কাশ্মীরী হালুয়া-লুচি আর মদিনা মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি- লা জবাব!
বাহারি স্বাদ ও বিচিত্র চেহারার নানা পদের মিষ্টির লোভে সকাল সকাল মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে দোকানের সামনে গমগম করছে ভিড়। বাইরে দাঁড়িয়ে ভিড় কমার অপেক্ষা করছি দেখে উল্টো দিকের মাংসের দোকানের মালিক রফিক ঠাট্টার ছলে বললেন, "মদিনায় মিষ্টি খাইতে আসছেন! ডায়বেটিস ধরবে তাড়াতাড়িই। গত ৪০ বছর যাবত এখানের মিষ্টি খাইতে খাইতে আমার ডায়বেটিস হইলো, তাও এদের মিষ্টির মায়া ছাড়তে পারি না। সকালের হালুয়া, পরোটা আর ভাজির নাস্তাটাও খুবই ভালো এখানে।"
ঢাকা শহরের নানা এলাকা থেকে নানা বয়সী গ্রাহক আসেন লালবাগের মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। আয়তনে খুব বেশি বড় নয় দোকানটি। গতানুগতিক হোটেলের বাইরে কাঠের বেঞ্চ আর টি-টেবিল দিয়ে বৈঠক খানার আদলে সাজানো ছোট্ট খাবারের জায়গা। একজন বেঞ্চ থেকে উঠতে না উঠতেই ফের দখল হয়ে যায় বসার জায়গা। প্রায়ই জায়গার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দাঁড়িয়ে। এত লোক সমাগম ও জনপ্রিয়তার কারণ জিজ্ঞেস করলে হোটেল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা স্বপন জানান, মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নানা পদের মিষ্টির সাথে গরম গরম নাস্তার সুনাম অনেক বছর ধরেই চলছে। নিয়মিত গ্রাহকের পাশাপাশি প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ আসেন নানাজনের কাছ থেকে এখানকার মিষ্টির গল্প শুনে। লালবাগ কেল্লার কাছেই রহমতুল্লাহ বয়েজ হাইস্কুলের সামনে অবস্থিত দোকানটি।
হোটেলের ভেতর বসার জায়গা পেয়েই গরম গরম লুচির সাথে ভাজি আর বুন্দিয়া অর্ডার করি। ৪৬ বছর আগে মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্প সময়েই গ্রাহকের মন জয় করে নিয়েছিল এখানের নাস্তার স্পেশাল সবজি ভাজি। হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াজির আহাম্মদ বলেন, "বাঁধাকপি-আলু আর নানা ধরনের সবজি দিয়ে বানানো হত এই মিক্সড ভাজি। শুরুতে হোটেলের জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে এই ভাজির অবদান অনেক। সকালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যেত এটা। প্রায়ই কাস্টমাররা এসে নাস্তায় ভাজি না পেলে আমাকে বকাবকি শুরু করত! কেন বেশি করে ভাজি বানাই না তা নিয়ে চলত অভিযোগ।"
লুচি-ভাজির এই নাস্তা খাওয়ার পর অতীতের সেই কাস্টমারদের ক্ষোভের কারণ সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন যে কেউ! আশেপাশের টেবিলে লক্ষ্য করছিলাম সকাল-সকাল শুধু ভাজিই নয় মিষ্টি-লুচি দিয়েও নাস্তা সারছিলেন অনেকে। কাশ্মীরী হালুয়া, মালাই চপ, সর মালাই, জাফরান ভোগ ইত্যাদি নানা প্রকারের মিষ্টি দিয়ে তৃপ্তির সাথে নাস্তা সেরে শেষে রয়েছে গরুর দুধের চা।
মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিষ্টি কিনতে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জান্নাত। তিনি বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে ফেসবুকের এক গ্রুপে মদিনার মিষ্টির রিভিউ দেখে বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে প্রায়ই এদের মিষ্টির টানে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে চলে আসি। বিকালের দিকে এলে সর্ষের সস দিয়ে গরম গরম আলু পুরি কখনো মিস করি না।"
ঘিয়ে ভাজা মালাই-এর সাথে রঙবেরঙের জেলি দিয়ে সাজানো হয়েছে শাহী কাশ্মীরি হালুয়া, মালাই দিয়ে চপের আকারে বানানো দুধে ভেজানো মালাই চপ, ঘন দুধের রসে জাফরান ভিজিয়ে বানানো ছানার মিষ্টি জাফরান ভোগ, সর আর বাদামের মিশ্রণে বানানো বাদাম সর, দইয়ের উপর জাফরান দিয়ে সাজানো জাফরান দই, কাজুবাদাম কুচি সহ বাদাম দই, গুড়ের রসগোল্লার মতো বাহারি সব মিষ্টি পাওয়া যায় মদিনায়। জাফরান ভোগ, মালাই চপ, বাদাম সরের মতো জনপ্রিয় মিষ্টিগুলো প্রতি পিস ৬০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়।
কামরাঙ্গীরচর থেকে মায়ের সাথে মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নাস্তা করতে এসেছিল মাহিন। এখানের ছানার মিষ্টি দিয়ে পরোটা তার খুব পছন্দের।
"আমি ছোটবেলা থেকেই এখানে খেতে আসি। মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে অনেক আনকমন মিষ্টি পাওয়া যায়। আজ নাস্তা করেছি কাশ্মীরি হালুয়া আর পরোটা দিয়ে," হাসিমুখে জানায় মাহিন।
প্রায় ৩০ বছর ধরে মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দেখাশোনা করা স্বপন বলেন, "প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে হোটেল খুলি। ফজরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা নাস্তা করতে আসেন এখানে। রাত ২টা থেকে তাই রান্না শুরু করতে হয়। আবার রাত ১১টা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। সকাল আর সন্ধ্যার নাস্তার সময়ে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় হোটেলে। মাংস জাতীয় কোনো আইটেম বানানো হয় না আমাদের এখানে। নাস্তাতেও মিষ্টি খাবারই প্রাধান্য পায়।"
১৯৭৬ সালে মেট্রিক পরীক্ষার্থী ওয়াজির আহাম্মদ পরিবারের অমতেই শুরু করেছিলেন মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। জন্ম থেকেই লালবাগের অধিবাসী তিনি। পড়ালেখার বাইরে নতুন কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। মদিনা মিষ্টান্নের আগে এই জায়গায় অন্য এক ব্যবসায়ীর মিষ্টির দোকান ছিল। ব্যবসায় সুবিধা না করতে পেরে সেই ব্যবসায়ী দোকানটি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছিলেন। তখন বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আর কিছু শখের জিনিস বিক্রি করে দোকানের জিনিসপত্র কিনে নিয়েছিলেন ওয়াজির আহাম্মদ।
"বাবা বলেছিলেন মন দিয়ে পড়ালেখা করতে, যত টাকা লাগে তিনি দেবেন। কিন্তু আমার মন ছিল ব্যবসায়। তাই দোকান নেয়ার সময় বাবা কোনো সহযোগিতা করেননি। তখন রেডিও-র অনেক জনপ্রিয়তা ছিল দেশজুড়ে। আমার খুব শখের একটা রেডিও বিক্রি করে দিয়েছিলাম টাকা জোগাড় করতে। সাথে বন্ধুদের কাছ থেকে ধারে টাকা নিয়ে ব্যবসায় এগিয়েছিলাম। দোকান ভাড়া আর এডভান্সডসহ ৪ হাজার টাকা আর কাঠের শেল্ফসহ দোকানের আনুষঙ্গিক নানা জিনিস কিনতে আরো ৬ হাজার টাকা লেগেছিল। মোট ১০ হাজার টাকা পুঁজিতেই শুরু করেছিলাম ব্যবসাটা," স্মৃতিচারণ করে বলেন ওয়াজির আহাম্মদ।
"শুরুতে মিষ্টির চেয়ে নাস্তা-ভাজির জন্যই বেশি জনপ্রিয় ছিল দোকান। অল্প কিছু মিষ্টি ছিল তখন। আস্তে আস্তে মিষ্টির ধরন বাড়াতে লাগলাম। কয়েকবছর পর এক পহেলা বৈশাখে অনেক বেশি মিষ্টি বিক্রি হয় দোকানে। এরপর থেকে মিষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করি। দেশের নানা জায়গার বিখ্যাত মিষ্টি বানানোর জন্য আঞ্চলিক কারিগরদের নিয়ে এসেছিলাম আমার দোকানে। কিন্তু ঢাকায় এসে তাদের বানানো মিষ্টি অরিজিনাল জায়গার মিষ্টির মতো স্বাদ হতো না। পরে বুঝতে পারলাম শুধু কারিগর থাকলেই হয় না, নির্দিষ্ট জায়গার পরিবেশ আর প্রাকৃতিক উপাদানের উপর খাবারের স্বাদ অনেক নির্ভরশীল। তাই নিজেদের আইডিয়াতেই নতুন মিষ্টি বানানোতে জোর দিলাম," জানান ওয়াজির।
কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার থেকে প্রতিদিন মিষ্টি বানানোর দুধ সংগ্রহ করা হয় মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। কারিগরেরা প্রতিনিয়ত নতুন মিষ্টি বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। বর্তমানে মূল কারিগরের দায়িত্বে আছেন হরিদাস, অশোক দাস ও আব্দুল রশিদ।
৪৬ বছর যাবত নিজের শ্রম দিয়ে ওয়াজির আহাম্মদ গড়ে তুলেছেন জনপ্রিয় এই মিষ্টির দোকান। শুরুতে ৩-৪ জন কর্মীর সাথে নিজেও কাজ করতেন সকাল-সন্ধ্যা। টিনশেডের ছোট্ট দোকান থেকে ইট-পাথরের আজকের গড়া মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার তার কষ্ট আর ধৈর্যের ফসল। বর্তমানে এখানে কাজ করেন প্রায় ৫৫ জন কর্মী। করোনার দীর্ঘ বন্ধ আর ব্যবসার মন্দার সময়েও ছাঁটাই করেননি কোনো কর্মীকে। বেতন দিয়েছেন সবাইকে। এখন স্বাভাবিক সময়ে ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। শীঘ্রই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনা করছেন ওয়াজির আহাম্মদ।