স্ত্রীর উপার্জন ও সামাজিক মাধ্যমের বিতর্ক
সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে যে কোন কিছু নিয়ে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ার এক উদগ্রীব কালচার তৈরি হয়েছে। নিজস্ব উপার্জনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করার বর্ণনা দিয়ে ফেইসবুকে এক বিবাহিত নারীর সাম্প্রতিক পোস্ট নিয়ে সেরকমই বেশ হৈ চৈ চলছে। তাঁকে চিনি না, তবে পোস্টটি পড়লাম। পড়ে ও চারদিকের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, পোস্টে তিনি যা লিখেছেন এবং যেভাবে লিখেছেন – দুটিই মানুষজনের আপত্তির কারণ হয়েছে।
ভদ্রমহিলা সংসারের প্রতিটি ব্যয় স্বামীর সাথে সমান ভাগ করে নেন, এমনটি লিখেছেন। নিজস্ব যা খরচ – দৈনন্দিন ও এককালীন – তার প্রতিটি তিনি নিজে বহন করেন। তিনি যা লিখেছেন, তা নিয়ে এত মানুষের বিস্ময়ে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ছি! প্রতিক্রিয়াগুলো এমন, যেন অভূতপূর্ব অভিনব কিছু এই ভদ্রমহিলা বলছেন। অবশ্য মহিলা নিজেও একই ভাব নিয়ে পোস্টটা লিখেছেন। যেন বা বিপ্লবাত্মক কিছু করে ফেলছেন! যেন তাঁর এহেন সংসার চালনা নারী-স্বাধীনতার পথে এক নতুন মাইল ফলক! নিজের প্রজন্মে বা এমনকি আগের প্রজন্মে মা-খালা-শাশুড়িদেরকে সংসারের উপার্জনক্ষম সক্রিয় সদস্য হিসেবে দেখে থাকলে নিজেরটাকে এত বড় কিছু মনে হওয়ার কথা না। হয়ত সে সুযোগ তাঁর হয়নি।
তবে দেখা যাচ্ছে যে সকল মেরুর ফেইসবুক নেটিজেনকে তাঁর পোস্ট ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। অনেকের কাছে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, অনেকে তাঁর কথায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন। বিপরীতে বহুজনের কাছে তিনি সমালোচিত। তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অনেকে নিজের নিজের সংসারকে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুখের সংসার হিসেবে তুলে ধরে দেখাতে চেয়েছেন কোন সংসারে ৫০-৫০ আর্থিক পার্টনারশিপ কত অপ্রয়োজনীয় ও কতটা 'অলীক' কনসেপ্ট! কিন্তু তাই কি?
যে নারী উপার্জন করছেন না, তাঁকে এই আলোচনার বাইরে রাখতে হবে। কিন্তু যে স্ত্রী উপার্জন করছেন, আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করছেন, সংসারের বাইরে তাঁর পেশায় সময় দিচ্ছেন, তিনি কী করবেন? এর পরের খুব স্বাভাবিক ধাপ হলো স্বামীর পাশাপাশি সংসারে আর্থিকভাবে সক্রিয় হওয়া। বলাই বাহুল্য যে প্রতিটি দম্পতি নিজেদের মতো করে সেটা নির্ধারণ করবেন। প্রতিটি খরচের পাই-পাই ভাগাভাগি হয়ত অপ্রয়োজনীয় হতে পারে, কিন্তু দম্পতির ফিন্যান্সিয়াল পার্টনারশিপ একটা চমৎকার ব্যাপার। এবং সেটা আর্থিক বিচারে সমপর্যায়ের পার্টনারশিপও হতে পারে। বহু সংসারে এটা হয়ে আসছে।
এখন কথা হলো, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা তাঁকে সংসারে আলাদাভাবে সম্মান এনে দেবে কিনা। অবশ্যই একজন আত্মনির্ভর নারীর মনোবল অনেক দৃঢ় হতে পারে, জীবনের প্রতিকূলতায় তাঁকে দিতে পারে অসম সাহস। কিন্তু স্বামীর ওপর কোন আর্থিক নির্ভরতা না থাকলেই সংসার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যায় না। দু হাতে কামাই করে সংসারে ঢেলে দিয়েও স্বামীর তরফ থেকে সম্মান পাননি, এমন অনেক স্ত্রী আছেন। আবার বিন্দুমাত্র আয় না করেও সংসারে রাজকীয় অবস্থানে থাকেন, এমনও আছেন। যে কোন স্বামী-স্ত্রী জোড়ার সম্পর্কের ডাইনামিক্স অনেকখানিই তৈরি হয় তাঁদের ব্যক্তিত্ব দিয়ে, উপার্জন দিয়ে নয়।
এই প্রসঙ্গে কাল্পনিক নাম ব্যবহার করে দুইটি সত্যি জীবনের উল্লেখ করতে চাই।
জয়তুন প্রৌঢ় মহিলা। মানুষের বাড়ি কাজ করেই সারাজীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্বামী কোন কাজ করে না। পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় আর স্ত্রীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া টাকায় চা খেতে খেতে লক্ষ্য রাখে কখন স্ত্রী রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কখনও কখনও জয়তুনের ফিরতে দেরী হয়ে যায়। সেসব দিনে মেজাজ অল্প খারাপ থাকলে স্বামী গালাগাল শেষে জয়তুনের নিয়ে আসা ভাত-তরকারি খেতে বসে। আর মেজাজ বেশি খারাপ থাকলে মারধর করে, তারপর সেই ভাত নিয়ে বসে। রাস্তায় কারও সাথে কথা বললেও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত স্বামীর হাতে মার খেতে হয় এই বয়োবৃদ্ধাকে!
নাজনীন পেশাজীবী মহিলা। স্বামী উচ্চশিক্ষিত। হঠাৎ করেই নাজনীন আর অফিসে আসেন না। স্বামীর নির্মম প্রহারে এমন মারাত্মক আহত হয়েছেন যে ছয় মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের হাসাহাসি সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে! স্বামীর অত্যাচার হাসপাতাল পর্যন্ত গড়ানোয় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন লোকচক্ষুর সামনে চলে এসেছে, তাই তিনি মানুষের কৌতুকের পাত্রী! এ যেন তাঁর 'কলঙ্ক'! আমার কাছে এসেছিলেন একবার। স্বামীর সাথেই আছেন। তাঁর হাসপাতালে অবস্থানের সময়টাকে উল্লেখ করলেন, "সেই যে যখন আমি অসুস্থ ছিলাম"!! সমাজ এতোই নিষ্ঠুর আর কুৎসিত যে একজন নারীর নিগ্রহকে তাঁর নিজেরই আড়াল করতে হয় 'অসুস্থতা'র নাম দিয়ে!
ভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীর এই দুই উপার্জনশীল নারীর জীবন দেখুন। দু'জনেরই স্বামীর ওপর আর্থিক নির্ভরতা নেই, তদুপরি তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা সবার জন্য সমান আশীর্বাদ বয়ে আনে না। তথাকথিত সামাজিক 'মান-মর্যাদা' ও মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতাও নারীর জন্য অদৃশ্য শৃঙ্খল তৈরি করে রাখে। এদেশের বাস্তবতা বলে, সারাজীবন যারা ঘরের নিভৃত কোণে অতি আপনজনের কাছে নিগৃহীত হয়, যারা সংসারের অদৃশ্য লৌহ নিগড়ে বন্দী হয়ে শৃঙ্খলিত পাখির মতোই ছটফট করে প্রতিনিয়ত, তাদের চোখের পানি আর আঘাতের দাগ অপনীত হয় না "নারী দিবস", আইন, আদালত ইত্যাদি প্রায় কোন কিছু দিয়েই! এবং এটা সমাজের সব বর্ণালীতে কম-বেশি ব্যাপৃত। ধার্মিক পুরুষ স্ত্রীর সমস্ত উপার্জন সংসারে খরচ করেছেন, সমগ্র দাম্পত্য জীবন ধরে নানান রকম কর্কশ অবিচার করে চলেছেন, এমন দেখা যায়; আবার প্রগতিশীল নারীবাদী পুরুষ দাম্পত্য ঝগড়ার মাঝে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন, এমনও আছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদাহরণ দিলাম। নিম্নবিত্তে নারীর নিগ্রহের ধরণ ও মাত্রা আলাদা। সমাজে নারীর প্রচলিত মূল্যায়ন এবং তা থেকে উদ্ভূত মানসিক কন্ডিশনিংয়ের (নারী ও পুরুষ উভয়ের) প্রতি যদি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি, তবেই অর্থপূর্ণ ও ফলপ্রসূ পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
নারীর উপার্জনে ফিরে আসি। বহু নারীর কাছে এই অভিযোগ শোনা যায় যে স্বামীর একক উপার্জনের সংসারে যে কোন খরচের ক্ষেত্রে স্বামীর খবরদারি এবং কখনও কখনও স্বামীর খোঁটা সহ্য করতে হয়। স্ত্রীর মতামত বা ইচ্ছার যথাযোগ্য মর্যাদা থাকে না। এসব অভিযোগ আমলে না নিলে, অস্বীকার করলে, অভিযোগ ধামাচাপা দিতে অভিযোগকারীর প্রতি নানারকম তকমা ছুঁড়ে দিলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। এককভাবে আয় করার 'গরিমায়' যদি স্বামী তার স্ত্রীকে সংসারের একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর যোগ্য মনে না করে এবং সময়ে-অসময়ে তা স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়ে ইগো-তুষ্টি লাভ করে, তাহলে একটি মেয়ের এটা মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ হলো টাকা কামানো। চারদিকে এমন উদাহরণ দেখে আজকাল মেয়েরা আয় ও আত্মসম্মানকে সমার্থক ভাবা শুরু করেছে।
অথচ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়া উচিৎ পারস্পরিক ইহসানের। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ থেকে এর জন্ম। এবং যুগল জীবনের পুরোটা জুড়েই প্রতিনিয়ত এই ইহসান ধারণ ও লালন করতে হয়। জীবনকে যদি সমুদ্র বলা হয়, সংসার সেখানে নৌকা এবং ইহসান তার নোঙর। জীবনের জোয়ার-ভাটায় এদিক ওদিক ভেসে যেতে যেতে দুজন নারী ও পুরুষ প্রতিবারই নোঙরের জোরে হারিয়ে না গিয়ে নিজেদের দিশা খুঁজে পায়। এর সাথে দরকার পড়ে ইনসাফের ধারণা ও সেটার প্রয়োগ। উভয়ের উপার্জন থাকুক, বা না থাকুক।
দাম্পত্যে এই দুইয়ের অনুপস্থিতিতেই জুলুম-নির্যাতনের বিকাশ। অথবা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের। সেই পথ বেয়ে আসে অধিকারের কড়া হিসাব-নিকাশ এবং খরচাপাতির চুলচেরা গণনা। আপসোস! সুন্দরকে আর সুন্দর রাখা যায় না!
- লেখক: ড. রায়হানা শামস্ ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক