সদরঘাট: ‘বুড়িগঙ্গা জীবন দিয়েছে ঢাকাকে, আর ঢাকা নদীটাকে মারল!’
বাবা একবার লঞ্চঘাট ডেকেছিলেন। ঘাটে একটা চারপেয়ে টেবিল ছিল, তার একটা ড্রয়ার ছিল, বসার জন্য দুটি কাঠের চেয়ার ছিল। টেবিলের ওপর টিকিটের তোড়া থাকত। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। টিকিটগুলো ছাপানো ছিল, জনপ্রতি মূল্য আট আনা ছিল- বোধকরি।
ছোট্ট ঘাট একটা, ধলেশ্বরীর পাড়ে, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি থানার আব্দুল্লাপুর গ্রামে। দুই রুটের লঞ্চ আমাদের ঘাট ধরে যাতায়াত করত। একটা রুট ছিল তালতলা থেকে নারায়ণগঞ্জ; অন্যটা তালতলা থেকে ঢাকা। লঞ্চগুলোর ছিল কাঠের বডি। স্টিলের বডিওয়ালা লঞ্চ তখন হাতেগোনা।
লঞ্চগুলো দু্ইতলা হতো। ওপরের তলায় ভাড়া ছিল দ্বিগুণ, সেখানে লোহার চেয়ার বিছানো থাকত আর নীচতলায় ছিল লোহার টানা বেঞ্চি। ওপর তলায় ধুয়াওড়ানোর চিমনি ছিল, আর নীচতলায় ইঞ্জিন। ওপর তলায় চার বা পাঁচ থাকের সিড়ি পেরুলেই সারেংয়ের ঘর। লম্বা টানা কাঠের টুলে গদি বিছানো থাকত সেখানে। পেয়ারের লোকদের সারেং সেখানে বসার অনুমতি দিতেন।
সারেংকে সাধারণত দাড়িয়েই লঞ্চ চালাতে হতো। তার সম্বল বলতে একটা বড় লোহার ড্রাইভিং হুইল। হুইলের ধারেই থাকত একটা প্লাস্টিক তারের দড়ি। দড়িটা আড়া, কড়িকাঠ বেয়ে চলে যেত ইঞ্জিন ঘরে। সারেং দড়িতে টান দিয়ে দুই, তিন বা চারবার ঘণ্টা বাজাতেন। ইঞ্জিনম্যান ঘণ্টার সংকেত শুনে বেগ কমাতেন বা বাড়াতেন।
লঞ্চগুলো ছোট ছিল, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জগামী লঞ্চ। এ লঞ্চটায় চড়ত বেশি কলেজ ছাত্ররা। মুন্সিগঞ্জ সদরের হরগঙ্গা কলেজ ছিল তখন পুরো তল্লাটের 'সবেধন নীলমণি'। অবশ্য গুটিকয় 'ছাওয়াল-পাওয়াল' নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজেও পড়তে যেত। লঞ্চে একজনকে সারাক্ষণ ঘুরতে দেখা যেত। তাঁর হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলত। ব্যাগে টিকিট থাকত আর রাখতেন টাকা।
তখন আব্দুল্লাপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত টিকিটের সর্বোচ্চ মূল্য ৮ টাকা ছিল বলে মনে পড়ে। ঢাকায় যেতে সময় লাগত আড়াই ঘণ্টা। তালতলা থেকে ছেড়ে লঞ্চটি পথে ধরত বেতকা, আব্দুল্লাপুর, কাঠপট্টি, বক্তাবলী, ফতুল্লাঘাট। ধলেশ্বরীর পর শীতলক্ষ্যা পাওয়া যেত অল্প একটু, তারপরই বুড়িগঙ্গা।
লঞ্চে ভালো হতো ঝালমুড়ির বেচাকেনা। দু-একজন বিক্রি করত চিড়ার মোয়া। চিরুনি, সুই, সুতো বিক্রেতাও দেখতাম। মাঝে মধ্যে উঠতেন অন্ধ গায়ক, দারুণ ছিল তাদের গানের গলা। সাধারণত তারা মারফতি গান গাইতেন। আমরা তখন বছরে দু-তিনবার খালার বাসা বা চাচার বাসায়- ঢাকায় যেতাম।
প্রতিদিন সকাল সকাল বাবা একটা খুতি (কাপড়ের ছোট্ট ঝোলা) নিয়ে ঘাটে যেতেন, ফিরতেন সেই রাত করে। দুপুরে আমি বা আমার ভাই খাবার দিয়ে আসতাম ঘাটে। সেখানে যাওয়া আমাদের জন্য আনন্দের ছিল। কারণ কাঁচা টাকা দেখার সুযোগ পেতাম। তেমন আমদানি থাকলে- বাবা চার আনা আট আনা দিতেনও।
বাবার জন্য কাজটা খুব আনন্দের ছিল না, তিনি একসময় হাবিব ব্যাংকে কাজ করতেন, পরে আড়তদারিও করেছেন আর ছিলেন নিপাট ভালোমানুষ। কিন্তু, জীবিকার তাগিদে তাকে হলুদ রাঙানো, পানক্ষেতি বা ঘাট ডাকার কাজ করতেই হতো। ততদিনে আমরা পাঁচটি ভাই। আমার মাও ছিলেন সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। যাহোক বাবাকে খুব আফসোস করতে শুনিনি কখনো। বাবা ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন, সবই নিয়তি বলে মানতেন।
বাবার সঙ্গে সদরঘাট
বাবার সঙ্গে কলেজের ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসার স্মৃতিটিই বড় হয়ে আছে। বাবা একটা বেপারী পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে ছিলেন। আমরা বসেছিলাম, চিমনির ধারের খোলা জায়গায়। শুরুর শীতের রোদ ছড়িয়েছিল বিকেল বেলায়। বাবা বলেছিলেন, 'নটরডেমে খরচ হবে মেলা, হরগঙ্গায় পড়লেই পারতে।' কিন্তু আমার নটরডেমে পড়ার খুব শখ। আমি শহরের বাতাসে গা গরম করতে চাই। আমার পোশাক-আশাক ভালো না; কিন্তু মনটা বিদেশে যেতে চায়। তাই নটরডেমে পড়তেই হবে।
যাহোক চিমনির ধারের জায়গাটা দোতলায় হয়েও বসার ব্যবস্থা নেই বলে ভাড়া সেখানে কিছু কম। সদরঘাটের একদম পশ্চিমে পন্টুন ছিল ঢাকা-তালতলা রুটের জন্য বরাদ্দ। ঘাট তখন অনেক ছোট ছিল। ৭-৮টি পন্টুন হয়তো ছিল সব মিলিয়ে। ঘাটের কোথাও পণ্যসামগ্রীর বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড দেখিনি। যদ্দূর মনে পড়ে, ঘাটে ঢোকা ও বেরুনোর একটাই পথ ছিল তখন। আমার বাবার ছোট ভাই, আমরা বলতাম 'চিনি চাচা'- নিতে এসেছিলেন ঘাটে। তিনি বললেন, 'হেঁটে যেতে পারবি না বাবা?' ভাবলাম, আমি গাঁয়ের ছেলে, হাঁটতে পারব না বললে হয়? প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ তিনি হাঁটিয়ে নিলেন।
তারপর শ্যামবাজারের কাচাবাজারের মুখে একটা ডিমের দোকানে থামিয়ে বললেন, খা যে কয়টা ইচ্ছে হয়। মনে হলো, তিনি হাঁটিয়ে আনার জরিমানা গুণতে চাইছেন। আমার খুব ভালো লাগল চিনি চাচার বুদ্ধিটা।
ঢাকায় কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তো বাড়ি যাওয়া আসার জন্য লঞ্চই ছিল প্রধান বাহন। এছাড়া, সদরঘাটে বিকেল কাটাতেও যেতাম। আমরা সেকালে শুশুক দেখেছি বুড়িগঙ্গায়। নদীতে লঞ্চের আনাগোনা দেখতেও ভালো লাগত। সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গার পানি আলোয় ভাসত। ঢেউয়ের দোলায় আলোগুলো ছড়িয়ে যেত ওপারে কালিগঞ্জ অবধি। সদরঘাট দেখতাম, ফরাশগঞ্জ জামে মসজিদের বারান্দা থেকেও। বাকল্যান্ড বাঁধের মাঝখানেই সদরঘাট। পশ্চিমে আহসান মঞ্জিলে, পূবে লালকুঠি, উত্তরে কলেজিয়েট স্কুল আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আর ব্যাপ্টিস্ট মিশন চার্চ আর বাহাদুর শাহপার্ক।
মুড়ির টিন তখন ছাড়ত ওই বাহাদুর শাহ ওরফে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকেই। গুলশান পর্যন্ত যেতে গুলিস্তানে, মালিবাগে, মহাখালিতে– মরা সাপের মতো পড়ে থাকত, মানে দাঁড়িয়ে থাকত ২০/৩০ মিনিট। তখনকার মানুষের বুঝি আজকের মতো তাড়াও ছিল না। ভাড়া কত ছিল মনে নেই। যাহোক সদরঘাট আসলে নৌকা, লঞ্চ আর জাহাজের জিরানোর জায়গা। যাত্রী চলাচল বিবেচনায় হয়তো ঢাকার সদরঘাটই দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত নদীবন্দর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলার সঙ্গেও এটি যোগাযোগের মাধ্যম।
সেই মুঘল আমলেও ছিল
নদীটাই কিন্তু কারণ- শহরটা তৈরি হওয়ার। সব সভ্যতাই তৈরি হয়েছে নদীর পাড়ে। গঙ্গা, দজলা, ফোরাত আর নীল তো সভ্যতার কারণেই বিখ্যাত। আমাদের রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গা ছিল বলেই। বলা হয়ে থাকে, মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁর বজরার নাম ছিল চাঁদনী; আর সে থেকেই বুড়িগঙ্গার ধারের একটি ঘাটের নাম হয়- চাঁদনী ঘাট বা চান্নি ঘাট।
আর বুড়িগঙ্গার ধারেই তো ষোল শতকে ঢাকার মুঘল শাসক লালবাগ দুর্গ গড়ে তোলেন। নদী ছিল বলেই ঢাকা হয়ে ওঠে আর্মেনীয়, পর্তুগীজ , ফরাসী, ডাচ আর ব্রিটিশদের লীলাক্ষেত্র। ১৮২০ সালের দিকে সদরঘাটের পূর্বদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অফিস প্রতিষ্ঠা হয়। উত্তরে গড়ে উঠতে নগরী।
আদিতে সদরঘাট থেকে উত্তর দিকে একটি রাস্তার শেষপ্রান্ত ফুলবাড়িয়া গিয়ে ঠেকেছিল, আরেকটি রাস্তা পূব দিক থেকে মানে সূত্রাপুরের দিক থেকে এসে পাটুয়াটুলির কাছে উত্তর-দক্ষিণের রাস্তাটি অতিক্রম করে লালবাগ চলে গিয়েছিল। সদরঘাটের ধারেকাছে ব্রিটিশ শাসনামলে গড়ে ওঠে ওয়াইজ সাহেবের বাড়ি, রূপলাল হাউজ, ইস্ট এন্ড স্কুল ইত্যাদি।
ঘাটটি ব্যবহৃত হতো মসলিন,পাট, চাল আর রেশম পরিবহনের জন্য। সদরঘাটে ভিড়ে থাকা প্যাডেল স্টিমার দেখতে লোক আসত দূর দূর থেকে। ভারতের ইংরেজ ভাইসরয় কলকাতা থেকে ঢাকায় ঢুকতেন সদরঘাট হয়েই। সদরঘাটের 'ভাই বেরাদর' যেমন চাঁদনী ঘাট, সওয়ারি ঘাট, নর্থব্রুক হল ঘাট, মিটফোর্ড ঘাট, বাবুবাজার ঘাট আর বাদামতলী ঘাটও খুজে পাওয়া যায় কাছেপিঠেই। প্রত্যেকেরই আছে মনোহরা সব ইতিহাস।
সদরঘাট এখন
অনেকে সদরঘাটকে বিশ্বেরই অন্যতম ব্যস্ত নদী বন্দর (যাত্রী চলাচলের হিসাব থেকে) ভাবেন। প্রায় ২০০ ছোট-বড় লঞ্চ আর জাহাজ ছেড়ে যায় বা ভেড়ে প্রতিদিন সদরঘাট বন্দরে। মোট ৪৫টি রুটে নৌযান চলাচল করে এখান থেকে। দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাট প্রভৃতি গন্তব্যে লঞ্চ ও স্টিমার ছেড়ে যায় সদরঘাট থেকে। লঞ্চ চলাচলের সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপে জানা যায়, কমপক্ষে দেড় লক্ষ লোক ঘাটটি ব্যবহার করে প্রতিদিন। অবশ্য ঈদ মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লোক এ বন্দর দিয়ে গ্রামের বাড়ি যায়।
নৌযানের ঘণ্টা, কুলিদের চিৎকার, ফেরিওয়ালাদের হাক ডাক আর নৌযান কর্মীদের চেঁচামেচিতে সারাক্ষণ মুখর থাকে। নতুন কোনো লঞ্চ/স্টিমার ভিড়লেই শ্রমিকরা পন্টুন থেকে বারো-চৌদ্দ ফুটও লাফিয়ে সেটির ভিতর ঢুকে পড়ে। যারা নতুন তারা অবাক হয়ে এ দৃশ্য (বানর লাফ বলে পরিচিত) দেখে। এখন সদরঘাটে বরিশালগামী বিলাসবহুল অনেক লঞ্চ দেখা যায়। এর কোনো কোনোটায় নাকি লিফটও আছে! এখনকার বড় লঞ্চগুলো হাজারো যাত্রী বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন।
বাহারি কিছু লঞ্চ যেমন সুন্দরবন, সুগন্ধা, কীর্তনখোলা ইত্যাদি। এখানকার লঞ্চগুলো ঘুরে দেখার জন্য কেবল অনুমতি নিলেই হয়, কোনো টাকা লাগে না। অবশ্য সদরঘাটে ঢুকতে ১০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। সপ্তাহের সাতদিনই এ ঘাট খোলা থাকে। বুড়িগঙ্গায় ভেসে বেড়ানোর জন্য এখান থেকে ছোট ছোট নৌকা ভাড়া করা যায়।
উল্লেখ্য, মালামাল পরিবহনকারী (কয়লা, বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি) নৌযান মানে ট্রলার বা কার্গো ভেসেলের জন্য বিআইডব্লিউটিএ'র ল্যান্ডিং স্টেশন আছে গাবতলী, আমিনবাজার বা আশুলিয়ায়। এগুলোর সদরঘাটে ভেড়ার সুযোগ নেই।
যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে হ্যাচ (লঞ্চের ডেকের যে ফাঁক দিয়ে মালামাল ওঠানো নামানো যায়) কাভার থাকে। তাতে মাছ, জামাকাপড়ের গাইট, কালার শিট, আলমিরা, ফ্রিজ, বাইসাইকেল ইত্যাদি পরিবহনের সুযোগ থাকে। তার জন্য ঘাট লেবারদের বহনজনিত মজুরি নির্ধারিত আছে।
সরেজমিন ২৮ ফেব্রুয়ারি
সদরঘাটে দিনের প্রথম লঞ্চ ভেড়ে রাত সাড়ে তিনটায়। তারপর ভিড়তেই থাকে, তবে সকাল সাতটার পর গতি কিছু ধীর হয়। সদরঘাটের মূল ভবনের উল্টোদিকে চার-পাঁচটি হোটেল- পারজোয়ার, বরিশাল ক্যাফে ইত্যাদি। এসব হোটেলে ২৮-৩০ জন কর্মী কাজ করেন। ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। এদের দৈনিক খরচ ( কর্মী বেতন, ঘর ভাড়া, বিদ্যু. পানি, গ্যাস, চাঁদা ইত্যাদি তবে বাজারখরচ আলাদা ) ২০-৩০ হাজার টাকা প্রায়। ভাত, মাছ, গোশত, বিরিয়ানি, তেহারি, পরোটা- গ্রিল, নান-বট ইত্যাদি অনেক রকম খাবার তৈরি হয়। দুই-আড়াই বস্তা চাউলও কোনো কোনোদিন শেষ হয়ে যায়।
সদরঘাটে স্থায়ী তিনটি ভবন এখন, গায়ে গা লাগানো। মাঝখানেরটি আইয়ুব খানের আমলে তৈরি হয়েছিল, পূব দিকেরটি এরশাদ সরকারের আমলে আর পশ্চিমেরটি বর্তমান সরকারের আমলে। নীচতলা ও দোতলায় যাত্রীদের বিশ্রামাগারগুলো পরিচ্ছন্ন। নীচতলায় লঞ্চ মালিক সমিতির কার্যালয় আছে। মালপত্র স্তূপ করার শেড আছে, কর্নফুলী রিভার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের শাখা অফিস আছে, দুইতলায় মসজিদ আছে। ভিআইপি গেট আছে আলাদা, আছে ভিআইপি বিশ্রামাগারও। আনসার ক্যাম্প আছে, নৌ পুলিশ কার্যালয় আছে। ব্যাংক আছে একটি।
বিআইডব্লিউটিএ'র ট্রাফিক জরিপ ও নৌ নিরাপত্তা কার্যালয় আছে। ঘাটে লেবার বা কুলি আছে প্রায় ৫০০। একজন যেমন আলাউদ্দিন মোড়ল (ছদ্মনাম)। বয়স ষাটের ধারে কাছে হবে। বাড়ি ঝালকাঠি। আট বছর বয়সে সদরঘাট চলে এসেছিলেন কাঠ বডি লঞ্চে চড়ে। তখন স্টিল বডির লঞ্চ খুব কম ছিল। তবু তিনি এমভি পিন্টু খানের কথা মনে করতে পারলেন। বাবা মারা গিয়েছিল, তাঁর জন্মের আগেই; আর মায়ের মৃত্যু জন্মের নয় মাস পর। তাই একটু 'ডাঙ্গর' হতেই নদী পাড়ি দিয়ে চলে আসেন সদরঘাট।
বলছিলেন, ঘাটেই ঘুমাতাম। ছোট মানুষ ছিলাম, চাইলেও কিছু না কিছু পেতাম। তবে দিনকয় পর থেকে হকার্স মার্কেটের ভিতরের এক হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতাম। সদরঘাটে সে আমলে সাত্তার খানদের কয়েকটা লঞ্চ ছিল। ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-বরগুনা, ঢাকা-পটুয়াখালি -এমন কয়েকটা মাত্র রুট ছিল। আর সরকারি ওই রকেট যেত খুলনা পর্যন্ত। তবে মনে হয় হাতিয়া রুটটাও ছিল। "এখন দেখেন কালাইয়া, উলানিয়া, শৌলা, হুলারহাট, ডামুড্যা, পাতারহাট, মুলাদী –রুটের শ্যাষ আছে? প্রতিটা কোম্পানির লঞ্চ আছে ৮-১০টা, আবার বেশিও। আমার মনে হয়, দেড় লাখেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন এই ঘাট ব্যবহার করে।"
আলাউদ্দিন জানালেন, তখন বড় বড় গস্তি নৌকা ছিল, গুন টেনে চলত সেগুলো, ওইসব নৌকায় মালামাল বহন করা হতো। দক্ষিণাঞ্চলে রাজশাহীর আম যেত ওইসব নৌকায় করে। আবার বরিশাল অঞ্চল থেকে আসত সুপারি, কার্তিক নাজিরশাইল।
আলাউদ্দিনের কাছ থেকেই জানা গেল, সে আমলে মোটে ৫-৬টা পন্টুন ছিল ঘাটে। এখন ১৬টি তিনি গুনে গুনে বার করলেন। ২০২০ সালে ঘাটে নতুন নতুন পন্টুন লেগেছে। মোটা মোটা শেকল দিয়ে বাধা থামের সঙ্গে। প্রতিটি পন্টুনেই আছে ভারী ভারী কিছু নোঙর। পন্টুনগুলো তৈরি করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড।
মালপত্র শেডের কাছেই লেবারদের মজুরির তালিকা দেওয়া আছে। যেমন স্টিল আলমিরা বা খাট রাস্তা থেকে লঞ্চ পর্যন্ত নিতে ১১৫ টাকা গুনতে হবে। ফ্রিজ আর টেলিভিশনের জন্য গুনতে হবে ৫৮ টাকা। এছাড়া ১০ কেজি, ২০ কেজি প্রতিটি বস্তার জন্য আলাদা আলাদা মজুরি ধার্য করা আছে। পিঠে, কাঁধে আর মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়াভেদেও ভাড়া কমবেশি হয়।
তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে লঞ্চগুলোয় যাত্রী- ভাড়া বৃদ্ধি করা হচ্ছে মার্চের মাঝামাঝি থেকে। তারও একটি তালিকা লাগানো আছে। সেখান থেকে জানা গেল ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা আর ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব হলে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৩০ বা ৪০ পয়সা। ডেক শ্রেণির ভাড়া থেকে প্রথম শ্রেণির ভাড়া চারগুণ নির্ধারণ করা হচ্ছে।
একজন কান পরিস্কারকের দেখাও পেলাম যার ওস্তাদ ছিলেন মির্জা বখশ। তিন বছর লেগে থেকে তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখেছেন সবুজ মিয়া। কাঁধে ছোট্ট চামড়ার ব্যাগে অনেককটি শিশি। জানতে চাইলাম, এখনো চলতে পারছেন?
উত্তর: হ্যা আল্লাহ ভালোই চালায়া নিতেছে।
বললাম, এখনকার সদরঘাট কেমন লাগে?
উত্তর: সদরঘাটের উন্নতি হইল তো বছর কয় হয়। আগের সদরঘাটের সঙ্গে এখনকার অনেক ফারাক। আগে সারাদিনে বেশি লঞ্চ তো ছাড়ত না। সন্ধ্যাতেই যা ছাড়ত, আর সকালে এসে ভিড়ত। এখন বরিশালের শেষ লঞ্চ ছাড়ে রাত সাড়ে নয়টায় আর চাঁদপুরের সাড়ে ১২টায়। দুপুর বেলাও লঞ্চ ছাড়ে। কী বুঝলেন তাইলে?
সদরঘাট আলাদাই। অন্য অনেক জায়গা থেকেই আলাদা সদরঘাট। মানুষজন স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ায়, কেউ চলেছে হাড়ি পাতিল নিয়ে, কেউ হাঁসমুরগি নিয়ে। ফুল ওঠানো ফ্রক গায়ের ছোট ছোট মেয়েও দেখলাম লুঙ্গি পরা বাবার সঙ্গে সানগ্লাস চোখে ঘুরছে। পাগল আছে বেশ কয়জন, বয়স্ক যেমন- আছে কমবয়সীও। লেবাররা লাল ও নীল পোশাক পরে। সাদা পোশাকের বিআইডব্লিউটিএ কর্মী দেখলাম কয়েকজন।
পন্টুনগুলোর গায়েও নাম লেগেছে- গলাচিপা, বরগুনা বা বেতাগী। মানে ওই নামের পন্টুন থেকে ওই রুটের লঞ্চ ছাড়ে। পশ্চিমে ওয়াইজঘাট থেকে পূবে প্রায় শ্যামবাজার মসজিদ পর্যন্ত সবগুলো পন্টুন মিলিয়ে দেড় কিলোমিটার হয়ে যাবে ঘাটের দৈর্ঘ্য।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল
উপরোক্ত নামেই ফেসবুকে একটি পেইজ আছে। প্রায় আট হাজার লাইক আছে পেইজটিতে। ফলোও করে সমানসংখ্যক লোক। এযাবৎ নব্বই হাজার লোক পেইজটিতে চেইক ইন করেছে। এখানে বন্দর সম্পর্কিত সংবাদ রাখা আছে। এ পেইজ থেকে সদরঘাটের পাঁচটি বড় লঞ্চের খবর মিলল। পঞ্চম বড়টির নাম কীর্তনখোলা ৩০০ ফুট লম্বা, ৫৬ ফুট প্রস্থ। চতুর্থ নাম সুরভি-৯; ৩০৩ ফুট লম্বা আর ৫৭ ফুট প্রস্থ। তৃতীয় বড়টির নাম সুন্দরবন ১০; ৩০৫ ফুট লম্বা প্রস্থ ৫৬ ফুট। দ্বিতীয় বড়টির নাম পারাবত ১২; লম্বায় ৩০৮ ফুট আর প্রস্থে ৫৭ ফুট। আর সবচেয়ে বড়টির নাম কীর্তনখোলা- ১০; এটি লম্বায় ৩১৫ ফু্ট। সদরঘাট লঞ্চ গ্রুপ বলেও একটি পাতা আছে। আছে লঞ্চ স্পটার্স গ্রুপও।
শেষ কথা
বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০১৪ সালে 'লাইফ অন আ ডেথ রিভার ইন বাংলাদেশ' নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিল। সেখানে জামিল শরিফ নামের এক পরিবেশকর্মীর উদ্ধৃতি আছে। সেটি এমন- বুড়িগঙ্গা জীবন দিয়েছে ঢাকাকে, আর ঢাকা নদীটাকে মারল। সদরঘাট নিয়েও লোকজনের কষ্ট কম নেই- জায়গাটা অপরিচ্ছন্ন, কোনো শৃংখলা নেই, শ্রমিকদের কাছে পাবলিক এখানে জিম্মি–ইত্যাদি। তবে গত কয়েক বছরে সদরঘাট আগের চেয়ে কিছুটা সুন্দর হয়েছে। কিন্তু নদীটা মানে বুড়িগঙ্গা? সব কথার শেষ কথা তো এই, যদি নদীটা না বাঁচে- তবে ঘাট সুন্দর হলেই বা কী যায় আসে!
বিশেষ দ্রষ্টব্য
ঢাকা-তালতলা রুটে এখন আর লঞ্চ চলে না। আব্দুল্লাপুরে আর লঞ্চঘাটও নেই। কারণটা পরিস্কার, শুকনো মৌসুমে ধলেশ্বরীকে এতো শীর্ণা দেখায় যে সুতা বলেই ভ্রম হয়।