ইউরোপের চলমান যুদ্ধ নিয়ে কি আমাদের শ্রেণিকক্ষে আলোচনা হয়?
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন আরম্ভ হওয়ার পর থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের অগণিত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন ইতালির বলোগনা শহরের একটি হাইস্কুলের ভূগোল শিক্ষক সান্দ্রো পেল্লিসিওত্তা।
শিক্ষার্থীরা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ প্রশ্নই করছেন তাকে; এই যেমন—'আপনি যদি পুতিনের জায়গায় থাকতেন তাহলে কি এই আক্রমণটা করতেন?' নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেল্লিসিওত্তা বলেন, "সত্যি বলতে এ বিষয়ে উল্টোপাল্টা জবাব দিতে আমার ভয়ই করে।"
ব্রিটিশ শিক্ষক টারা হার্মারেরও একই অবস্থা। শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করামাত্র শিক্ষার্থীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করে তাকে। প্রশ্নগুলো অনেকটা এরকম- 'রাশিয়া তো অনেক বড় দেশ, তাহলে তারা আরও জমি চায় কেন?', আরেক শিশু হয়তো জিজ্ঞেস করলো, 'বেশিরভাগ সময় পুরুষেরাই কেন পাগলাটে ধরনের হয়?' কিংবা তাদের প্রশ্ন- 'আপনি হলে কি নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ করতেন?'
নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে সমগ্র ইউরোপজুড়েই দেখা গিয়েছে এর প্রভাব। পশ্চিমা দেশগুলোর শ্রেণিকক্ষও এর আওতামুক্ত নয়। কৌতূহলী শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই এ যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করছেন শিক্ষকদের। আর হ্যাঁ, শিক্ষকেরাও চটপট তাদেরকে জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে আকাশচুম্বী, দেশীয় গণমাধ্যমে চলছে যুদ্ধ নিয়ে চর্চা, একের পর এক আপডেট পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। দেশের টিনেজার ও তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটক; বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই অ্যাপ ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি। সেই টিকটকেও ঘুরে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আর বহুদূরের কোনো ঘটনা নয়। বরং আমাদের জীবনেও এর স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা কতখানি জানেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে? তাদের মনে কি প্রশ্ন উদয় হয়? চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রসঙ্গে শিক্ষকরা কিভাবে মিথস্ক্রিয়া করছেন শিক্ষার্থীদের সাথে? এসব প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আমরা।
রাজধানী ঢাকার একটি হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে তাসমিয়া। লোকাল বাসে চড়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয় তাকে। গত দুই মাসে তার বাস ভাড়া বেড়ে ৫ টাকা থেকে হয়েছে ১০ টাকা। টিফিনের খাবারের দামও গিয়েছে বেড়ে। তাই তাসমিয়াকে এখন আগের চেয়ে বেশি হাতখরচ দিতে হয় তার মা-বাবাকে।
তাসমিয়াকে প্রশ্ন করলাম, তুমি কি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে জানো? কখনো জানতে চেয়েছো কেন সব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে?
তাসমিয়া উত্তর দিলো, "আমাকে পরীক্ষায় খাতায় দুইবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। আমার আশেপাশে আমি যা দেখেছি এবং বইয়ে যা পড়েছি তা থেকে ধারণা নিয়ে আমি লিখেছি।"
জানতে চাইলাম, তুমি কি ক্লাসে এটা নিয়ে কথা বলো? শিক্ষকদের কখনো জিজ্ঞেস করেছো? বিশ্বে এখন কি চলছে বা ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে, এগুলো নিয়ে কি তুমি শিক্ষকদের সাথে কথা বলো?
"আমাদের শিক্ষকরা সিলেবাসের বাইরে কোনোকিছু নিয়ে আলোচনা করেন না। তারা ক্লাসে আসেন এবং পাঠ্যবইয়ের বিষয় ছাড়া আর কিছু নিয়েই কথা বলেন না। আর আমাদেরও তাদেরকে অন্যকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় না", বললো তাসমিয়া।
কিন্তু ক্লাসরুমে যে সিলেবাসের বাইরে একেবারেই কিছু আলোচনা হয় না, তা কিন্তু নয়।
শ্রেণিকক্ষে 'বিটিএস আর্মি' বনাম ব্ল্যাকপিংক ভক্তদের মাঝে দুই দলে ভাগ হয়ে চলে তুমুল বিতর্ক। টিকটক বা ইনস্টাগ্রামে কখন কি ভাইরাল হলো, তা নিয়েও চলে আলোচনা। শিক্ষক যখন ক্লাসে থাকেন না, তখন নিজেদের দেখা কন্টেন্টগুলো নিয়েই চলে হট্টগোল।
কিন্তু যখনই শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করেন, তাদের সেই হৈচৈ-উত্তেজনা ও আগ্রহ চুপসে যায়। কারণ শিক্ষকরা তাদের সাথে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কিছুই আলোচনা করেন না।
দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে কি কি বিষয়ে আলোচনা করেন তা জানার জন্য যেসব শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমরা, তাসমিয়া তাদেরই একজন। বিশেষ করে, দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শিক্ষকদের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি আমরা।
কিন্তু ডজনখানেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর দেখা যায়, আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলোতে আজও শুধু পাঠ্যক্রমভিত্তিক পড়ালেখাই চলছে।
বহির্বিশ্বের ক্রমপরিবর্তনশীল পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের শ্রেণিকক্ষের উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি বললেই চলে। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী- কেউই যুদ্ধ অথবা অন্যান্য ইস্যু নিয়ে ক্লাসে প্রশ্ন তোলেন না। একইভাবে, অভিভাবকেরাও চান ক্লাসে শুধুমাত্র সিলেবাসের পড়া নিয়েই আলোচনা হোক।
উদাহরণস্বরূপ তাসমিয়ার মা লুৎফুন নাহারের কথা বলা যাক। তিনি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে একটি এনজিওভিত্তিক স্কুলের শিক্ষিকা। এই স্কুলের শিক্ষার্থী মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এবং এদের অনেকেই আশেপাশের বস্তিতে থাকে। স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এখন প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কষাঘাতে জর্জরিত এসব শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার। কিন্তু লুৎফুন নাহার কখনোই এই ইস্যুটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রশ্ন পান না।
নাহার বলেন, "আমাদের শিশুরা মূলত পরিবার দ্বারা প্রভাবিত। বিভিন্ন ইস্যুতে মা-বাবার যে ধারণা, তারা যাদেরকে দোষী ভাবেন, সন্তানরাও তেমনটাই ভাবে। পরিবারের প্রোথিত বিশ্বাস থেকে কাউকে দোষারোপ করার একটা ফল্টলাইন এখানে রয়ে গেছে। সে কারণে আমরা শ্রেণিকক্ষে এ ধরনের বিষয়ে আলোচনা করি না।"
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো কয়েকজন শিক্ষক জানান, সরকার-বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত বলে চিহ্নিত হবেন বা ঝামেলায় পড়বেন- এমন ভয় থেকে তারা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করেন না।
রাজবাড়ির একজন কলেজ শিক্ষার্থী, নুসরাত জাহানকে প্রশ্ন করেছিলাম, বিশ্বে চলমান এই বৃহৎ যুদ্ধ নিয়ে তার ধারণা আছে কিনা।
নুসরাতের ভাষ্যে, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা শুনেছেন ঠিকই। কিন্তু কারা কোন দেশে যুদ্ধ করছে, যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিনা এসব তিনি কিছুই জানেন না।
কিন্তু তিনি জানালেন, মাঝেমধ্যে তার মনে প্রশ্ন জাগে ঠিকই। শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চান। কিন্তু সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করলে শিক্ষক বিরক্ত হবেন কিনা, সেই ভয়ে জিজ্ঞেস করেন না।
"আমি আসলে শিক্ষকদের কিছুই জিজ্ঞেস করি না", বলেন নুসরাত।
কিন্তু তার মানে এই না যে শিক্ষার্থীদের মনে কোনো কৌতূহল নেই। কৌতূহল তাদের আছে। কিন্তু তাও কেন শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করেন না? আর শিক্ষকরাই বা কেন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত প্রশ্ন সাদরে গ্রহণ করেন না?
আমরা কি এই সংস্কার সেই মহাভারতের যুগ থেকে বহন করে আসছি? যেখানে একলব্য তার গুরু দ্রোণাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করতেন না; এমনকি গুরুদক্ষিণা হিসেবে নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন গুরুকে।
নাকি পশ্চিমা বিশ্বের শ্রেণিকক্ষে বইছে সক্রেটিস-প্লেটোর জ্ঞানের ধারা, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রশ্ন-উত্তর পর্বই ছিল শিক্ষার প্রক্রিয়া?
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, "যদিও আমাদের শিক্ষানীতিতে সৃজনশীল শিক্ষা ও শিক্ষকতা পদ্ধতির উল্লেখ আছে, কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা তা অনুসরণ করেন না। কারণ আমাদের দেশে শিক্ষকরা সেরা পারিশ্রমিকভুক্ত কর্মী নন। তাই তারা নিজেদের সময় ও শক্তি এই কাজে ব্যয় করতে চান না।"
দেশে সবার জন্য সমান শিক্ষা প্রক্রিয়া অনুপস্থিত বলে সমালোচনা করে তিনি বলেন, "আমাদের দেশে তিনটি আলাদা শিক্ষা প্রক্রিয়া আছে- প্রথাগত শিক্ষা, ইংরেজি মিডিয়াম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতিকে আবার ইংরেজি ও বাংলা ভার্সনে ভাগ করা হয়েছে। এর ফলে পাঠ্যক্রমে অসমতা এবং জ্ঞানের বিকীর্ণতা তৈরি হয়েছে।"
রাশেদা কে চৌধুরীর সাথে সহমত প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইআর) এর পরিচালক, অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার। তিনি বলেন, শিক্ষকদের যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না বলেই তারা সৃজনশীলতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না এবং পশ্চিমাদের মতো শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন-বিতর্ককে উৎসাহিত করছেন না।
সৈয়দা তাহমিনা বলেন, "তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কিভাবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ, শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন ও ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো ভালো বোঝাপড়া সৃষ্টি করা ইত্যাদি। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরেই তারা সেই অনুপ্রেরণা ও নিবেদিতপ্রাণ স্বভাবটি হারিয়ে ফেলেন। কারণ তাদের শ্রমের যথার্থ পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না।"
আর এসব কারণেই মাঠে-ময়দান থেকে ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যুদ্ধ সমানতালে চললেও, আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব মাধ্যমে সক্রিয় থাকলেও, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের কাছে নেই তাদের কোনো প্রশ্ন। আর শিক্ষকদেরও তাদেরকে বলার মতো কিছুই নেই।
তাই পাঠক্রমের বাইরের সব বিষয় উঠে আসে না শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ায়।