এই ৮ অভ্যাস সেরা কর্মীদের মধ্যে থাকে, আপনি তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ধরুন আপনি একজন পদস্থ কর্মকর্তা। কর্মী ব্যবস্থাপনা আপনার অফিসের রুটিন কাজের অংশ। কিন্তু সব কর্মীই সমান নন।
দক্ষ ব্যবস্থাপক মাত্রই জানেন, মানবিক দোষ-গুণে তারতম্য থাকেই। তাই প্রতিষ্ঠানের কাজে কে বেশি মূল্যবান- কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? কোন মানদণ্ডে মাপবেন অধীনস্তদের—কারো অভিজ্ঞতায় নাকি কারো 'ওয়ার্ক এথিক' বা কর্মক্ষেত্রে নিয়মনৈতিকতা মেনে চলার গুণ বিচারে? নাকি দাপ্তরিক কাজের বিশেষ একটি খাতে দক্ষতাকেই আপনি সর্বোচ্চ বা যথেষ্ট বলে ভাবেন?
কর্মীদের মানবিক দক্ষতা বা 'সফট স্কিল'-ও কি ন্যায্য মূল্যায়ন করছেন? সব ধরনের পেশার জন্যই এ দক্ষতাজনিত কর্ম-অভ্যাস এক রকম হওয়া উচিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবিক দক্ষতা বলা হচ্ছে কর্মীর সুসম্পর্ক স্থাপনের যোগ্যতা, যোগাযোগের দক্ষতা, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে।
আবার নির্দিষ্ট খাত অনুসারে থাকা দক্ষতাকে বলা হয় কারিগরি দক্ষতা বা 'হার্ড স্কিল'। যেমন একজন অর্থনীতির মেধাবি স্নাতক হতে পারেন একজন ভালো ব্যাংকার।
চাকরির আবেদনেই এসব দক্ষতা চাকরিসন্ধানীরা উল্লেখ করেন। সেখানে বাড়িয়ে-ছাড়িয়ে বলা হয় অনেক সময়। কিন্তু, বাস্তবে যতটুকুই থাকে- সেটাই হয় তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের সোপান।
দুনিয়ার বেশিরভাগ কোম্পানি কর্মীর 'সফট স্কিল' আর মানব উন্নয়নের যে ইতিবাচক প্রভাব প্রতিষ্ঠানে পড়ে তার সঠিক মূল্যায়ন করে না। তাদের ধারণা, খাত-ভিত্তিক দক্ষতা থাকাই বেশি দরকারি, আর সে গুণেই চলে ব্যবসার চাকা।
আসলে কারিগরি দিক দিয়ে আপনি যতই দক্ষ হন না কেন, মানবিক দক্ষতা না থাকলে ক্যারিয়ারে সফল হওয়া কঠিন। আর সেজন্যই এখন বিশ্বের বড় বড় সংস্থা কর্মীদের 'সফট স্কিল' তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
কারণ মানবিক দক্ষতা আকস্মিক কোনো ঘটনায় বা কোনো উত্তেজক পরিস্থিতিতে বিরোধ সমাধানে রাখে অসামান্য অবদান। এ ধরনের কর্মীরাই আসলে সবচেয়ে মূল্যায়ন পাওয়ার যোগ্য।
তাই মানবিক দক্ষতা কোনগুলি তা জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। এগুলো রপ্ত করে আপনি কর্মজীবনে সফল হতে পারেন। আবার একজন ব্যবস্থাপক হলে এমন কর্মীদেরই নিয়োগের কথা ভাবতে পারেন।
১. ভালো শ্রোতা:
শুধু কথা বলে গেলেই হয় না কার্যকর যোগাযোগ; আরো চাই অপরদিকের বক্তব্য শোনা ও বোঝার গুণ। ফলে অফিসের বস আসলে কী চাইছেন- একজন কর্মী হিসেবে আপনি তা ঠিকঠাক ধরতে পারবেন।
সহকর্মীদের মতামতের প্রতি সংবেদনশীল একজন কর্মী মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনবেন এবং কী বলা হয়েছে তা জানতে চাইবেন। অন্যের অনুভূতি বা মতামত জানতে প্রশ্ন করবেন যেমন "আপনি এ বিষয়ে কী ভাবছেন?"—অনেকটা এরকম।
২. তারা হবে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার (ইকিউ) অধিকারী
আইকিউ হলো বুদ্ধিমত্তা আর ইকিউ হলো আবেগকেন্দ্রিক বিষয়গুলোতে আপনার বুদ্ধিমত্তা।
কোনো চাকরিতে যোগদানের পর আপনি নিজের ভূমিকা বৃদ্ধির কথা ভাবেন এই আইকিউ- এর কারণেই।
কোনো চাকরিতে সফলতার প্রধান মাপকাঠি ধরা হয় আপনার আইকিউ'কে। কিন্তু, যখন আপনি আপনার ভূমিকা বৃদ্ধি, পদোন্নতি বা সংগঠনের কাঠামো বুঝতে চান- তখন কেবল বুদ্ধিদীপ্ততাই যথেষ্ট নয়, বরং চাই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার সাহায্য। এমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন বিশিষ্ট ইকিউ বিশারদ ড্যানিয়েল গোল্ডম্যান।
৩. ধৈর্য ক্ষমতা হবে অনেক বেশি
পরিস্থিতি যখন সম্পূর্ণ অনুকূলে যেতে থাকে, তখন একজন মানবিক দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আসলেই কী ঘটছে তা বিশ্লেষণের অসীম ধৈর্য ক্ষমতা রাখেন। পূর্ব-বিচার না করে তিনি সহকর্মী বা বসের সাথে একমত না হলেও তাদের মতামত শোনেন। বিরূপ প্রতিক্রিয়া চেপে রাখেন এবং যথাসম্ভব ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ, তাদের পরিস্থিতি অনুসারে আবেগ নিয়ন্ত্রণের বুদ্ধিমত্তার গুণটি রয়েছে।
বিরল এ গুণটি চর্চার মাধ্যমে আপনি কাজের পরিবশে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন। যৌক্তিক ও ঠাণ্ডা মাথায় ভাবনার ফলে আপনি আরও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন। অন্যদিকে, ক্রোধ বা হঠকারিতা শুধু ক্ষতিই করবে।
৪. মানবিক কর্মীরা অভিনয়ের ধার ধারে না
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন কর্মীরা কোনো বিষয়ে যা হয়েছে, সরাসরি তা বলতেই পছন্দ করেন। ওই ঘটনায় তাদের লাভ বা ক্ষতির ব্যাপারেও তারা খেজুরে আলাপের ধারকাছ দিয়ে যান না। তার মানে এই নয়, তারা উত্তেজিত হয়ে এমনটা করেন। বরং শান্ত ও স্থিরভাবে কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা করাই হয় তাদের স্বভাব।
দায়িত্বশীল একজন ব্যবস্থাপক এ ধরনের কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানে কলহ-বিবাদ অনেকটাই কমাতে পারবেন। এতে আপনার প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশি গঠনমূলক, উৎপাদনশীল ও পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে আলাপ-আলোচনার একটি পরিবেশ পাবেন।
৫. আবেগ নিয়ন্ত্রণ কেন গুরুত্বপূর্ণ
প্রতিটি মানুষের মধ্যে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বলে এক ধরনের যোগ্যতাও কমবেশি গড়ে ওঠে। এর মূল কথাই হলো- আমি কী নিজের আবেগ বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক ফলাফল জন্ম দিতে পারছি? আসলে আমরা সবাই তা পারি না।
এ বিষয়ে ড্যানিয়েল গোল্ডম্যান বলছেন, "যুক্তিবাদী মানুষই আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে—তাই তারা একটি টেকসই ও ন্যায্য কাজের পরিবেশ তৈরি করে। এমন পরিবেশে তালবাহানার সুযোগ থাকে কম, বরং থাকে উচ্চ উৎপাদনশীলতা। তখন প্রতিষ্ঠানের সুনামও উজ্জ্বল হয়। সেরা কর্মীরা এমন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য উন্মুখ থাকে। তাদের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয় দিনে দিনে, আর কেউ কর্মস্থল পরিবর্তনের কথাও ভাবে না।"
৬. একসাথে বহু কাজ করতে তারা অস্বীকার করেন
উৎপাদনশীল কর্মীরা তাদের সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকেন, এজন্য তারা একসাথে একাধিক কাজ বা মাল্টিটাস্কিংয়ের ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া, এতে কর্মীর মস্তিকের ক্ষতিও হয়। আবার মনোযোগ ভাগ হয়ে যায় বহু রকমের কাজে, এবং শেষমেষ কোনো কাজই ভালো হয় না। ফলে লক্ষ্যে পৌঁছাতেও হয় বিলম্ব।
৭. মূল্যবোধ আর সুস্থ-জীবন চর্চা
সেরা কর্মীরা এমন কোম্পানিতে কাজ করতে যান, যেখানে তাদের কাজ ও জীবনযাপনের সময়সূচি সমন্বয় করা যায়। তাই বুদ্ধিমান বসরা ব্যবসার খাতিরে এসব কর্মীর কাজের ক্ষেত্রে নানান ছাড় দেন। এ ধরনের কর্মীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট বিরতি নেন। এতে কর্মশক্তি পূরণ হয়, মনোযোগ বাড়ে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, "বিরতির মাধ্যমে পাওয়া উদ্যমের কল্যাণে কাজ সম্পর্কে সচেতনতা আর মনোযোগ দুই-ই বাড়ে, যার সুফল পাবেন সারাদিন ধরে।"
৮. আত্ম-ব্যবস্থাপনা
সময় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। অফিসের সময়েই কাজ শেষ করতে, নানান কাজে কতটুকু সময় দেবেন-তার একটি হিসাব সকলেই করেন কমবেশি। কিন্তু, আত্ম-ব্যবস্থাপনা নিয়েও কি আপনি সচেতন। এই গুণটি আপনাকে আরো উৎপাদনশীল যেমন করবে, তেমনি আনবে পেশা নিয়ে সন্তুষ্টি, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতেও এর বিকল্প নেই।
আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে চান বলেই 'সফট স্কিল' সম্পন্নরা মাল্টিটাস্কিং করেন না বা একাধিক বিষয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তারা সময়মতো মিটিংয়ে যোগ দেন এবং তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করার বিষয়ে সচেতন থাকেন। কাজের পরিবেশে তারা একটি সীমা মেনে চলেন, সহকর্মীদের অহেতুক খোশগল্পের আসরে যোগ দেওয়ার বিষয়ে 'না' বলতেও পারেন।
যে সময় তারা সবচেয়ে উৎপাদনশীল, সে সময়টি বোঝেন এবং তখনই সবচেয়ে জরুরি বা কঠিন কাজগুলো সারেন।
- সূত্র: ইঙ্ক ডটকম