ঢাকার কবুতরের হাটের খোঁজে…
কবুতর পুষতে ভালোবাসেন যারা তাদের জন্য ঢাকার মেরাদিয়া হাট এক বিশেষ আকর্ষণের জায়গা। রাজধানীর বনশ্রীতে মেরাদিয়া কাঁচাবাজারের পাশে প্রতি সপ্তাহের বুধবার বসে এই হাট। জনশ্রুতি আছে, এই হাটের বয়স কয়েক শত বছর। মেরাদিয়ার হাটে পোষা কবুতরের কেনাবেচাও চলছে অনেক বছর ধরেই।
ঢাকার অন্যতম এই হাটের খোঁজে আমরা গিয়েছিলাম বনশ্রীর মেরাদিয়া বাজারে। শাহবাগ থেকে তরঙ্গ প্লাস বাসে করে সরাসরি মেরাদিয়া বাজারে নেমেই রামপুরা খালের পাশ ঘেঁষে বিখ্যাত মেরাদিয়া হাটের দেখা পেয়েছিলাম। রাস্তার পাশেই সাজিয়ে রাখা টাটকা ফলমূল, শাকসবজি, নানা ধরনের ভাজাপোড়া, জামা-কাপড়, খেলনা সামগ্রীর দোকানে মানুষের ভিড় দেখে দূর থেকেই হাটের আমেজ টের পাওয়া যায়।
নানা ধরনের আকর্ষণীয় সামগ্রী ও খাবারদাবারের মায়া কাটিয়ে আমরা খুঁজতে চললাম কবুতরের হাট। আশেপাশে কোথাও চোখে না পড়ায় একজন ফল বিক্রেতার কাছে চাইলাম পোষা কবুতরের হাটের সন্ধান। তিনি দেখিয়ে দিলেন সোজা গিয়ে ডানের গলিতে যেতে। ডানে গিয়েও কবুতরের দেখা পেলাম না, আবার একজন বললেন সোজা গিয়ে বামে যেতে। সে অনুযায়ী এগিয়ে আরো কিছুক্ষণ ডানে-বামের রাস্তা ঘুরে খুঁজে পেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই হাট।
মেরাদিয়ার অদূরেই দোতলা মসজিদের পেছনের রোডের এক মাঠে ডোবার পাশে বসেছিল এ সপ্তাহের কবুতরের হাট। বেলা ১২টার দিকে মাথার উপর তপ্ত সূর্যের পাশাপাশি গমগম করছিল হাটের পরিবেশও। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে জমজমাট পরিবেশ।
হাটে ঢোকার মুখেই দেখা হয় ডেমরা থেকে আগত বিক্রেতা মান্নানের সঙ্গে। দুই খাঁচা কবুতর নিয়ে বেশ উৎফুল্ল হালে বসে দরদাম করছিলেন। তার খাঁচায় থাকা কবুতরগুলোর মধ্যে ছিল দেশি গোলা, চীনা গিরিবাজ। দেশী গোলা কবুতর এক জোড়ার দাম হেঁকেছিলেন ৮০০ টাকা। আর গিরিবাজের দাম এক জোড়া ১৫০০ টাকা। তবে আমাদের সামনেই একজন দরদাম করে এক জোড়া গিরিবাজ কিনলেন ৪০০ টাকায়!
লোকটিকে দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি কবুতর বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম তার সাথে কথা বলতে। নাম জিজ্ঞেস করায় নিজের পরিচয় দিলেন 'বিল্ডিং দুলাল' নামে। মাদারটেকের অধিবাসী দুলাল বলেন, "প্রতি সপ্তাহেই ঢাকায় মেরাদিয়া, সারুলিয়া, তারাবো, গুলিস্তান নানা হাট ঘুরে কবুতর কিনি আমি। আমার কাছে বর্তমানে কবুতর আছে ২০ জোড়া।" নানা জাতের কবুতর সংগ্রহ করে বিক্রি করেন তিনি।
কবুতর বিক্রেতা মান্নান জানান তিনি ডেমরা থেকে কয়েক বছর যাবত নিয়মিত আসছেন মেরাদিয়া হাটে কবুতর বিক্রি করতে। ঢাকা ও আশেপাশের নানা হাট থেকে কবুতর কিনে এনে বিক্রি করেন তিনি। এই হাটে কবুতর নিয়ে বসতে খাঁচাপ্রতি ১০০ টাকা খাজনা দিতে হয় তাকে।
"প্রতি হাটবারে ২০-৩০টা কবুতর বেচতে পারি এখানে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাট বসলেও দুপুরের সময় সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে," বলেন মান্নান।
মান্নানের পাশে বসেই হাট থেকে কবুতর কিনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিদ্রযুক্ত বিশেষ ধরনের ব্যাগ বানাচ্ছিলেন মোঃ কামাল হোসেন। প্রায় ১২ বছর ধরে মেরাদিয়ার হাটে কবুতর পোষার জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস বিক্রি করেন তিনি। কবুতরের খাবার-পানি দেয়ার বাটি, খাঁচার ভেতরে রাখার দোলনা, পায়ে পরানোর চুড়ি, প্রয়োজনীয় ঔষধ, প্লাস্টিকের ডিম (কবুতর ডিম না পারলে এই প্লাস্টিকের ডিম কবুতরের পাত্রে রাখা হয়, যার কারণে ডিম পাড়ায় অগ্রগতি হয়), গম-ভুট্টাসহ সব ধরনের খাবার পাওয়া যায় তার কাছে।
কামাল বলেন, 'আগে হাটবারে বেশ ভালো বিক্রি হত আমার। কিন্তু করোনায় কয়েকদিন পরপর লকডাউনে বন্ধ থাকার কারণে হাটের জায়গা দখল হয়ে যায়। মেরাদিয়া বাজারের পাশে জায়গা না পেয়ে এরপর থেকে একেক সপ্তাহে এলাকার একেক জায়গায় বসতে হয় আমাদের। এই কারণে দূরদূরান্ত থেকে আসা খদ্দেররা অনেক সময় হাট খুঁজে পায় না। তাই বিক্রিও কম হয় কিছুটা।' জায়গা নিয়ে এই সংকট চলতে থাকলে একসময় এই হাট বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকায় আছেন কামাল হোসেন।
কিছুদূর এগোতেই দেখা হলো মেরাদিয়া মধ্যপাড়ার অধিবাসী মোঃ আল আমিন শেখের সাথে। সম্প্রতি এইচএসসি পাশ আল-আমিন জানান, তিনি দশ বছর বয়স থেকে এই হাটে কবুতর বিক্রি করতে আসেন। সাতটি লাহোরি কবুতর নিয়ে এবারের হাটে এসেছেন তিনি। প্রতি জোড়ার দাম হাঁকছেন ৪০০০ টাকা। তবে কেউ ২২০০ টাকা পর্যন্ত দাম দিলে বিক্রি করে দেবেন। তার কাছে থাকা সব কবুতর নিজের বাসায় পোষা। তাই লাভটা বেশ ভালোই হয় আল-আমিনের। বর্তমানে তার বাসায় ৩০ জোড়া কবুতর আছে। কবুতরের লালন-পালন বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ আল আমিন। ছোটবেলা থেকেই বাসার ছাদে কবুতর পোষায় কবুতরের সব সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কেও ভালো জানেন তিনি।
কবুতরের দাম মূলত নির্ভর করে এর জাত ও দুষ্প্রাপ্যতার উপর। আল আমিন জানান সাড়ে তিন বছর আগে এই হাটে তিনি এক জোড়া চিলা চুইঠাল বিক্রি হতে দেখেছেন দেড় লাখ টাকায়। কিন্তু এখন এই চিলা চুইঠালের জোড়া সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শুরুতে কয়েকজন দুষ্প্রাপ্য জাতের কবুতরগুলো কিনে এগুলোর ব্রিডিং করে উৎপাদন বাড়ায়। ফলে সহজেই কম দামে কবুতরগুলো পাওয়া যায়।
হাটের আরেকপ্রান্তে দেখা হয় খুদে কবুতর বিক্রেতা জোহা ইসলাম সামিনের সাথে। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সামিন। এক জোড়া কাগজি কবুতর বিক্রি করতে হাটে এসেছে সে। সামিন বলে, "ডিসেম্বর মাসে এই হাট থেকেই ১৫০০ টাকা দিয়ে কবুতরের জোড়াটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। কবুতর আর পাখি আমার অনেক পছন্দ। কিন্তু এখন বাসায় জায়গা না হওয়ায় বিক্রি করে দিতে এসেছি। ২০০০ টাকা দাম চাচ্ছি, কিন্তু দেখি কে কততে নিতে চায়!"
রামপুরা থেকে হাটে কবুতর কিনতে আসা রিপনকে দেখে মনে হলো তিনি কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, "আমি ঘণ্টাখানেক ধরে কবুতর দেখছি, দরদামও করেছি। কিন্তু শিওর হতে পারছি না কবুতরগুলো সব সুস্থ পাব কি না। একবার দেখে আসলে কবুতরের সুস্থতা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। গত শীতে হাট থেকে নতুন কবুতর কিনে বাসার পুরোনো কবুতরের সাথে রাখায় আমার প্রায় ২০টার মতো কবুতর রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এজন্য কবুতরের সুস্থতা নিশ্চিত না হয়ে কেনা উচিৎ না।"
অন্যদিকে আল আমিন জানান, গত বছর তার কোনো কবুতর মারা যায়নি। তিনি কবুতরের পরিচর্যায় বিশেষ যত্নশীল থাকেন। তিনি বলেন, "নতুন কবুতর কিনে আনার পর সপ্তাহখানেক সেই কবুতরকে আলাদা করে 'কোয়ারেন্টাইন'-এ রেখে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। নাহলে সেই কবুতর যদি কোনো রোগ বহন করে তবে তা অন্যান্য কবুতরের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে অনেক কবুতর মারা যেতে পারে।"
মেরাদিয়ার এই কবুতরের হাটে কবুতর ছাড়াও নানা ধরনের পাখি নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। রঙ-বেরঙের বাজিগর ছাড়াও আছে ফিঞ্চ পাখি, ঘুঘু, টিয়া ইত্যাদি পাখি। পাখি বিক্রেতা অভির সাথে কথা বলে জানা যায় একই জাতের পাখিই নানা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে। যেমন বাজিগর পাখির জোড়া ৬০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার ফিঞ্চ পাখির দামও তিনি হাঁকেন জোড়া ৬০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে আশেপাশের অভিজ্ঞ ক্রেতাদের দেখে বোঝা যায় দামাদামি করে বেশ সুলভ মূল্যেই পাওয়া যায় এসব পাখি।
দেশি-বিদেশি সব ধরনের কবুতর পাওয়া যায় মেরাদিয়ার হাটে। গোলা, গিরিবাজ, কাগজি, সিরাজী, লাহোরি, পাংক্ষি ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় জাতের কবুতর। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মেরাদিয়ার চেয়েও বড় কবুতরের হাট বসলেও সময়ের ঐতিহ্যের কারণে মেরাদিয়ার কবুতরের হাট বেশ জনপ্রিয়। প্রতি বুধবারেই বনশ্রী-রামপুরা এলাকা ছাড়াও নাসিরাবাদ, বাড্ডা, মুগদা, ডেমরা, সারুলিয়া প্রভৃতি নানা স্থান থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতার সমাগম হয় হাটে। তবে কবুতরের হাট বসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় বনশ্রীর বিভিন্ন ব্লকের রাস্তার পাশে হাট বসাতে হয় প্রায়ই। যে কারণে প্রতি সপ্তাহেই হাটের বিক্রেতাদের চিন্তায় থাকতে হয় লাভ-লোকসান নিয়ে।