বায়োস্কোপের নেশায় জলিলের চার দশক
"তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ
বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না"
কয়েক দশক আগেও গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মেলায় নিত্যদিনে বায়োস্কোপের নেশা জেঁকে ধরত ছেলে-বুড়োদের। রঙ-বেরঙের চলতি ছবির এই বাক্সের লেন্সে চোখ লাগিয়ে দেশ-বিদেশের অজানা দৃশ্য দেখার সুখ মিলত এক নিমিষে। দিন বদলের সঙ্গে প্রযুক্তির বদলে ঘরে ঘরে এলো টিভি, সিডি, ডিশ লাইন। এরপর তো হাতে হাতে চার-পাচ ইঞ্চির মোবাইল স্ক্রিনেই এঁটে গেল পুরো বিশ্ব! এত জাঁকজমকের ভিড়ে নিতান্তই সেকেলে এক বোবা বাক্সের প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়ে গেছে কবেই! এই বোবা বাক্সের ছবির সাথে ছন্দ-সুরের মিতালিতে আসর জমাতেন যারা তারাও কি হারিয়ে গেছেন এর সাথেই?
শহরাঞ্চল বা গ্রামীণ পথ কোথাও-ই আজকাল সাধারণ দিনে চোখে পড়ে না কোনো বায়োস্কোপওয়ালা। কালেভদ্রে হয়তো কোনো বিশেষ মেলা-আয়োজনে আমন্ত্রণ করে আনা হয় কাউকে। নির্দিষ্ট দিনের চুক্তিতে এসে খেলা দেখিয়ে আবার নিজ নিজ জগতে ফিরে যান তারা। বায়োস্কোপ দেখানোর কাজটা এখন আর তাদের মূল পেশা নয়। বাংলা একাডেমীর বৈশাখী মেলায় দেখা হয়েছিল এমনই এক বাক্সের কারিগরের সাথে। রাজশাহীর বাগমারার আব্দুল জলিল মণ্ডল বায়োস্কোপওয়ালা হিসেবে বেশ পরিচিত মুখ।
হারিয়ে যাওয়া এই বিস্ময় বাক্সের সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। বাবা-চাচার আমল থেকেই তার বায়োস্কোপ দেখানোর পেশার শুরু। নানা সময়ে নানা পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে বিশেষ ফিচার। টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারেও দেখা গেছে তার মুখ।
দুপুরের বিশ্রাম শেষে সদ্যই জাদুর বাক্সটি খুলে কাজের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। রঙচঙে প্যান্ট, গলায় ঝিনুকের মালা, হাতে ব্রেসলেট, মাথায় বাহারি জরিওয়ালা টুপি আর চোখে লাল ফ্রেমের কালো চশমায় সেজে ডুগডুগি বাজিয়ে দর্শক আকর্ষণের প্রস্তুতিতে ছিলেন। একটু গল্প করা যাবে কি না জিজ্ঞেস করতেই বললেন আগে বায়োস্কোপের খেলা দেখে নিতে। ২০ টাকায় এক শো!
এইবারেতে দেখরে ভালো, ডানে বামে নজর করো
দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ আছে
এইবারেতে দেখরে ভালো, হাজার হাজার সৈন্য আছে
এইবারেতে দেখরে ভালো, আরো কিছু রইয়া গেছে
এইবারেতে দেখরে ভালো, সোনারগাঁও সামনে আছে
ঈশা খানের বাড়ি আছে, জাদুঘর সামনে আছে
এইবারেতে দেখরে ভালো, দার্জিলিং-এর পাহাড় আছে
পাহাড়ের ঝর্ণা আছে, বনে রাজা সিংহ আছে!
বাক্সের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেশ-বিদেশের নানা দর্শনীয় আর ঐতিহাসিক স্থানের ছবির দেখিয়ে সঙ্গে খঞ্জনি আর ডুগডুগি (জলিলের ভাষায় প্রেমজুড়ি আর ডুমরু!) বাজিয়ে দুলতে দুলতে দুলতে ভাঙ্গা গলায় গাইলেন এমন ধারা বিবরণী। গান শেষেই জানালেন ঢাকায় এসে রাতে থাকছেন বাংলা একাডেমির বারান্দায়, গরমে ঘেমে আর ঠান্ডা পানি খেয়ে গলা বসে গেছে। তাই সুর করে গাইতে পারছেন না ঠিকমতো। তার উপর মেলা প্রাঙ্গণে তার বায়োস্কোপের কিছু দূরেই বিশাল সাউন্ডবক্সে বাজানো হচ্ছিল মেলার গান। লাউড স্পিকারের শব্দে তার গাওয়া গানটি প্রায় চাপা পড়েই যাচ্ছিল।
এরইমধ্যে একজন তরুণী কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে এলো বায়োস্কোপের কাছে। জলিল মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করলেন তার ভিডিও করা যাবে কি না। তাকেও আগে বায়োস্কোপ দেখে নিতে বললেন জলিল। শো শুরু হওয়ার পর অবশ্য নিজে দেখার চেয়ে ভিডিও করতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন সেই তরুণী। মণ্ডল সাহেব তাতে বেশ বিরক্তই হলেন বোঝা গেল।
তরুণীটি চলে যেতেই বললেন, "অনেকেই ছবি তুইলে চইলা যায়, খেলা দেখে না। আমার তো এসবে লাভ নাই কোনো। অনেক বড় বড় পেপারে আমার খবর ছাপাইছে, টিভিত দেখাইছে। তাতে তো আমার অবস্থার বদল হয় নাই। আমি তো বড়লুক হই নাই। কেউ দুই পয়সা সাহায্য করে নাই। বড়লুক হমু না, প্রচার করার দরকার নাই। আমার দেহ ভালো থাকলে ১০ টাকা ইনকাম করতে পারব। কর্মই হইলো বড় জিনিস। কর্ম করলেই ফল পামু। কর্ম করমু না, ফল পামু না।"
কিছুটা ফাঁকা সময় পেয়ে জলিল শুরু করলেন নিজের গল্প বলা। জানালেন তার বাবা-চাচাদের সময়ে বায়োস্কোপের তুমুল জনপ্রিয়তার কথা। যুগ-যুগান্তর ধরে তার পরিবারে বায়োস্কোপ দেখানোর পেশা। বাবা আর চাচা মিলে গ্রামে-গঞ্জের পথে পথে ঘুরতেন বায়োস্কোপ নিয়ে। বায়োস্কোপের রঙিন বাক্সটি দেখেই ছেলে-মেয়েরা ছুটে আসতো ঘর থেকে। দুই আনা, চার আনা, চাল, ডাল বা অন্য ফসলের বিনিময়ে জাদুর বাক্সে চোখ রাখত তারা। সেসময় বায়োস্কোপ ছিল সিনেমার মতো আকর্ষণীয়।
জলিলের বয়স যখন ১০ কিংবা ১২ বছর, তখন থেকেই বাবা-চাচাদের সাথে বায়োস্কোপ নিয়ে ছুটতেন পথে প্রান্তরে। "বাপ-চাচায় খেলা দেখাইত, বাক্স মাথায় করে নিয়া যাইত, আমি পয়সা, চাইল-ডাইল তুলতাম। বেশি বোঝা হইয়া গেলে মাথায় করে নিয়া যেতাম। অনেক বাড়িতে জোয়ান মেয়েরা পুরুষদের সামনে বের হইতে শরম পাইত। তখন বাপ-চাচার বদলে আমিই বায়োস্কোপ চালায়ে দেখাইতাম তাদের। গ্রামে গ্রামে যাইয়া ক্ষুদিরামের ফাঁসি, বেদের মেয়ে জোসনা, রহিম রূপবানের ছবি, রাজা বাদশার ছবি দেখাইত বাপ-চাচারা। তখন টিভি সিডি ছিল না, এই বায়োস্কোপই দেখত মানুষ," স্মৃতিচারণ করছিলেন জলিল। বায়োস্কোপ দেখানোর সাথে সাথে গান গাওয়া শিখেছেন বাবার কাছেই।
পৌষ সংক্রান্তিতে শীতের মাঝে গ্রামাঞ্চলে নানা মেলা বসতো। গরুর লড়াই, মোরগ লড়াইয়ের পাশাপাশি সেসব মেলায় বায়োস্কোপ দেখার জন্য জমতো ভিড়। সেসময়টায় জলিলের পরিবারে আয় হত ভালো।
বাবা বকশি মণ্ডল মারা যান তার কৈশরেই। আশির দশক থেকে জলিল মণ্ডল নিয়মিত বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করেন। ছোটবেলা থেকে অভাবের সংসারে বড় হয়েছেন। "এক মুঠ ভাতের দুঃখে লেখাপড়া হইলো না। কোনো দিন ডাইল-ভাত খাইতে পারছি, কোনো দিন না খায়ে রাত পার করে দিছি৷ কপালে অভাব কোনোদিন ঘুচল না," ভারাক্রান্ত স্বরে বলছিলেন জলিল।
নিজে পড়ালেখা না করতে পারলেও সন্তানদের ক্ষেত্রে আপোষহীন তিনি। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী, ছোট মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, আর একেবারে ছোট ছেলের বয়স পাঁচ বছর। যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন সন্তানদের লেখাপড়ায় কোনো সমস্যা হতে দিবেন না বলে জানান জলিল। পড়ালেখা শেষে তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ অবশ্য এই পেশায় আসতে চায় না আর।
বছরে খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন মাস নানা আয়োজনে বায়োস্কোপ দেখান জলিল মণ্ডল। বাংলা একাডেমির বৈশাখী মেলা ছাড়াও সোনারগাঁওয়ের লোকশিল্প মেলা, নীলফামারীর চারুকলা উৎসবে আমন্ত্রণ পান বছর বছর। জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা করে মেলা চলাকালীন দৈনিক ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় হয় বায়োস্কোপ দেখিয়ে৷ কয়েকমাসের কাজের টাকা জমিয়ে বাড়ি গিয়ে বছরের বাকি সময় করেন কৃষিকাজ৷ নিজের কোনো জমি না থাকায় অন্যের জমিতে দৈনিক মজুরিতে খাটতে হয় তাকে।
নানা জায়গার মেলায় বায়োস্কোপ দেখাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে ক্ষতির শিকারও হন জলিল মণ্ডল। "এলাকার ছেলেপেলেরা অনেকবার টাকা না দিয়েই চলে যায়। টাকা চাইতে গেলে গালাগালি করে। আমি গরীব মানুষ। টাকা না পেলি চলবে ক্যামনে?" বলেন তিনি।
জলিলের বাবার সময় এলাকায় তাদের পরিবার ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন বায়োস্কোপওয়ালা ছিল। এতদিনে তারা সবাই কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আশেপাশের এলাকায় একমাত্র জলিল মণ্ডলই টিকে আছেন বায়োস্কোপ দেখানোর কাজে। "এই ঐতিহ্য ধইরা রাখার জন্য সরকার, চাকরিজীবী, টিভি চ্যানেল কারো কাছ থেকে জীবনে সাহায্য পাই নাই। নিজের ভালো লাগে দেখেই কাজ কইরে গেছি। মইরা গেলে কেউ মনেও রাখব না। আমার সাথে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যও হয়ত নাই হইয়া যাবে," আক্ষেপের সুরে বলছিলেন জলিল মণ্ডল।
ছোটবেলায় বাবা-চাচার সাথে থেকে বায়োস্কোপের যে নেশা মনে জেগেছিল তার প্রভাব এখনো জীবনে বয়ে চলছেন জলিল। "ছেলেপেলেকে খেলা দেখায়ে আনন্দ পাই। এই আনন্দ মরার আগ পর্যন্ত পাইতে চাই," বলেন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার আশায় এখনো প্রতিবছর নতুন নতুন ছবি লাগান বায়োস্কোপে, নিয়ম করে মেরামত করান বাক্স।