ভ্যাম্পায়ার মিথ কোত্থেকে এল?
ব্রাম স্টোকারের 'কাউন্ট ড্রাকুলা' থেকে 'টোয়ালাইট সাগা', অথবা অগণিত হ্যালোইন পোশাকের আড়ালের ভ্যাম্পায়ার চরিত্রটি গথিক ও রহস্যময় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য প্রতীক হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর হ্যালোউইনের অন্ধকার রাতে যেন এ রক্তপিপাসু এ চরিত্রের জাগরণ ঘটে।
কিন্তু এ রহস্যময় নিশাচর রক্তচোষা চরিত্রের উৎপত্তি আসলে কোথায়? ডাইনি এবং ওয়ারউলভের প্রাচীন মিথের তুলনায় ভ্যাম্পায়ারের কাহিনীর উৎপত্তি তুলনামূলক সাম্প্রতিক হলেও ব্রাম স্টোকার ১৯ শতকে 'ড্রাকুলা' লেখার আগে থেকেই ছিল ভ্যাম্পায়ারের আনাগোনা।
স্লাভিক লোককাহিনীর ভূমিকা
ভ্যাম্পায়ার মিথের সঠিক উৎস স্পষ্ট না জানা গেলেও স্লাভিক লোককাহিনী ভ্যাম্পায়ার ধারণার বিকাশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। অনেক গবেষক মনে করেন, প্রায় এক হাজার বছর আগের বুলগেরিয়ান লোককাহিনীতে 'ভূত দানব' হিসেবে পরিচিতি ভয়ঙ্কর অ-মৃত [আনডেড] প্রাণীরা রাতে গ্রামগুলোতে ঘুরে বেড়াত।
এ রক্তপিপাসু প্রেতাত্মাগুলো গ্রামের লোকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করত, কখনো কখনো রোগ ও বিপর্যয় ডেকে আনত। তখনকার স্লাভিক সংস্কৃতিতে 'ভ্যাম্পায়ার' শব্দটি 'শয়তান' অর্থেও ব্যবহৃত হতো।
ভ্যাম্পায়ারের পশ্চিমা সংস্কৃতিতে প্রবেশ
ভ্যাম্পায়ার মিথ কীভাবে পশ্চিমা সমাজে প্রবেশ করেছিল, তার ইতিহাসও বেশ রহস্যময়। রোমান সাম্রাজ্যের জার্মান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী যখন হাঙ্গেরি ও স্লাভিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে, তখন এ মিথ তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়।
ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ভ্যাম্পায়ারের ধারণাটি পরে ভিয়েনা, বার্লিন এবং লন্ডনের মতো শহরে এবং তারপর আমেরিকায় পৌঁছায়। এর মাধ্যমে ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তির নতুন রূপান্তর ঘটে। প্রেতাত্মা থেকে ভ্যাম্পায়ারদের ধারণা বিকশিত হয়ে হয়ে ওঠে ধারালো দাঁতযুক্ত রক্তচোষা প্রাণীতে।
ভ্যাম্পায়ারের রক্তপানের মিথের উৎসও অদ্ভুত। ঐতিহাসিকদের মতে, ইউরোপ ও আমেরিকাতে মানুষ মানবরক্তের ওষুধি গুণাবলী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাসী ছিলেন। ভ্যাম্পায়ারের রক্তপানের চরিত্রের বিকাশে এ ধারণাও অবদান রেখেছে বলে মনে করা হয়।
প্রথম প্রকাশিত ভ্যাম্পায়ার গল্প
ভ্যাম্পায়ার চরিত্র নিয়ে প্রথম প্রকাশিত রচনাগুলোর মধ্যে অ্যাংলো-ইতালীয় চিকিৎসক জন পলিদোরির ১৮১৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'দ্য ভ্যাম্পায়ার' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ উপন্যাসে পলিদোরি পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক চরিত্রের ভ্যাম্পায়ার, যার মধ্যে ছিল শয়তানি প্রবৃত্তি এবং মানুষের রক্তের প্রতি আকর্ষণ।
পরবর্তীসময়ে আইরিশ লেখক জোসেফ শেরিডান লে ফানুর 'কারমিলা' ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে এক নারী ভ্যাম্পায়ারের চরিত্র ছিল যে তরুণীদের তার শিকার বানাত।
১৮৯৭ সালে ব্রাম স্টোকারের 'কাউন্ট ড্রাকুলা' প্রকাশিত হলে তৎকালীন সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। স্টোকারের লেখা থেকে পরবর্তীকালে ভ্যাম্পায়ার মিথের বিস্তৃত বর্ণনা উঠে আসে। স্টোকার তার গল্পের মূল চরিত্র ড্রাকুলাকে এক অভিজাত শ্বেতাঙ্গ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যার ভ্যাম্পায় রূপ লম্বা নখ, সূচালো কান ও তীক্ষ্ণ দাঁতসম্পন্ন এক রক্তখেকো চরিত্র।
ধারণা করা হয়, স্টোকার বিভিন্ন লোককাহিনী, বিশেষত স্লাভিক লোকগাঁথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ড্রাকুলা চরিত্রের রূপ দেন। এছাড়া ভ্লাদ দ্য ইম্পালারের চরিত্রের ছাপও ছিল তার ড্রাকুলায়।
বিরল রক্তের ব্যাধি?
বিভিন্ন গবেষকের মতে, পরফিরিয়া নামক রক্তের একটি বিরল ব্যাধি ভ্যাম্পায়ার মিথের কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরিতে অবদান রাখতে পারে। এ রোগ হলে ব্যক্তির রক্তে হিম [হিমোগ্লোবিনের উপাদান] উৎপাদন কমে যায়।
এ ব্যাধির লক্ষণ হিসেবে ফ্যাকাশে ত্বক, সূর্যের আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা, রসুনের প্রতি অসহিষ্ণুতা, এবং মাড়ির ক্ষয় দেখা দেওয়ার বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। মাড়ির ক্ষয় হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দাঁত দেখলে শ্বদন্তের মতো মনে হতে পারে।
ধারণা করা হয়, স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময়ে পরফিরিয়া আক্রান্ত 'ভ্যাম্পায়ার'দের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। এ থেকেই হয়তো ভ্যাম্পায়ারের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ভয়ের বিষয়টি তৈরি হয়েছে।
এছাড়া জলাতঙ্ক ও যক্ষ্মাসহ অন্যান্য রোগ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণও ভ্যাম্পায়ার মিথের উৎস হতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।