বাবা হওয়ার পর পুরুষের শরীরেও পরিবর্তন আসে!
মা হওয়ার পর প্রত্যেক নারীর শরীরেই যে পরিবর্তন আসে এ কথা আমাদের সবারই জানা। তবে, শারীরিক এই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় না কোনো পুরুষ কিংবা বাবাকে। তাই অনেকেই মনে করেন, সন্তানের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে বাবারা মায়েদের মতো দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননা। এমনকি স্বয়ং বাবারাও এই ধারণাতেই বিশ্বাসী। কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্নমত দিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের গবেষক অ্যানা মাচিন।
তিনি জানিয়েছেন, মানুষের পিতৃত্ব নিয়ে অধ্যয়নের সময় একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি কীভাবে বাবাদের এই বিস্তৃত ও বদ্ধমূল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তার মতে, সন্তান জন্মদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নারীদেহ কয়েকটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তিত হয়। গর্ভাবস্থা, প্রসব পরবর্তী অবস্থা, বুকের দুধ খাওয়ানো- এ সবকিছুর মাধ্যমে অসংখ্য জৈবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় মায়েদের শরীর, যা সন্তানের বাবার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এর ফলস্বরূপ তারা 'প্যারেন্টিং' বা অভিভাবকত্বের বিষয়ে কম আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। নিজের মনে প্রশ্ন ওঠে, আমি কি একজন 'ভালো' অভিভাবক হতে পারবো? সন্তানদের সঙ্গে কি আমার ভালো বন্ধন গড়ে উঠবে? এ ব্যাপারে যা করতে হবে তা কীভাবে জানবো?
ব্যক্তিগত এবং পেশাগত অভিজ্ঞতা আলোকে অ্যানা মাচিন বলেছেন, বাবারা জৈবিকভাবেই পিতৃত্বের জন্য 'কম প্রস্তুত' থাকেন এমন ধারণা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা কম। অভিভাবকত্বের বিষয়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারও জন্য সহজাত নয় বলেই তিনি মত দিয়েছেন।
বাবারা যে ধরনের জৈবিক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে দিয়ে যান, তা মায়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মতো সরাসরি দেখা না গেলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাবা হওয়ার প্রক্রিয়ায় পুরুষদের মাঝেও আসে পরিবর্তন। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর থেকে সন্তান জন্মদান ও বেড়ে ওঠার এই পুরো প্রক্রিয়ায় পুরুষ ও নারী উভয়েই হরমোনাল এবং মস্তিষ্কের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। আর এর মাধ্যমেই তারা সাধারণ পুরুষ কিংবা নারী থেকে হয়ে ওঠেন বাবা-মা।
মোদ্দাকথা, বাবা হওয়ার বিষয়টিও মা হওয়ার মতোই একটি জৈবিক ঘটনা।
টেস্টোস্টেরন নিঃসরণ
টেস্টোস্টেরন হলো পুরুষ হরমোন। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণা অনুযায়ী, এই হরমোন পুরুষ ভ্রূণের বিকাশ এবং বয়ঃসন্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই হরমোনই মূলত সঙ্গী খুঁজতে পুরুষদের অনুপ্রাণিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষের শরীরে উচ্চ মাত্রায় টেস্টোস্টেরন রয়েছে তারা তাদের সম্ভাব্য সঙ্গীদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কিন্তু একজন সফল বাবা হওয়ার অর্থ হলো, পরিবারের সকল বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া এবং নতুন অন্য সঙ্গীর প্রতি নিজের আকর্ষণকে দমন করা।
এ ব্যাপারে আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী লি গেটলার ফিলিপাইনে ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সী ৬২৪ জন অবিবাহিত নিঃসন্তান পুরুষের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। ২০১১ সালে প্রকাশিত গেটলারের দীর্ঘ ৫ বছরের সেই গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক মাত্রার টেস্টোস্টেরন থাকা ওই পুরুষদের মধ্যে ৪৬৫ জনই গবেষণার পাঁচ বছর সময়কালে বাবা হয়েছিলেন; এবং এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের টেস্টোস্টেরন নিঃসরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। অবিবাহিত বা বিবাহিতদের তুলনায় যারা বাবা হয়েছিলেন তাদের নিঃসরণ গড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ কমে যায়।
বিশ্বব্যাপী বহু গবেষণার ফলাফলে একই তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা। একজন পুরুষের প্রথম সন্তান জন্মের ঠিক আগে এবং ঠিক পরেই টেস্টোস্টেরনের নিঃসরণ হ্রাস পায়। তবে, হ্রাস পাওয়ার এই প্রবণতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা এখনও স্পষ্ট কিছু জানাতে না পারলেও ড. গেটলার জানান, প্রাথমিক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী টেস্টোস্টেরন নিঃসরণ যত বেশি কমবে, অপর একজন মানুষের প্রতি পুরুষের যত্নশীল আচরণে এটি তত বেশি প্রভাব ফেলবে।
ড. গেটলার বলেন, "আমরা দেখতে পেয়েছি, সদ্য বাবা হওয়া কোনো পুরুষের যদি সন্তান জন্মের পরের দিন টেস্টোস্টেরন কম থাকে, তাহলে সে পরবর্তী সময়ে যত্ন নেওয়া এবং শিশু-সম্পর্কিত পারিবারিক কাজে অংশ নেয়।"
পরিবর্তন আসে মস্তিস্কেও
বাবাদের মধ্যে অভিভাবকত্ব তৈরি হওয়া এবং তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আসে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে ২০১৪ সালে ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী পিলিয়ং কিম সদ্য বাবা হওয়া ১৬ জনের ওপর গবেষণা চালান। সন্তান জন্মের প্রথম ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে ওই ১৬ জন বাবার এমআরআই পরীক্ষা করেন তিনি; এরপর আবারও ১২ থকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে একই পরীক্ষা করেন। ড. কিম দেখতে পান, এই সময়ের ব্যবধানে বাবাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা কেবল সদ্য মা হওয়া নারীদের মধ্যেই দেখা যায়। বন্ধন, যত্ন নেওয়া, সহানুভূতি এবং শিশুর আচরণ বোঝা ও প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের কিছু অংশকে পূর্ববর্তী (২ থেকে ৩ সপ্তাহের মাঝে) এমআরআই-এর তুলনায় পরবর্তী (১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ) এমআরআই-এ বেশি সক্রিয় হতে দেখেন কিম।
ড. কিম মনে করেন, মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন বাবাদের অভিভাবক হওয়ার দক্ষতা বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে। শিশুর চাহিদা বোঝা, যত্ন নেওয়া এবং লালন-পালনের প্রতিটি ধাপের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সদ্য মা ও বাবা দুজনকেই যেতে হয়। তবে, যেহেতু পুরুষরা গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের সঙ্গে হরমোনজনিত ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে যান না, তাই এক্ষেত্রে ড. কিম মনে করেন, "সন্তানদের সঙ্গে মানসিক বন্ধন কীভাবে তৈরি করতে হয় তা শেখা একজন পিতা হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
"আর মস্তিষ্কের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে বাবারা এই বন্ধন তৈরির ব্যাপারটি শেখেন ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন", যোগ করেন তিনি।
নতুন মা এবং নতুন বাবা উভয়ে ক্ষেত্রেই সন্তানের মানসিক অবস্থা এবং আচরণগত উদ্দেশ্য বোঝার সময়, এর সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্ক অঞ্চলের সক্রিয়তার ওপর গবেষণা চালিয়েছেন ইসরায়েলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা এবং মা সন্তানের যত্ন নেওয়ার ব্যপারে কিছুটা আলাদা। মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সন্তানের যত্ন নেওয়া, লালন-পালন এবং বিপদ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যে অংশটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, তা 'কোর' বা মূল মস্তিষ্কের অনেক কাছাকাছি। কিন্তু বাবাদের ক্ষেত্রে এটি আবার ভিন্ন। সন্তানের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তাদের মস্তিষ্কের বাইরের দিকের বা প্রান্তের দিকের অংশগুলো বেশি সক্রিয় হয়। পুরুষের মস্তিষ্কের এই অংশ সাধারণত গভীর চিন্তা, লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং সমস্যা সমাধানের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকে।
মস্তিষ্কের সক্রিয়তার ব্যাপারে মা এবং বাবার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও গবেষকরা বলছেন, 'ভিন্ন হলেও সন্তানের সঙ্গে বন্ধনের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো সমানভাবেই শক্তিশালী'। এটি একটি সামাজিক বদ্ধমূল ধারণা যে, বাচ্চারা কষ্ট পেলে বা আঘাত পেলে সবার আগে কেবল মায়ের কাছেই ছুটে যায় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু গবেষণা থেকে জানা যায়, কিছু নির্দিষ্ট 'প্যারেন্টিং আচরণের' পর মা ও বাবাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নিউরোকেমিক্যাল নিঃসৃত হয়, যা আমাদের সমাজের বদ্ধমূল ধারণাগুলো থেকে ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে।
২০১০ সালে ইসরায়েল ভিত্তিক সামাজিক স্নায়ুবিজ্ঞানী রুথ ফেল্ডম্যান ১১২ জন বাবা-মায়ের ওপর একটি সমীক্ষা চালান। সেই গবেষণায় দেখা যায়, সন্তান লালন-পালন ও তাদের যত্ন নেওয়ার সময় নারীদের মধ্যে অক্সিটোসিন হরমোন সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায়। এর বিপরীতে, পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি সর্বোচ্চ হয় যখন তারা সন্তানদের সঙ্গে খেলা করেন। ছোট বাচ্চাদের মস্তিষ্ক তাদের বাবা-মায়ের মতো একই অক্সিটোসিনের মাত্রা অনুকরণ করে বলে মনে করেন গবেষকরা। এর অর্থ হলো, শিশুরা বাবার সঙ্গে খেলার সময় এবং মায়ের কাছ থেকে আদর-যত্ন পাওয়ার সময় অনুরূপ মাত্রার অক্সিটোসিন লাভ করে। আর বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাচ্চারা বারবার ওই একই ধরনের আচরণ পায়, যা তাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাবাদের সঙ্গে খেলাধুলা কেবল সন্তানের সঙ্গে বাবার বন্ধনকে দৃঢ় করে না, এটি শিশুর সামাজিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অবশ্য, পিতৃত্বের নতুন এই গবেষণায় এখনও অনেক পথ চলা বাকি। এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গবেষকরা। বিগত ১০ বছরের গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে, আরও বড় পরিসরে এই গবেষণা চালাতে হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীতে বর্তমান ফলাফলগুলো কতটুকু কার্যকর তা বিশ্লেষণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই পিতৃত্বের জৈবক পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে শক্তিশালী কোনো ফলাফলে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস