ডোঙায় যাতায়াত, ডোঙায় মাছ ধরা, সপ্তাহে দুই দিন ডোঙা বেচাকেনা
নড়াইল-যশোর মহাসড়কের পাশের ঢালে বড়সড় এক রেইনট্রি গাছের নিচে বসেছে অর্ধশতবর্ষী জমজমাট হাট। নড়াইলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কারিগরেরা এসেছেন ডিঙি নৌকার চেয়েও ছোট আকৃতির লম্বাটে এক জলের বাহন নিয়ে। বড়জোর দুই-তিনজনের ভার বহনের উপযোগী এই বাহনের স্থানীয় নাম 'ডোঙা'।
শেষ মুহূর্তের আঁচড় দিয়ে তালগাছের তৈরি ডোঙাগুলোকে নিখুঁত করে তুলতে ব্যস্ত কারিগরেরা। শরতের অকাল বৃষ্টিতে হাটে ক্রেতার ভিড় কিছুটা কম হলেও বিক্রির মৌসুম ফুরিয়ে যায়নি বলে আশান্বিত তারা। প্রতি সপ্তাহের সোম আর শুক্রবারে জেলার সবচেয়ে বড় ডোঙার হাট বসে সদর উপজেলার তুলারামপুর বাজারে।
সকাল সাতটা থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলে দুপুর পর্যন্ত। সকাল থেকেই বিক্রেতারা হাটে নিজেদের তৈরি ডোঙা নিয়ে জড়ো হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে ক্রেতাও। দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার বচসায় মুখর থাকে পুরো হাট। তাছাড়া মূল সড়কের পাশেই হাটের অবস্থান হওয়ায় ক্রেতার পাশাপাশি ভ্যানচালকেরাও সকাল থেকে হাটে ভীড় জমান। ক্রেতার কেনা ডোঙা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই সকাল সকাল হাজির হন তারা।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ তালগাছের এই ডোঙা। স্রোতহীন কম গভীর জলে পারাপার, মাছ ধরা, শাপলা তোলা, ধান-পাট কাটা, শামুক সংগ্রহে স্থানীয়দের সহজ আর সুলভ বাহন এটি। ছোট কোনো বাঁশকে বৈঠা হিসেবে নিয়ে ডোঙায় করে খাল-বিল বা ছোট নদীর উপর ভাসতে দেখা যায় এলাকার শিশুদেরও।
সদর উপজেলার চর শালিখা গ্রাম থেকে নিজের বানানো ডোঙা নিয়ে তুলারামপুরের হাটে এসেছেন সত্তোরোর্ধ্ব হোসেন আলী। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির আশেপাশে এলাকাবাসীকে ডোঙা বানাতে দেখেছেন তিনি। বন্ধুদের নিয়ে বর্ষাকালে বিলের পানিতে ডোঙা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর ছোট মাছ ধরার স্মৃতিচারণ করে বললেন, 'আমাদের নড়াইলের ঐতিহ্য এই জিনিস। একসময় সবার ঘরে ঘরে একটা কইরা থাকত ডোঙা। বাপের কাছ থেকে শিখছিলাম ডোঙা বানানো। বাপে শিখছিলো দাদার কাছ থেকে। চল্লিশ বছর ধইরা এই ব্যবসা করতেছি আমি। শুকনা মৌসুমে ক্ষেত-খামার করি আর বর্ষায় ডোঙা বানায়ে নিয়া আসি হাটে। আগের দিনের চেয়ে চাহিদা কমলেও এহনো দূর-দূরান্ত থেইকা মানুষ আসে আমাদের ডোঙা কিনতে।'
সারিবেঁধে সাজিয়ে রাখা ডোঙা গুলোর একেকটির মাথা দেখতে একেক রকম। নকশাগুলোর বিশেষত্ব জানতে চাইলে আরেক ব্যবসায়ী শিহাব উদ্দিন বললেন, 'একেকটি মাছের মাথার মতো নকশায় সাজানো ডোঙার মাথাগুলো। মাছের নামেই নাম এগুলোর। যেমন: মাগুর মাছ সদৃশ ডোঙার মাথার নাম মজগুর মাথা, কোনোটা আবার শোল মাথা, কোনোটা কাইল্লে মাথা। আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই নামগুলো প্রচলিত।'
দুটি ডোঙা বানাতে পুরো একদিন সময় ব্যয় হয় চার জন কারিগরের। কমপক্ষে ২০-৩০ বছর বয়সী তালগাছগুলো ডোঙা বানানোর উপযোগী বলে ধরা হয়। এক-একটি তালগাছের দাম হয় ছয় থেকে আট হাজার টাকা। প্রতিটি তালগাছকে মাঝামাঝি দুইভাগ করে তৈরি হয় দুটি ডোঙা। তালগাছের মাঝের নরম অংশ বাদ দিয়ে শক্ত খোলস দিয়ে গড়া হয় এই বাহন। তৈরির পর ঘষে ঘষে মসৃণ করা হয় ডোঙার ভেতর এবং বাইরের অংশ। সাধারণ নৌকার মতো বাইরের অংশে কোনো আলকাতরা বা রঙ ব্যবহার করা হয় না ডোঙায়। নৌকার তুলনায় দামে কম আর সহজে বহনযোগ্য বলেই মূলত এই অঞ্চলে সমাদৃত ডোঙা।
মালিডাঙ্গা গ্রামের রেজাউল হক মৃধা মেয়ের জামাইকে নিয়ে এসেছেন ডোঙা কিনতে। অন্যসময় নিজের জন্য ডোঙা তৈরি করলেও মেয়ের জামাইকে হাটে নিয়ে এসেছেন ডোঙা কিনে দেওয়ার জন্য। রেজাউল বলেন, 'বর্ষাকালেই ডোঙা মানুষ বেশি কিনে। জামাইকে দেওয়ার জন্যি একটা ডোঙা পছন্দ হইছে। দাম চাইছে ৮ হাজার টাকা। আমি এখনো দাম কইনি। ভাবতেছি কত কওয়া যায়।'
বর্ষার শেষে ডোঙা ভালো রাখার জন্য সেটিকে পানিতে ডুবিয়ে রাখার পরামর্শ দেন কারিগররা। গাছের বয়স, মান ও আকৃতির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়ে থাকে ডোঙার দাম। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে এগুলোর দাম।
ডোঙা কিনতে হাটে এসেছেন সদর উপজেলার হাতিয়ারা গ্রামের ৭৩ বছর বয়সী নিখিল গোস্বামী। মূলত, মাছ ধরার জন্য এবং ধান-চাল বহন করার জন্য তিনি ব্যবহার করেন এটি। নিখিল বলেন, 'ডোঙার আয়ু নির্ভর করে গাছের সারের উপর। গাছের সার আছে কি না চেনার উপায় হইলো ডোঙার গায়ে কালো দাগ থাকা। কালো দাগ থাকলে সে ডোঙার দামও বেশি হয় আর টিকেও বেশিদিন।'
মূলত সার ও অসার গাছের উপর ভিত্তি করেই ডোঙ্গার দাম উঠা-নামা করে। সার আছে এমন তালগাছের দাম অসার তালগাছের তুলনায় বেশি হয়। অসার তালগাছের দাম কম বিধায় ডোঙ্গার দামও কম হয়।
'তাল গাছে যদি সার হয় তাহলে ডোঙা ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। অসার গাছ দিয়ে তৈরি ডোঙা ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। দামও থাকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার ভেতরে। ছেলেপেলেরা এই ধরনের ডোঙা ব্যবহার করে,' বলেন নিখিল গোস্বামী।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সকাল সকাল সাতক্ষীরা থেকে তুলারামপুরের হাটে ডোঙা কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়া। তার চিংড়ির ঘেরে খাবার দিতে ব্যবহৃত হয় এই ডোঙা। হাটে ঘুরে বেশ কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে দরদাম করে অবশেষে ছয় হাজার টাকায় মাঝারি আকারের একটি ডোঙা পছন্দ করলেন তিনি। সিরাজ জানান, 'নয় হাজার টাকা দাম চেয়েছিল এটার। দরদাম জানা আর অভিজ্ঞতা আছে বলে কমে নিতে পারলাম। প্রায়ই এই হাট থেকে ডোঙা কিনতে আসে আমাদের এলাকার মানুষজন।'
নড়াইল অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে তালগাছের আধিক্যের জন্যই মূলত এদিকে ডোঙার প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নড়াইল জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সোলায়মান হোসেন। নড়াইল সদরের চর শালিখা, রামসিদ্ধি ও লোহাগড়ার উপজেলার কিছু গ্রামে অধিকাংশ ডোঙা তৈরি হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
হাটের ইজারাদার গফফার হোসেন জানান, নড়াইলের বাইরে সাতক্ষীরা ছাড়াও যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, গোপালগঞ্জ থেকে ক্রেতারা আসেন এই হাটে ডোঙা কিনতে। বর্ষাই মূলত ডোঙা বিক্রির মৌসুম।
'বৃষ্টি-বাদলা বেশি হলে, খাল-বিলে পানি আসলে ডোঙা বিক্রি হয় বেশি। এবার বর্ষায় বেশি বৃষ্টি না হওয়ায় মৌসুমেও খুব একটা বিক্রি-বাট্টা হয় নি। সাধারণত আষাঢ় মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন পর্যন্ত জলাশয়ে ভালো পানি হলে দিনে এক-দেড়শো ডোঙাও বিক্রি হয় এই হাটে,' বলেন গফফার হোসেন।
তুলারামপুর বাজার ছাড়াও নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ী গ্রামে বসে ঐতিহ্যবাহী এই ডোঙার হাট। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাল-বিলে পানি কমে যাওয়া, তালগাছের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানান কারণে ডোঙা তৈরিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন স্থানীয় কারিগরেরা।