দুই বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও শেষ হয়নি দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের হিসাবনিকাশ
যেকোনো যুদ্ধ শেষ হলে বিজিত দেশগুলোকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। দুটো বিশ্বযুদ্ধেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া-নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সাধারণত এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় অর্থ বা দ্রব্যের মাধ্যমে। প্রায় ৯০ বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এখনো অনেক দেশ পুরোপুরি দিতে পারেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি হেরে যায়। এ যুদ্ধের শেষে অনেকগুলো চুক্তি করা হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল গ্রিস, ইসরায়েল, ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
এ মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির একমাত্র দেশ হিসেবে যুদ্ধে জিতেও জাপানকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সিভিল লিবার্টিজ অ্যাক্ট-এর আওতায় এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
চলুন দেখে নেওয়া যাক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দরুন কোন দেশ কাকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া এখনো বাকি আছে।
জার্মানি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জার্মানির। তবে মোট কী পরিমাণ অর্থ দেশটিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনান্য দেশকে দিতে হবে, তা আজও অস্পষ্ট। এর কারণ যুদ্ধের পর ইউরোপ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় মিত্রশক্তির দেশগুলো বিভিন্ন বার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল জার্মানির কাছে।
মনে করা হয়, প্রাথমিকভাবে জার্মানির জন্য ৩২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছিল মিত্রশক্তি। কিন্তু পরে টের পাওয়া গেল, জার্মানির পক্ষে ওই সময়ে এত বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া দেশটির ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের বোঝাও ছিল তখন।
১৯৫২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত জার্মান এক্সটার্নাল ডেটস কনফারেন্সে জার্মানির যুদ্ধোত্তর ক্ষতিপূরণ ১৬.২ বিলিয়ন ডয়েশমার্ক থেকে কমিয়ে সাত বিলিয়ন ডয়েশমার্ক (বর্তমানে তিন বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ) হিসেবে স্থির করা হয়। এছাড়া এর যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ক্ষতিপূরণ কমিয়ে ৭.৩ বিলিয়ন ডয়েশমার্কে আনা হয়।
এসবের পাশাপাশি জার্মানিকে নিজেদের শক্তি খর্ব করতে হয়। দেশটিকে মিত্রশক্তির মালিকানাধীন চারটি অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হয়। এসব অঞ্চলগুলোর বেসামরিকীকরণ করা হয় ও অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলা হয়।
১৯৫২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জার্মানি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিতে পশ্চিম জার্মানি ইসরায়েলকে বিভিন্ন কিস্তিতে তিন বিলিয়ন ও ওয়ার্ল্ড জুয়িশ কংগ্রেসকে ৪৫০ মিলিয়ন ডয়েশমার্ক দেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়।
ইসরায়েলকে জার্মানি ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলেও ২০০৯ সালে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী ইয়ুভাল স্টেইনিৎজ ঘোষণা করেন, তিনি চেয়েছিলেন হলোকাস্টের সময় ইহুদিদের জোর করে শ্রমক্যাম্পে কাজ করানের দায়ে জার্মানি ৪৫০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ইউরো ক্ষতিপূরণ দেবে।
জাপান
জাপানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বেশ জটিল একটি ব্যাপার ছিল। যুদ্ধের পর মিত্রশক্তির হিসাব থেকে জানা যায়, জাপান এর জাতীয় সম্পদের ৪২ শতাংশ হারিয়েছে।
১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে 'ট্রিটি অভ পিস উইদ জাপান' নামের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ওই চৃক্তি অনুযায়ী কিছু শর্তসাপেক্ষে জাপানকে এর সম্পদ ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের কাছে স্থানান্তর করার কথা বলা হয়। রেড ক্রস ওই সম্পদ লিকুইডেট করে তা থেকে প্রাপ্ত তহবিল বিভিন্ন জাতীয় সংস্থায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সাবেক যুদ্ধবন্দীদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে জাপান সরকার ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসকে ৬.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে সম্মত হয়।
ইতালি (৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
জার্মানি ও জাপানের পাশাপাশি অন্যতম অক্ষশক্তি ছিল ইতালি। এক শান্তি চুক্তির অধীনে ইতালি যুগোস্লাভিয়াকে ১২৫ মিলিয়ন, গ্রিসকে ১০৫ মিলিয়ন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১০০ মিলিয়ন, ইথিওপিয়াকে ২৫ মিলিয়ন ও আলবেনিয়াকে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ফিনল্যান্ড (৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যেসব দেশ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার তালিকায় ছিল, তাদের মধ্যে কেবল ফিনল্যান্ডই এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেছে। ১৯৫২ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করে।
হাঙ্গেরি (৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
শান্তিচুক্তি অনুযায়ী হাঙ্গেরির সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও চেকস্লোভাকিয়া ও যুগোস্লাভিয়াকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা রয়েছে।
রোমানিয়া (৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হয়েছিল রোমানিয়ার। চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৪৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে আট বছর বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে ঐ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল।
বুলগেরিয়া (৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
গ্রিস ও যুগোস্লাভিয়াকে যথাক্রমে ৪৫ মিলিয়ন ও ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার জন্য বুলগেরিয়াকে বলা হয়। আট বছর মেয়াদে পণ্যের মাধ্যমে ওই ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র: সিএনবিসি