মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কঙ্কাল পায় কোথা থেকে!
বাচ্চাকালে গল্প শুনতাম অমুক ডাক্তার কঙ্কাল নিয়ে ঘুমায়, কঙ্কালের খুলিতে নাকি মুড়িও খায়। ডাক্তারি পড়াশোনার জন্য অপরিহার্য কঙ্কালের ব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে এমন জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের কাছে ভয়ের বিষয় হলেও মানব দেহের সাথে ডাক্তারদের ভালোভাবে পরিচিত হতে হলে কঙ্কাল নিয়ে ভালো জানাশোনার বিকল্প কিন্তু নেই। প্রতি বছর এদেশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় ১০-১১ হাজার শিক্ষার্থী। এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য কঙ্কাল কিভাবে জোগাড় হয় তা নিয়ে আছে নানা রহস্য।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মানব কঙ্কাল কেনা-বেচা অবৈধ। তবে বাস্তব জীবনে এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায় খুব কমই। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অহরহ চলে কঙ্কালের ব্যবসা। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কঙ্কাল সংগ্রহের প্রক্রিয়ার দিকে দেখলে এই চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ময়মনসিংহ মেডিকেলের চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী নূযহাত জাহান মীম বলেন, 'মেডিকেলের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে এনাটমি পড়ার জন্য আমাদের কঙ্কালের দরকার হয়। বেশীরভাগ শিক্ষার্থীই মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর কোনো সিনিয়র শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কঙ্কাল কিনে নেন। সাধারণত দ্বিতীয় বর্ষের পর পড়ার জন্য আর কঙ্কালের দরকার হয়না। সিনিয়র শিক্ষার্থীদের পড়া শেষ হয়ে গেলে তারা সেটি নতুন শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করে দেন। সাবধানতার সাথে ব্যবহার করলে এক সেট কঙ্কাল অনেক বছর ধরে পড়া যায়।'
বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য কঙ্কালের চাহিদা পূরণ সবসময় অবশ্য সিনিয়র শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে হয়ে উঠে না। যারা পুরোনো কঙ্কাল জোগাড় করতে পারেন না তাদের কাছে নানাভাবে অন্যান্য সূত্র কঙ্কাল সরবরাহ করে থাকে। যার কোনো স্বচ্ছ ব্যবস্থা নেই।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন ডাক্তার আফসানা ইয়াসমিন বলেন, 'কঙ্কাল কেনাবেচা করা পৃথিবীর সব দেশে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে এই নীতি তেমন কার্যকরী না। তাই শিক্ষার্থীরা নানা উৎস থেকে সহজেই কঙ্কাল জোগাড় করে নিতে পারে। সিনিয়র শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া ছাড়াও তারা হাসপাতালে থাকা দালালদের কাছে টাকা দিয়েও কঙ্কাল কিনে নিতে পারে।'
দালালরা কীভাবে কাদের কাছ থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করে সে বিষয়ে কিন্তু কেউ স্পষ্ট বক্তব্য দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছেন হসপাতালে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশগুলো থেকে কঙ্কাল বানানো হয় অনেক সময়। আবার অনেকের কথাতেই ইঙ্গিত মেলে কঙ্কাল নিয়ে অবৈধ ব্যবসার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেলের এক ডাক্তার বলেন, 'দেশের অনেক স্থানেই প্রতিনিয়ত কবর থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনা সংবাদে আসে। এই চুরি হওয়া কঙ্কালের এক অংশ কিন্তু মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কাছেই আসে। কঙ্কালের এসব উৎস নিয়ে সবাই জানে। কিন্তু এগুলো ওপেন সিক্রেট। এর সাথে অনেক বড় বড় হাত জড়িত থাকে।'
ডাক্তার আফসানা ইয়াসমিন বলেন, 'অন্যান্য দেশে মেডিকেল পড়ালেখায় আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল ব্যবহার হলেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এখনও সব আসল কঙ্কালই ব্যবহার করে। কারণ বাংলাদেশে উন্নতমানের আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল এখনো পাওয়া যায় না। যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো আসল কঙ্কালের ধারেকাছেও না। তাই প্র্যাকটিকালভাবে শেখার জন্য আসল কঙ্কালই ভরসা।'
নূযহাত জাহান মীমের মতে, 'উন্নতমানের আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালের দাম অনেক বেশি। একটা ভালো মানের আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল বাংলাদেশি টাকায় ৬০-৭০ হাজারে পাওয়া যায়। অন্যদিকে আসল কঙ্কাল পুরোনো হলে দাম পড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। আর নতুন কঙ্কালের দাম হয় ৪০-৪৫ হাজার টাকা। আর যত উন্নমানেরই হোক, আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু বৈসাদৃশ্য থেকেই যায়। তাই মেডিকেলে পড়ার জন্য এদেশে আসল কঙ্কালই প্রেফার করা হয়।"
দেশের মার্কেটের আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালগুলো কেমন হয় তা জানতে খোঁজ নেওয়া হয় সরেজমিনে। রাজধানীর টিকাটুলি বিজ্ঞান মার্কেটে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে আমদানি করা আর্টিফিশিয়াল কংকাল বিক্রি করে থাকে। প্যারাডাইস সায়েন্টেফিক কোম্পানি এর মধ্যে অন্যতম। তাদের কাছে থাকা আর্টিফিশিয়াল কংকালগুলো পিভিসি ম্যাটেরিয়ালে তৈরি।
প্যারাডাইসের কর্মকর্তা সুমন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বছরে তাদের প্রতিষ্ঠানে ১৫০ থেকে ২০০টি কঙ্কাল বিক্রি হয়। এসব কঙ্কালের ক্রেতা সাধারণত বিভিন্ন নার্সিং ইন্সটিটিউট ও মেডিকেল সম্পর্কিত ইন্সটিটিউট। সরাসরি মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের এসব কঙ্কালে আগ্রহ নেই।
মোটামুটি ১২-১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া এসব কঙ্কাল আসল কঙ্কালের কাছাকাছিও হয় না দেখতে। তাই এসব দোকানের টার্গেট কাস্টমারের তালিকায় মেডিকেল শিক্ষার্থীরা থাকেন না।
বিজ্ঞান মার্কেটের আরেক প্রতিষ্ঠান জোনাকি সায়েন্টিফিক স্টোরের সাথে কথা বলেও পাওয়া যায় একই তথ্য। তাদের কাছে ২৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০০ টাকার মধ্যে আর্টিফিশিয়াল কঙ্কাল পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলো মেডিকেল স্টুডেন্টদের পড়ার উপযোগী না বলে জানান জোনাকি সায়েন্টিফিক স্টোরের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম।
নজরুলের ভাষ্যে, 'দেশে আমদানী করা আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালগুলো সত্যিকারের মানব কঙ্কালের মডেল হিসেবে ব্যবহারের উপায় নেই। সাইজ, গঠন, ওজন কোনো দিক থেকেই এগুলো বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। এসব কঙ্কাল স্টাডি করে ডাক্তারি পড়ালেখা সম্ভব না। আর্টিফিশিয়াল কঙ্কালের মধ্যে যেগুলো নিখুঁতের মতো তৈরি হয় সেগুলোর দাম অনেক বেশি। আমাদের বাজারে তাই এগুলোর চাহিদা তৈরি হয়নি।'
মানব কঙ্কালের অবাধ কেনা-বেচা যতদিন চলছে ততদিন দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় কঙ্কাল জোগাড় করতে বিকল্প কোনো রাস্তা তৈরি হবে না। দেশে আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ ঘটিয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের কঙ্কাল জোগাড় করার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তোলা সম্ভব।