ছিল না। জার্মানীতে যু্দ্ধ অর্থ-সম্পদ, স্বচ্ছলতা আর স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় রেখে গিয়েছিল দগদগে ক্ষত, দারিদ্র্যের কষাঘাত আর মনে যন্ত্রণা। তাই তেমন তেমন সিনেমাই হচ্ছিল তখনকার জার্মানীতে।
তখনকার চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে মুরনাউ (১৮৮৮-১৯৩১), মেট্রোপলিস নির্মাতা ফ্রিৎজ ল্যাঙের নাম বারবারই আসে। মুরনাউ ছিলেন ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা। খুব শান্ত আর অন্তর্মুখী ছিলেন তিনি। মনে হতো এক্সপ্রেশনিস্ট ছবির একজন চরিত্র তিনি নিজেই। যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন পাইলট, প্রথম ছবি করেছিলেন ১৯১৯ সালে। নসফেরাতু তার দশম চলচ্চিত্র। তার 'দ্য লাস্ট লাফ' আর 'সানরাইজে'র নামও করে থাকেন বোদ্ধারা।
নসফেরাতুর গল্প
১৮৩৮ সালের পটভূমিতে, উইসবর্গ নামে জার্মানীর এক কাল্পনিক শহরের গল্প আছে নসফেরাতুতে। ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের কাউন্ট অরলক থাকেন ট্রান্সসিলভানিয়ায়। রিয়েল এস্টেট এজেন্ট থমাস হুটারের এলাকায় সে একটি বাড়ি কিনতে চায়। অরলকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে হুটার যে সরাইখানায় বিশ্রাম নিতে থামে সেখানকার লোক অরলকের নাম শুনেই ভীত হয় । পরে হুটার অরলকের প্রাসাদে যায় এবং রাতের খাবার খাওয়ার সময় আঙুলে চোট পায়। হুটারের আঙুলের রক্ত চুষে ফেলতে উদ্যোগী হয় অরলক কিন্তু হুটার হাত সরিয়ে নেয়। পরের দিন ভোরে উঠে হুটার আবিস্কার করে তার ঘাড়ে একটি ছোট্ট ক্ষত তৈরি হয়েছে কিন্তু ধারণা করে সেটা মশার কাজ। ওইদিন রাতেই অরলক জমি জমার কাগজপত্রে সই করে আর দেখতে পায় হুটারের স্ত্রী এলেনের একটি ছবি। এর মধ্যে হুটারের সন্দেহ হয় যে অরলক একজন রক্তচোষা। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে হুটার ব্যর্থ হয় আর সে সুযোগে অরলক ঘরে প্রবেশ করে। ভয়ে হুটার চৌকির নীচে গিয়ে লুকায়।
এবার হুটার দ্রুতই বাড়ি ফেরার পথ ধরে। কিছুকাল পরে জাহাজে চড়ে অরলকও সে অঞ্চলে পৌঁছে যায়। অরলক পৌঁছানোর পর থেকেই এলাকায় মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এর মধ্যে হুটারের স্ত্রী ভ্যাম্পায়ারের চরিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করে জানতে পারে যে, কোনো ভালো ও সচ্চরিত্র নারী যদি মায়াজাল বিস্তার করে তবে ভ্যাম্পায়ারকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব। সেইমতো এলেন মানে হুটারের স্ত্রী আমন্ত্রণ জানায় অরলককে। অরলক ঘরে প্রবেশ করে আর এলেনের রক্ত পানে উদ্যোগী হয় তবে এর মধ্যে সূর্য উদিত হলে অরলকের শক্তি নষ্ট হয়। পরে হুটার এলেনকে দীর্ঘ সময় জড়িয়ে ধরে রাখে, তাতে জীবনীশক্তি সঞ্চারিত হয় আর এলেন জীবন ফিরে পায়।
মুক্তি পাওয়ার পর পরই নসফেরাতুর বিরুদ্ধে ব্রাম স্টোকারের উত্তরাধিকারীরা মামলা ঠুকে দেয়। আর দলিল দস্তাবেজ যাচাই-বাছাই করে আদালত আদেশ দেয়, ছবিটির সব কপি পুড়িয়ে দিতে। তারপরও কিছু প্রিন্ট রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। আর তারপর দিনে দিনে সেটি প্রভাববিস্তারী এক মাস্টারপিস ছবির তকমা এঁটে নেয় গায়ে।
নসফেরাতু বিতর্কও জন্ম দিয়েছে অনেক। কাউন্ট অরলকের আংটার মতো নাক, ঘন ভ্রু, জ্বলজ্বলে চোখ, লম্বা লম্বা ধারালো নখ আর বড়সড় টাক মাথা – সবমিলিয়ে ব্যাপারটি ছিল ইহুদি বিরোধী। দীর্ঘদিন আগে থেকে এভাবেই এঁকে ব্যঙ্গ করা হতো ইহুদিদের। এছাড়া ওই সময়ের জার্মান আধিপত্যবাদী চরিত্রও ফুটে উঠেছিল ছবিটিতে বিশেষ করে অরলকের অন্যত্র জমি কেনার আগ্রহের মধ্য দিয়ে।
নসফেরাতুর প্রভাব
সব সত্ত্বেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে নসফেরাতুর প্রভাব ঠেকানো যায়নি। ওয়ার্নার হেরজগও যেমন 'নসফেরাতু দ্য ভ্যাম্পায়ার' নামের ছবি তৈরি করেছেন যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। ১৯৭৭ সালে গানের দল ব্ল ওয়েস্টার কাল্ট 'স্পেকট্রেস' নামের অ্যালবামে নসফেরাতু নামের একটি গান প্রকাশ করেছে। ১৯৭৯ সালে হিউ কর্নওয়েল এবং রবার্ট উইলিয়ামস নসফেরাতু নামের একটি আস্ত অ্যালবামই প্রকাশ করেছে।
২০০০ সালের নসফেরাতু প্রভাবিত চলচ্চিত্র 'শ্যাডো অব দ্য ভ্যাম্পায়ার' দুটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। স্টেফানি মায়ারের টোয়াইলাইটও কিন্তু নসফেরাতুরই আধুনিক সংস্করণ। শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সিসেম স্ট্রিটেও কাউন্ট ফন কাউন্ট নামের একটি চরিত্র আছে। সে অবশ্য রক্ত পান করে না, বরং আশপাশে যা কিছু আছে সব গুনে ফেলে।
যেভাবে নসফেরাতু চেহারা পেল
রোমানিয়ান শব্দ নসফেরাতু, ইংরেজি করলে দাঁড়ায় 'আনডেড'। ব্রাম স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলার বাড়িও ছিল রোমানিয়ার কার্পাথিয়ান পাহাড়ে। নসফেরাতুর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন হেনরিক গালেন। আগেও তার চিত্রনাট্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পরে তিনি পরিচালনায়ও আসেন। ডিজাইনার, পেইন্টার, স্থপতিও দলে রেখেছিলেন মুরনাউ। আর ছিল একজন অকালটিস্ট যার নাম আলবিন গারু। ছবির আর্ট ডিরেকশনের দায়িত্ব ছিল তার। তিনি পোশাক ও সেট নকশা করেছেন। অরলকের ভ্যাম্পায়ার চেহারা তারই সৃষ্টি। গারু আসলে প্রেরণা পেয়েছিলেন ১৯১৪ সালের কিছু অলংকরণ থেকে। আর সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল একটি উপন্যাসে, এঁকেছিলেন হুগো স্টেইনার প্রাগ।
গারু নিজেই বলেছেন, সাদা কালো ওই ইমেজগুলো নসফেরাতু তৈরি করতে সাহায্য করেছে। আরো বলেছেন, 'সার্বিয়ার এক কৃষকের কাছে শুনেছিলাম, সে ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে লড়াই করেছে। ওই কৃষকের দেখা ভ্যাম্পায়ারও আমাকে সাহায্য করেছে।'
অরলক চরিত্রে শ্রেকের অভিনয়ও দানোটাকে জীবন্ত করেছে। অনেক দর্শক সত্যি ভেবে বসেছিলেন, মানুষটি বাস্তবিকই একজন রক্তচোষা। মুরনাউয়েরও কিছু কারিকুরি আছে, সেগুলোকে স্পেশাল এফেক্ট বললে বেশি বলা হয়ে যায় না যেমন অরলকের কফিনের দরজা আপনাআপনি বন্ধ হওয়া বা ভূমি থেকে শূন্যে ভেসে থাকা ইত্যাদি। লোকেশনেরও আছে ভূমিকা যেমন অরলকের প্রাসাদের বহিঃদৃশ্যের সব ছবিই তোলা হয়েছিল ৭০০ বছরের পুরনো সত্যিকারের এক প্রাসাদের গা থেকে।
প্রাচীনকাল থেকেই আছে রক্তচোষা
ব্লাদ ড্রাকুলার তিন নম্বর ছেলের নাম ছিল ব্লাদ দ্য ইমপেলার। তিনি রোমানিয়া ওয়ালাচিয়ার শাসক হয়েছিলেন ১৪৩৬ সালে। অটোমান শাসকরা তাকে পছন্দ করত না। আর নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাকে নৃশংস সব কাজে যুক্ত থাকতে হয়েছে। তার নৃশংসতার গল্পগাঁথা ছড়িয়ে যায় পুরো জার্মানভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
ব্রাম স্টোকার তার নামানুসারেই চরিত্রটির নাম রেখেছিলেন কাউন্ট ড্রাকুলা। মধ্যযুগের রোমানিয়ায় ব্লাদ ড্রাকুলা বলতে ব্লাদ দ্য ড্রাগন বোঝাতো। পরের দিকে ড্রাকুলা মানে শয়তান বোঝাত।
সে আমলে পূর্ব ইউরোপীয়দের মেপে চলতো পশ্চিমারা। হামলার ভয় করতো প্রায়শ। তাই সামাজিক অস্থিরতার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়েছিল ড্রাকুলাকে। আবার অন্যদিকে ভিক্টোরিয়ান যুগের ব্রিটেন ছিল কঠোর। সেখানে রক্ষণশীলতা ছিল মারাত্মক পর্যায়ে। তাই বিশ্লেষকরা ভাবেন, অবদমিত সমাজে ড্রাকুলা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের প্রতীক। ব্রাম স্টোকারের উপন্যাসটিও জটিলভাবে বিন্যস্ত আর তাতে বৈপরীত্যও কম নেই।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যকার সংঘাত দেখা যায় কাউন্ট ড্রাকুলায়। ড্রাকুলা এখানে অতীতের প্রতিভূ যে সইতে পারে না নতুন সময়ের প্রযুক্তি আর তার বিকাশকে। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কিন্তু এর জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে পৌঁছে দেয় নসফেরাতু। চলচ্চিত্রটির সব কপি ধ্বংস হয়েও যে কয়টি টিকেছিল সেগুলোর কোনো কোনোটি পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকায় আর লোকে দলবেঁধে দেখেও ছিল। তার ফলশ্রুতিতে নসফেরাতুর নয় বছর পরে ১৯৩১ সালে তৈরি হয়েছিল আমেরিকান হরর ফিল্ম ড্রাকুলা। তারও আগে ১৯২৭ সালে ড্রাকুলা অভিনীত হয়েছে ব্রডওয়েতেও। ড্রাকুলার সাফল্য দেখে ইউনিভার্সাল পিকচারস আলাদা করে কেবল হরর ছবি বানানোর বিশেষ স্টুডিও তৈরি করেছিল।
ইউরোপীয় লোকগাঁথায় বিশেষ করে গ্রিস দেশের গল্পগুলোয় চলমান মৃহদেহ আর রক্তচোষা দানোর দেখা মেলে প্রাচীন যুগেই। মধ্যযুগে যুক্ত হয় ভ্যাম্পায়ার। এটা এমন প্রাণী যারা মানুষের রক্ত পান করে বেঁচে থাকে। রক্ত চুষে নিতে হয় বলেই লম্বা চোখা দাঁত তাদের থাকতে হয়। বেশিরভাগ গল্পেই দেখা যায় ভ্যাম্পায়াররা অমর। রাতের বেলায় তারা উঠে আসে কবর ফুঁড়ে বা কফিনের ঢাকনা খুলে। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার কয়েকটি পথ আছে। সবচেয়ে কথিত পথ হলো যদি কোনো ভ্যাম্পায়ার কাউকে কামড়ায়। এছাড়া আত্মহত্যাও ভ্যাম্পায়ার হওয়ার দরজা খোলে। কোনো মরদেহের ওপর দিয়ে বেড়াল লাফিয়ে গেলেও রক্তচোষার দেখা মিলতে পারে। রক্তচোষা ধ্বংস হয় যদি হৃদয় বরাবর কাঠ ফুঁড়ে দেওয়া যায় বা আগুন লাগিয়ে দেওয়া যায় অথবা সূর্যের আলো ওঠা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা যায়। রসুন, ক্রসচিহ্ন আর পবিত্র পানিকে ভয় পায় ভ্যাম্পায়ার।