অধিক কর্মক্ষম হতে চান? কাজ কম করুন!
অর্থ, খ্যাতি, সুখ বা প্রাণশক্তি; আমাদের প্রধান চাওয়াগুলো নিয়ে সাধারণত কী শেখানো হয়? এগুলো পেতে হলে নিজের প্রোডাক্টিভিটি বা কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে, বেশি বেশি কাজ করতে হবে! কিন্তু যদি বলা হয়, এতদিন আপনাকে আসলে ভুল শেখানো হয়েছে? যদি বলা হয়, বেশি না, কম কাজই আপনাকে বেশি কর্মক্ষম করবে?
গবেষণায় দেখা গেছে, কম কাজই মূলত আপনার কর্মক্ষমতা ও ব্যক্তিজীবনের সুখ বাড়ায়। 'ইয়োর ব্রেন অ্যাট ওয়ার্ক' বইয়ে লেখক ডেভিড রক দেখিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে সপ্তাহে মাত্র ছয় ঘণ্টা নিজেদের কাজে মনোযোগ দেই আমরা। যেখানে সপ্তাহে গড়ে ৪০ ঘণ্টার মতো কাজ করতে হয় আমাদের। এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলোর কারণে আপনি সবসময় ব্যস্ত অনুভব করলেও আদতে তেমন কোনো ফলাফল পাচ্ছেন না এগুলো থেকে। এবং এসব কাজই শুষে নিচ্ছে আপনার প্রাণশক্তি। এ কাজগুলো থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিতে পারলে আপনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং মনের শান্তির জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করতে পারবেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যারিয়ার, প্যাশন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আরও নানা কিছুর মাঝে কীভাবে ঝুঁকি না নিয়ে আমরা এই কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ করব? কীভাবে কাজের চাপ কমিয়ে নিজের জন্য এত সময় বের করব?
আপনাকে প্রথমে বের করতে হবে, কী কী করা যাবে না বা করার দরকার নেই। তবে এটা দৈবচয়নের মাধ্যমে করতে পারবেন না। এটি অবশ্যই পদ্ধতিগত এবং প্রমাণ-ভিত্তিক হতে হবে।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ একটি অনুশীলনী তৈরি করেছে, যেটি আপনার করণীয় কাজের তালিকা করার প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিবে। এবং কোন কাজকে বেশি গুরুত্ব দেবেন, কোন কাজ বন্ধ করে দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করবে।
অনুশীলনীটি এমন:
ধাপ এক: একটি সাদা কাগজের মাঝখানে লম্বালম্বি একটি লাইন টানুন।
ধাপ দুই: ব্যক্তিগত জীবনের বা কর্ম জীবনের এমন একটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করুন যেখানে আপনি আরও ভালো করতে চান, বা চাপ কমাতে চান। হতে পারে, আপনি আপনার নেতৃত্বগুণ আরও বিকশিত করতে চান, আপনি একজন থট লিডার হতে চান।
ধাপ তিন: এই নির্ধারিত খাতে ব্যক্তি বা কর্মজীবনে কী কী কাজ করতে হয়, তার একটি তালিকা তৈরি করুন। এবং কাগজের বাম পাশে লিখুন। একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী থট লিডার হিসেবে আপনি তালিকায় রাখতে পারেন কনফারেন্সে যোগদান, কথা বলার সুযোগ আছে এমন সংগঠনে যোগদান, নতুন নিবন্ধ লেখা, পড়া, গবেষণা করা এবং আরও অনেক কিছু।
ধাপ চার: এই খাতে আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলো, বা আপনার বড় পাওয়াগুলোর একটি তালিকা করুন। এবং তা কাগজের ডান পাশে লিখুন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বড় মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার অভিজ্ঞতা, কিংবা কর্মস্থলে কোনো দুর্দান্ত উপস্থাপনা করার স্মৃতি, বা কোনো বড় প্রকাশনায় লেখা গৃহীত হওয়ার স্মৃতি।
অনেকের কাছে এই অংশটি একটু কঠিন লাগতে পারে। আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যক্তি পর্যায়ের উন্নতিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ব্যক্তি পর্যায়ের উন্নতি নিয়ে আমরা নিজেরাও উদযাপন করতে পছন্দ করি না। তাই অনেকের ডান পাশটা হয়তো ফাঁকা থাকবে।
কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিজীবনে ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছেন, এমন যেকোনো ঘটনাকে এই তালিকায় রাখতে পারেন আপনি। কোনটা সঠিক, কোনটা জরুরী- এসব নিয়ে চিন্তা না করে যা মাথায় আসে তাই লিখে দিন।
ধাপ পাঁচ: এখন আপনার প্রতিটি বড় সাফল্যের পাশে লাইন টেনে লিখুন এগুলোর পিছনে কোন কোন কার্যক্রম ও প্রচেষ্টা জড়িত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রকাশনায় আপনার নিবন্ধ গৃহীত হওয়ার পিছনে হয়তো অনেকদিনের পড়াশোনা ও গবেষণা জড়িত। এদের মাঝখানে লাইন টানুন।
ধাপ ছয়: কাগজের বাম দিকের যেসব কাজ আপনার সাফল্যে অবদান রেখেছে সবগুলোকে গোল করুন। এখন দেখুন বাকি আছে কী কী কাজ। যেগুলোতে কোনো দাগ পড়েনি, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিন এবার। এসব কাজ হয় আপনার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কিংবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো উচিত। যদি একেবারে না করলেই নয়, তাহলে ভাগাভাগি করে নিন অন্য কারো সাথে।
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবনের কোন কোন খাতে কাজ ও প্রচেষ্টা কমাতে হবে, সেটিও খুঁজে বের করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি হয়তো পরিবারের সঙ্গে বা আপনার সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চান। সেক্ষেত্রে, স্মৃতি হাতরে এমন কিছু মুহূর্ত বের করুন যখন নিজেকে সেরা অভিভাবক মনে হয়েছিল আপনার। হয়তো কোনো একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে ছেলেকে গান বা কৌতুক শোনাচ্ছিলেন, যা খুব পছন্দ করেছিল সে। কিংবা গল্প করতে বসে আপনাকে মনের সব কথা খুলে বলেছিল আপনার মেয়ে। আপনার সান্নিধ্যে সে এত নিরাপদ অনুভব করে, এটা ভেবেই ভালো লেগেছিল আপনার।
এখন তালিকা করুন, অভিভাবক হিসেবে প্রতিদিন কী কী কাজ করতে হয় আপনার। লন্ড্রি, খাবার বানিয়ে দেওয়া, হোমওয়ার্কের কথা মনে করিয়ে দেওয়া, অভিভাবক সম্মেলনে যাওয়া, সন্তানের কাপড়-চোপড়ের খেয়াল রাখা, এবং প্রয়োজনে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
প্রয়োজনীয় মনে হলেও উপরের অনুশীলনীর ছকে ফেললে এসব কাজ হয়তো ছেঁটে ফেলতে হবে আপনাকে।
মনে রাখবেন, যেসব কাজকে 'করতেই হবে' বলে ভাবি আমরা, সেগুলো অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠার পিছনে মূল কারণ হতে পারে দুটি। হয় আমরা সবসময়ই এসব কাজ করে এসেছি, এজন্য। অথবা, এসব কাজ আমাদের চারপাশের সবাই করে থাকে, তাই আমরা ভাবি আমাদেরও করতে হবে। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করে। যে কারণে, এসব কাজ আমরা দেরি করে করি, বা ভুলভাল করে করি। অথবা কারো সাহায্য নিয়ে করি। তাই, আপনার উচিত এসব 'অতিপ্রয়োজনীয়' কাজের ক্ষেত্রে সৃজনশীল বিকল্প বের করা। প্রতিটি অভিভাবক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে আপনি কারো কাছ থেকে শুনে নিতে পারেন আজকের সম্মেলনে কী কী আলোচনা হয়েছে। আপনি বাসায় এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারেন, যার মধ্যে বাচ্চারা নিজেরাই তাদের হোমওয়ার্ক করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করবে।
আবার হয়তো সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন লাঞ্চ করতে বেশ ভালো লাগে আপনার। তার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারেন এর মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে, এই কাজকে তালিকায় রেখে দিতে পারেন।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই অনুশীলনীটি ব্যবহার করতে পারেন আপনি। অপ্রয়োজনীয় কাজগুলোকে কেটে দেওয়ার ব্যাপারে নির্মম হতে হবে আপনার। এবং যেসব জিনিস আপনাকে আনন্দ দেয়, সেগুলোকে অবশ্যই রাখতে হবে তালিকায়। মনে রাখবেন, নিখাদ আনন্দই আপনাকে ১২ শতাংশ বেশি কর্মক্ষম করে তোলে।
- সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ