প্যারিসে প্রদর্শনীতে যাওয়া ২০০টি অমূল্য চিত্রকর্ম কি রাশিয়া ফেরত পাবে?
ইউক্রেনের মানুষজন এখন শরণার্থী হিসেবে ইউরোপের দিকে ছুটছেন। বর্তমানে যুদ্ধের যা পরিস্থিতি, তাতে এই যাত্রা খুব শীঘ্রই যে থামবে তা বলা যাচ্ছে না।
একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। ইউক্রেনীয়রা রাস্তা দিয়ে সদলে হেঁটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এমন সময় তারা দেখতে পায় বিপরীত দিক থেকে বড়সড় এক গাড়িবহর আসছে। সচরাচর এমনটা হওয়ার কথা না, কারণ মানুষ তো কেবল ইউরোপের দিকেই ছুটছে, ইউরোপ থেকে কেই-বা এ দুঃসময়ে এমুখো হবে।
সাঁজোয়া যান দিয়ে ঘেরা ওই বহরের ট্রাকগুলোতে রয়েছে শতকোটি ডলার মূল্যের কিছু কালজয়ী চিত্রকর্ম। প্রায় ২০০টি চিত্রকমর্বাহী এ বহরটি প্যারিস থেকে রওনা দিয়ে যাচ্ছে মস্কোর উদ্দেশে।
এমন একটি দৃশ্যপট ইউরোপের শরণার্থী-ভারাক্রান্ত রাস্তাগুলোতে বাস্তবেই ঘটতে পারত। সত্যিই মস্কোর মালিকানাধীন বিলিয়ন ডলারের ওই ২০০টি শিল্পকর্ম আবার মস্কোতেই ফিরে যেতে পারত। কিন্তু তা হবার সম্ভাবনা কেবলই যেন মিইয়ে আসছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কো থেকে ছবিগুলোকে প্যারিসে প্রদর্শনের জন্য নেওয়া হয়েছিল। এই ছবিগুলোর শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন মোনে, পল সেজান, ভ্যান গগ, পিকাসো'র মতো জগৎবিখ্যাত শিল্পীরা।
ইউক্রেনে হঠাৎ আক্রমণের পর রাশিয়ার সাথে ইউরোপের দেশগুলোর সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে পৌঁছেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর দেশগুলোর সাথে বর্তমানে রাশিয়ার কোনো আকাশপরিবহনের ব্যবস্থা নেই। পশ্চিমা ও ইইউ'র নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়ার অর্থনীতি।
সেজন্যই মরোজভ কালেকশনের অংশ এ চিত্রশিল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে বর্তমানে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্যারিসে প্রদর্শনের জন্য লুই ভুটন ফাউন্ডেশন ওগুলো রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় জাদুঘর থেকে ধার এনেছিল। আগামী ৩ এপ্রিল এ প্রদর্শনীটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
অনেকে মনে করছেন এ চিত্রকর্মগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সংস্কৃতিমনা হিসেবেই ইউরোপীয়ানদের কাছে তুলে ধরছে। তবে একই সঙ্গে এগুলো রাশিয়ার জনগণের সম্পত্তিও। তাই সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বাইরে থাকুক এই অমূল্য শিল্পগুলো; এমনটাই চাওয়া অনেকের।
তবে ব্যাপারটা অতটাও সহজ নয়। ইউক্রেনের সাথে সৌহার্দ্য প্রকাশ করতে গিয়ে পশ্চিমা ও ইউরোপের নন্দনতত্ত্ববিদেরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে রাশিয়ায় প্রবেশের অধিকার যেমন দেয়নি, তেমনিভাবে রাশিয়ান সংস্কৃতিকেও অনেক পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান স্বাগতম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। তাই মরোজভ কালেকশনও রাশিয়াকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পশ্চিমাদের কাছে আরেকটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে উঠবে কি না তা এখন দেখার পালা।
মরোজভ কালেকশনের প্যারিস ভ্রমণের গল্পের শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিখ্যাত লুই ভুটন মোয়েত হেনেসি (এলভিএমএইচ)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বার্নার্ড আর্নল্ট তার নতুন প্রতিষ্ঠিত ফ্র্যাঙ্ক গ্যারি-ডিজাইনড মিউজিয়ামের জন্য একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তার জন্য তিনি রাশিয়ান শিল্পপতি সার্গেই শুকিনের মালিকানাধীন বিখ্যাত ছবিগুলো প্যারিসে আনার ব্যবস্থা করেন।
সেবার প্রদর্শনীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে যা ফ্রান্সের ইতিহাসে একটি মাইলফলক তৈরি করে। কিন্তু তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না আর্নল্ট। তিনি মস্কো যান, গিয়ে পুতিনের কাছে অনুরোধ করেন, 'প্যারিসের এবারের প্রদর্শনীতে তো আপনি থাকতে পারলেন না, চলুন আপনার সংগ্রহে থাকা আরও চমৎকার সব চিত্রকর্ম দিয়ে আমরা আরেকটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি।'
পুতিন এ প্রস্তাবে রাজি হন। তখন আরও কিছু চিত্রকর্মের সাথে মরোজভ ভাইদের ওই ছবিগুলোরও ব্যবস্থা করা হয়। রাশিয়ান এই দুই ভাই নিজেরা বিশাল শিল্পপতি। সুযোগ বুঝে মিখাইল মরোজভ ও ইভান মরোজভ ফরাসিদের কিছু কালজয়ী চিত্রকর্ম কিনে নিয়েছিলেন।
সে সময় অবশ্য পুতিনকে ফ্রান্সে খুব একটা আদরণীয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। তারপরও শুকিনের প্রদর্শনী উদ্বোধন করার জন্য পুতিনের ফ্রান্সে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের কারণে সে পরিকল্পনা থমকে যায়।
না যেতে পারলেও পুতিন প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখেছিলেন, 'সংস্কৃতির বিষয়ে আমাদের খোলামেলা থাকা উচিত।'
'সিরিয়া ও ইউক্রেন প্রসঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুই দেশের (ফ্রান্স ও রাশিয়া) সম্পর্ক অটুট থাকবে,' বলে মন্তব্য করেছিলেন মস্কোতে থাকা ফরাসি রাষ্ট্রদূত।
ছয় বছর পর ২০২২ সালে এসে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। ইউক্রেনের সীমান্তে সেপ্টেম্বর মাসের আগে থেকেই পুতিন সৈন্য সমাবেশ করছিলেন। তাই মরোজভ কালেকশনের এই প্রদর্শনীটিকে দেখা হয়েছিল পুতিন আর ফ্রান্সের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের একটি প্রতীক হিসেবে। মরোজভ কালেকশনের উদ্বোধন করার সময় পুতিনেরও থাকার কথা ছিল, করোনাভাইরাসের কারণে আইসোলেশনে থাকার কারণে আবারও তার যাত্রায় বাধা পড়ে। কিন্তু এখন ইউক্রেন আক্রমণের প্রায় এক মাস পরে এই ছবিগুলোকে আর রাজনীতির বাইরে বোধহয় রাখা যাচ্ছে না।
মিখাইল মরোজভ ১৯০৩ সালে মারা যান। কিন্তু তার ফলে তাদের শিল্পসংগ্রহের যাত্রা থেমে থাকেনি। পরের দশ বছর রাশিয়া ও ফরাসি চিত্রশিল্পীদের ছবি কিনতে থাকেন তার ভাই ইভান মরোজভ। সেসবের অনেকগুলোই জায়গা পেয়েছে প্যারিসের এই শুকিন প্রদর্শনীতে। এগুলোর মধ্যে আছে মনোর আঁকা ব্ল্যাকবোর্ডের আকারের একটি ল্যান্ডস্কেপ, ভ্যান গফের আঁকা সমুদ্র, পিয়ের বোনার্দের ক্যানভাসে আঁকা বসন্ত, গ্রীষ্ম, ও শরৎ ইত্যাদি। নিজের বাড়িতে ছবিগুলো রেখেছিলেন ইভান, প্রতি রবিবার তার বাড়িতে গিয়ে এগুলো দেখতে পারতেন দর্শনার্থীরা।
রাশিয়াতে ছবিগুলো যে কেবল মহাধনী মরোজভ ভাইদের মনোরঞ্জনের উৎস হিসেবে কাজ করেছিল তা নয়। তাদের এ সংগ্রহ কাজিমির মালেভিশ, ভ্লাদিমির তাতলিনের মতো রাশিয়ান চিত্রশিল্পীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। মিখাইল মরোজভের সংগ্রহে থাকা ছবিগুলো ১৯১০ সালে মস্কোর ত্রেতিয়াকোভ গ্যালারিতে দান করে দেওয়া হয়।
ত্রেতিয়াকোভ গ্যালারি'র পরিচালক জেলফিরা ত্রেগুলোভা লিখেছেন, 'রাশিয়ান শিল্পে অ্যাভান্ট-গার্ডের (শিল্পের উচ্চস্তর) ধারণা এত সহজে প্রোথিত হতো না, যদি না ফরাসি শিল্পীদের এ ছবিগুলো রাশিয়ায় আনা হতো।'
মরোজভ কালেকশন ফ্রান্স জব্দ করবে কি না, তা নিয়ে ফরাসি পত্রিকাগুলোয় যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে এ কাজের সমর্থন কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসমূহেই দেখা গেছে এখন পর্যন্ত। ফ্রান্সে একটি বিশেষ আইন আছে যেটা দেশটিতে থাকা বিদেশি শিল্পকর্মের নিরাপত্তা প্রদান করে।
এছাড়া এ প্রদর্শনীর ছবিগুলো নিয়ে আলাদা একটি ডিক্রিও (সরকারি আদেশ) রয়েছে। শিল্পবিষয়ক আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন মরোজভ কালেকশন জব্দ করে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর বিশেষ কোনো আঘাত হানা যাবে না, বরং এর ফলে ভবিষ্যতে ফ্রান্সের জাদুঘরগুলোর অন্য দেশ থেকে শিল্পকর্ম ধার করার সুযোগ হ্রাস পাবে।
সে যা-ই হোক, আজকালের মধ্যেই যে ঘরের ছবি ঘরে ফিরে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এগুলো ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা অনেকদিক থেকেই দুরূহ। ফ্রান্সের রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্সি মেশকভ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, 'যদি ছবিগুলো পাঠানোর ক্ষেত্রে যাত্রাপথে নিরাপত্তা আমাদের কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়, আমরা সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করব।'
- সূত্র: স্লেইট ডট কম থেকে অনূদিত