কারা সেইসব ‘ভূতুড়ে সহকর্মী’- কীভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবেন?
অফিসে কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সহকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিক এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কফি খেতে খেতে গল্প করা, একসঙ্গে কারও জন্মদিন উদযাপন কিংবা বাড়ি ফেরার পথে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বের হওয়া- এই বিষয়গুলোর মাধ্যমেই কাজের বাইরেও সহকর্মীদের সঙ্গে চমৎকার এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি অফিসে সবাই একসঙ্গে একই টিমে কাজ না করলেও, লিফটে ওঠানামা বা সারাদিন সামনা-সামনি দেখা হওয়ায় বহু মানুষের সাথে পরিচিতি বাড়ে।
কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সাথেসাথেই অফিস বলতে- আর আগের মতো চার দেয়ালে আবদ্ধ কোনো কর্মক্ষেত্রকে বোঝায় না। কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে যুক্ত হয়েই তাদের দাপ্তরিক কাজ সারেন। শুধুমাত্র যাদের সঙ্গে কাজের সূত্রে যোগাযোগ না করলেই নয়, স্রেফ তাদের সাথেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
মানুষের কর্মক্ষেত্রের পরিসরও ছোট হয়ে আসছে। কাজের ফাঁকে অকারণেই আর আইটি বিভাগের 'আপু' কিংবা অ্যাকাউন্টসের 'ভাইয়ার' সঙ্গে গল্প করা হয়ে ওঠে না। অফিস জীবনে যে সহকর্মীদের সঙ্গে স্বল্প সময়ের জন্য গল্প জমে উঠত, তারা এখন জীবন থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, দূর থেকে কাজ করে এমন কর্মীরা তাদের প্রতিষ্ঠান কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গে খুব বেশি কানেকশন বা সম্পৃক্ততা বোধ করেন না। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও কঠিন। খুব বেশি জানাশোনা নেই, এমন সহকর্মীর সঙ্গে জুমে আলাপ করতেও অদ্ভুত লাগবে। অথচ মহামারি-পরবর্তী সময়ে ভার্চুয়ালি কাজের সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। আর তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই 'ভূতুড়ে সহকর্মী'দের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে রক্ষা করা যেতে পারে- তা দেখে নেওয়া যাক।
ছোট হচ্ছে পৃথিবী
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর দুই বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। এই সময়ে মেধানির্ভর পেশায় নিয়োজিত বিশ্বের ৩০ শতাংশেরও কম কর্মী প্রতিদিন অফিস করছে।
২০২১ সালে মাইক্রোসফট তার কর্মীদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখতে পায় যে, যারা বাড়ি থেকে কাজ করছে তাদের সহকর্মী সার্কেল যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কেও পরিবর্তন এসেছে। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন টিমের সদস্যদের মধ্যে সম্পৃক্ততা কমার পাশাপাশি ইনফরমাল বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোও দুর্বল হচ্ছে। মহামারির পর অফিসের অন্যান্য গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার হার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। গ্রুপগুলোও যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। নতুন কেউ যেমন এসব দলে ভিড়ছে না, তেমনি দলের সদস্যরাও নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাডেমিক ও মাইক্রোসফট গবেষকদের পরিচালিত আরেকটি গবেষণায়- কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের ১৪০ কোটি প্রফেশনাল ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৮ সালের জুলাই ও ২০২০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি পাঠানো মেইল পর্যালোচনাতেও একই ধরনের তথ্য মিলে।
দেখা যায় যে, অফিসে একই কাজে নিয়োজিত দলগুলোর মধ্যেই যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল। অন্যদিকে, ভিন্ন দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। এমনকি একই দলের কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা নতুন কারও যুক্ত হওয়াতেও দলের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
মহামারি শুরুর আগে সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন ছিল ভিন্ন। মহামারির সময় যখন হুট করে কর্মীরা একেকজন একেক জায়গা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে কাজ করা শুরু করল তখন নোটি অ্যালকোহল ফ্রি ওয়াইন প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববাজারে নতুন পণ্য আনতে চলেছে। এরকম একটি সময় কাজ বেড়ে গেলেও সব ভার্চুয়ালি সামলানোর প্রয়োজন পড়ছিল। বিষয়টি ভীষণ ক্লান্তিকর ছিল বলে মনে করেন এর প্রতিষ্ঠাতা আমান্ডা থমসন। আগে যেখানে অফিসে সারাদিন সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, সেখানে আমান্ডার দৈনন্দিন কথা বলার সময় নেমে আসে মাত্র ১৫ মিনিটে।
তবে এর জন্য কাজে কোনো হেরফের হয়নি বলেও জানান তিনি। পুরো সময়ই সবাই খুব প্রোডাক্টিভ থাকত এবং কোনো সময় অপচয় হতো না। কিন্তু একইসঙ্গে হালকা গুল্পগুজব, হাসিঠাট্টা কিংবা স্বাভাবিক কথাবার্তার মতো বিষয়গুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে হয় না, এমন সহকর্মীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে কর্মস্থলে আমান্ডার যোগাযোগের যে পরিসর ছিল, তা হয়ে আসে সীমিত।
"আমাদের মতো যারা বহির্মুখী স্বভাবের, তারা সেসময় অনেককিছু হারিয়ে ফেলে," বলেন তিনি।
অনলাইনে হাসিঠাট্টার জায়গা নেই
গবেষকদের মতে, অসংখ্য মানুষ আমান্ডার মতো একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। চাকরির সন্ধান দেয় এমন একটি সাইট ইনডিডের গবেষণায় দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ মানুষই সশরীরে মেলামেশা না করতে পারার অভাব বোধ করছেন। অন্যদিকে, ৪৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে করা বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার বিষয়টি মিস করছেন।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানের অ্যাকাডেমিক সিমি গ্রোভার বলেন, "অনেক মানষই কর্মক্ষেত্রে সামাজিক চাহিদা পূরণ করে থাকেন। তারা দিনব্যাপী কাজের খাতিরে বিভিন্ন সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার বিষয়টি উপভোগ করেন।"
এই সামাজিক সম্পর্কগুলোর মাধ্যমেই কর্মক্ষেত্রে মানুষ তাদের পরিচয়, অবস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, যেসব কর্মীরা অধিকাংশ বা পুরো সময় টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে কাজ সারছে, তারা সহকর্মীদের সঙ্গে আগেরমতো সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছে। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ কর্মী সামগ্রিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করছেন।
শুধু ঘনিষ্ঠ সহকর্মীই নয়, অফিসের অন্যান্য পরিচিত যারা আছেন, যাদের সঙ্গে লিফট কিংবা কফি আনতে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সম্পর্কগুলোই মানুষকে আনন্দ দেয়, যার ফলে কর্মস্পৃহা বাড়ে।
কর্মক্ষেত্রে উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা ও সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে সহকর্মীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া হ্রাসের প্রভাব সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে আমান্ডার মতে সহকর্মী এবং পরিচিতদের থেকে দূরে থেকে তিনি যে জিনিস সবচেয়ে বেশি মিস করেছেন তা হলো হাসি।
"অনলাইনে হাসিঠাট্টা বোঝা যায় না। অপরপ্রান্তে যে আছে, সেও সবসময় পুরোটা ধরতে পারে না। আর এখানে সেই সুযোগও কম। আর তাই বাস্তবে যে হাসিগুলো ছড়িয়ে পড়ত সেগুলো অনেক মিস করেছি। অনুমান করতে পারি যে ২০২২ সালে আমরা এখন একসঙ্গে আগের চেয়ে অনেক কম হাসি," বলেন তিনি।
জন্মদিন কিংবা ভার্চুয়াল কফি
অনেক মানুষের জন্যই হয়তো এই বিষয়গুলো অতটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষরা সম্ভবত তাদের এই হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া 'ভূতুড়ে সহকর্মীদের' তেমন মিস করে না। আবার অনেক অফিসে কাজের চেয়ে অকাজের আলাপ করেই মানুষ বিরক্তিকর পরিবেশ তৈরি করে। যারা নিজেদের কাজ নিয়ে সচেতন, তারা হয়তো নেতিবাচক পরিবেশ থেকে রেহাই পেয়ে খুশিই হবেন।
কর্মীরা যেন অনলাইনে নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, সেজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও সচেতন হওয়া দরকার। দূর থেকে আজ করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো নিউজলেটার, পডকাস্ট বা ভার্চুয়াল টাউন হলের মতো ব্যবস্থার আয়োজন করতে পারে। এখানে কাজের বাইরেও সহকর্মীরা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ও ব্যক্তিগত তথ্য আদানপ্রদানে সক্ষম হবে।
ওয়ার্ক টুগেদার এনিহোয়্যারের লেখক লিসেট সাদারল্যান্ড বলেন, "এর জন্য স্ব-উদ্যোগী হয়ে চর্চা শুরু করা প্রয়োজন। যারা এগুলো নিয়ে ভাবছেন তাদের কেউ একা কিংবা কয়েকজন মিলে দায়িত্ব নিয়ে এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব।"
তিনি বলেন, সম্পর্ক তখনই তৈরি হয় যখন আমরা পরস্পরের দিকে মনোযোগ দিই। আর তাই আমাদের এমন কোনো আয়োজন করতে হবে যেন আমরা কাজের বাইরেও একে-অপরের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। সেক্ষেত্রে কারও জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ কোনো ভার্চুয়াল আয়োজন কিংবা ভার্চুয়াল কফি আড্ডার আয়োজন করা যেতে। এছাড়াও অফিসের ভার্চুয়াল মিটিংয়ে হঠাৎ কোনো কুইজ রাখার মতো বিষয় ঘটলেও সাবলীল কথাবার্তা চলতে পারে। কাজের বাইরে সহকর্মীরা অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে পৃথক চ্যাট গ্রুপও খুলে নিতে পারে।
কিন্তু তারপরও এই বিষয়গুলো হয়তো সরাসরি কোনো সহকর্মীর পিঠ চাপড়ে দেওয়া বা কোনো বিষয় নিয়ে হুটহাট মজা করায় যে আনন্দ পাওয়া যেত, তার সমতুল্য কখনোই হবে না। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত মুহূর্তগুলো প্রতিদিন একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। অনলাইনে এমন সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন।
আমান্ডা মহামারির আগের কাজের পরিবেশ মিস করলেও এখনই পুরোপুরি সশরীরে কাজ শুরু করছেন না। দূর থেকে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একটু চাপা স্বভাবের সহকর্মীরাও এভাবে কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
তবে কোভিডের বিধিনিষেধ কমে যাওয়ায় তিনি কাজ সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে সশরীরে যোগাযোগ বাড়াতে চান। সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যেই তিনি সহকর্মী এমনকি পরিচিতদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাতের মাধ্যমে সম্পর্কগুলো ঝালাই করে নিবেন বলে জানান।
"মানুষের সঙ্গে মিশতে পারাটা দারুণ," বলেন আমান্ডা থমসন।
- সূত্র: বিবিসি