অন্য দম্পতিকে দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়া থেকে যেভাবে কাটিয়ে উঠবেন
প্রায়ই আমার ক্লায়েন্টরা তাদের বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে নিজেদের রোমান্টিক সম্পর্কের তুলনা করেন। কাপল থেরাপিস্ট হিসেবে এসব কথা আমার প্রায়ই শুনতে হয়। কেউ কেউ তাদের নিজের সঙ্গী কত ভালো, সেটা বুঝাতে তুলনা করেন। কিন্তু সিংহভাগের তুলনাই হয় অতৃপ্তি নিয়ে। আরও আকর্ষণীয়, সংবেদনশীল, রসিক, স্মার্ট বা ধনী কারও সঙ্গে থাকলে সুখী হতাম, এটাই হয় সিংহভাগের মানসিকতা। তারা ভাবে, বর্তমান সঙ্গীর সাথে থেকে আমি কি কিছু মিস করে যাচ্ছি? রোমান্টিক জীবন থেকে কি এরচেয়ে বেশি কিছু পাব না? এতটুকুই?
তুলনা করাটা খারাপ কিছু না। এটি মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু অন্য কোনো দম্পতিকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেওয়ার সময় কিন্তু আমরা সবকিছু আমলে নেই না। তাদের সম্পর্কের একঘেঁয়েমি, বিরক্তি ও অসন্তোষের ব্যাপারগুলো সাধারণত আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। কে বেশি ঝগড়া করে, তার ওপর দাম্পত্যের সুখ-দুঃখ নির্ভর করে না। বরং পারস্পরিক দ্বন্দ্বসহ দাম্পত্য জীবনের অন্যান্য বোঝাপড়া নিয়ে কে কীভাবে চিন্তা করছে ও জানাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে সুখ-দুঃখ।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইমেরিটাস জন গটম্যান এক গবেষণায় দেখেছেন, বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে থাকা ৬৯ শতাংশ সমস্যার সমাধান কখনোই হয় না। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, পারস্পরিক যোগাযোগ, অর্থ, সন্তানের দেখভাল ও বাড়ির কাজের বিভাজন নিয়েই সবচেয়ে বেশি ঝগড়া বাঁধে দম্পতিদের মাঝে।
এছাড়া, আরেকটি সমস্যা দেখা দেয় যৌন জীবনের অতৃপ্তি নিয়ে। অন্য দম্পতিরা ভালো যৌনক্রিয়া করছে—আরও বেশি সময় বা বেশি উত্তেজনাপূর্ণ যৌনক্রিয়া করছে—এই ধারণাটিও স্বাভাবিক।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী পেপার শোয়ার্টজ বলেন, "প্রেমের প্রথম বছরটিই আসলে সম্পর্কের সবচেয়ে আবেদনময় সময়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই আবেদন কমতে থাকে। কয়েকদিনে একবার, সপ্তাহে একবার, এভাবে অনিয়মিত হতে থাকে বিষয়টি।"
শোয়ার্টজ আরও বলেন, অন্যদের যৌন জীবন সম্পর্কে অবাস্তব ধারণা থাকে অনেকেরই। তারা এসব মনগড়া অনুমান থেকে সঙ্গীকে বিচার করতে থাকে।
"অন্যদের এই এই আছে, আমাদের নেই; এমন চিন্তাভাবনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে অনেক দম্পতি। কিন্তু এটা কখনোই স্বাস্থ্যকর আলোচনা না," যোগ করেন শোয়ার্টজ।
সামাজিক তুলনাই সাধারণত আমাদের অসুখী করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের দেখে ঈর্ষণীয় মনে হয়, তাদের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে থাকলে একজন ব্যক্তির আত্মসম্মান কমতে শুরু করে। যারা বিশ্বাস করে অন্যদের তুলনায় তাদের অবস্থা খারাপ, তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যে যেমন এই চিন্তার প্রভাব পড়ে, তেমনি প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যেও। হতাশাসহ সামাজিক উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তাদের মাঝে।
একইভাবে, অন্যদের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের তুলনা করলেও সম্পর্কে অশান্তি দেখা দিতে শুরু করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রায়শই নিজেদের অন্যান্য দম্পতির সঙ্গে তুলনা করে; তাদের সম্পর্কে সন্তুষ্টি, বিশ্বাস ও অনুভূতি কমে যেতে শুরু করে।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দু একে 'অবস্থানগত যন্ত্রণা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, আমাদের কাছে কী আছে বা নেই, সেটার উপর কষ্ট বা যন্ত্রণা নির্ভর করে না। নির্ভর করে অন্যদের তুলনায় কী আছে বা নেই, তার ওপর। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি যারা বিশ্বাস করে, এরচেয়ে ভালো কাউকে পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে তাদের। যে কারণে সঙ্গীর ভালো দিকগুলো উপেক্ষা করে যায় তারা।
আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, সবার তুলনা একরকম হয় না। কোনো সুখী দম্পতিকে দেখে কারো মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগে ('আমরাও চাইলে তাদের মতো হতে পারি!'), আবার কারো মধ্যে জাগে হতাশা ('আমরা কখনই এমন হতে পারব না, আমাদের ব্রেকআপ করে ফেলা উচিত!')।
আবার এর উল্টোটাও হয়। সমস্যা আছে এমন কোনো দম্পতিকে দেখে আপনার মনে হতে পারে, আমাদের সম্পর্ক যেন এমন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার একই দম্পতিকে দেখে আরেকজন এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে, তাদের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে।
মারিয়ান মরি এবং তামারা সুচারিনা তাদের এক গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন, "কী নিয়ে তুলনা চলছে, তার উপর সম্পর্কের অবস্থা নির্ভর করে না সবসময়। বরং এই তুলনা কীভাবে করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে।"
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যদের তুলনায় নিজেদের সম্পর্ক কতটুকু ভালো, এভাবে চিন্তা করলে যেকোনো দম্পতির স্ব-মূল্যায়নগুলো আরও ইতিবাচক হয়ে ওঠে। এর মানে এই না যে সবসময় অসুখী কাপলদের আশেপাশে থাকতে হবে আপনার। কিংবা বাকিদের চেয়ে আপনারা কিসে কিসে ভালো, তার চেকলিস্ট তৈরি করে বসতে হবে। কথা হচ্ছে, আমাদের চেয়ে ভালো ও খারাপ, উভয় রকম দম্পতিদের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে পারি আমরা।
বাইরে থেকে কখনোই অন্যদের সম্পর্ক ঠিকভাবে বুঝতে পারব না, ঈর্ষার ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এই জ্ঞানটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। অন্যদের দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গীকে মাপার চেয়ে নিজেদের মধ্যে থাকা অনিবার্য দুর্বলতাগুলোকে আলিঙ্গন করা নেওয়া উচিত আমাদের।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে রোমান্টিক জীবনের তুলনা করেন। এর সুবিধা হচ্ছে, বন্ধুরা সৎ ও আন্তরিক হলে নিজেদের মধ্যে থাকা সমস্যাগুলোও আপনাকে জানাবে। যা আপনার লজ্জা এবং হীনমন্যতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনবে।
এরকম কথোপকথন আপাতদৃষ্টিতে যে দম্পতিকে খুব আদর্শ মনে হচ্ছে, তাদের জীবনের দুঃখ এবং সংগ্রামগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে। এছাড়া তাদের সঙ্গে নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ারও সুযোগ করে দেয়।
(দ্য আটলান্টিক থেকে অনূদিত)