ফেসবুক ও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা: রাজনৈতিক জনসংযোগে নতুন জোয়ার?
ফেসবুকে দারুণ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে অনুসারীর সংখ্যা সাড়ে ১৭ লাখের বেশি। ফেসবুকে বিভিন্ন উপলক্ষে প্রায়ই নিজের 'স্টাইলিশ' ছবি প্রকাশ করতে দেখা যায় তাকে।
এ বছরের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নিজের সরকারি বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ১০টি ছবি দিয়ে অনুসারীদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান তিনি। সেই পোস্টে রিঅ্যাকশন পড়ে ১ লাখ ২০ হাজার, মন্তব্য ২৪ হাজার। এখন পর্যন্ত তার ওই পোস্ট সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষ শেয়ার করেছেন।
অজস্র মন্তব্যের মধ্যে বেশিরভাগই কাদেরের শুভাকাঙ্ক্ষীদের। তার মধ্যে কারও কারও মন্তব্যে আবেগ ও উৎসাহের রেশটা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা বেশিই। যেমন জনৈক মোহাম্মদ জাভেদ আহমেদ মন্তব্য করেছেন, 'শুভ নববর্ষ প্রেমিক পুরুষ'।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য জন্য ওবায়দুল কাদেরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে তার জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ ওয়ালিদ ফাইয়েজের কাছে মন্ত্রীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচরণের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রী সাধারণত বিভিন্ন রাজনৈতিক শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও ব্যক্তিগত ছবি পোস্ট করেন।
'ফটোগ্রাফার ছবিগুলো তোলেন, আর স্যার নিজে ফেসবুকে ছবিগুলো আপলোড করেন,' বলেন ফাইয়েজ।
সড়ক পরিবহন ও সেতু বিষয়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এসব কেতাদুরস্ত ছবিতে প্রায়ই মজেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনুসারীরা। এর আগে ঈদের সময়ও মন্ত্রীর দুটি আলাদা আলাদা পোস্ট ৭৮ হাজার ও ৫৩ হাজার রিঅ্যাকশন পেয়েছিল অনুসারীদের কাছ থেকে।
নতুন ধারা: রাজনীতিবিদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ক্রমেই ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। নিজেদের ভোটারদের কাছে পৌঁছানো, রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা ও জনগণের ভাবনা জানা—এসব উদ্দেশ্যেই তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সক্রিয় হচ্ছেন।
এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক যোগাযোগের নতুন এ ঢেউ থেকে রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ—দুপক্ষই উপকৃত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মো. আসাদুজ্জামান 'বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার: রাজনৈতিক যোগাযোগের ডিজিটাল মোড়' শীর্ষক এক গবেষণায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ১০ জন নির্বাচিত নেতার (জ্যেষ্ঠ, মধ্যম সারি ও ছাত্রনেতা) ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের ফেসবুক পোস্ট ও তারা ফেসবুকে কী শেয়ার করছেন, সেসবের বিশ্লেষণ করেছেন।
ওই গবেষণার জন্য নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরা হলেন—আওয়ামী লীগের মাহবুবউল আলম হানিফ, দীপু মনি, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাইফুর রহমান সোহাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচিত নেতারা হলেন শামসুজ্জামান দুদু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহীদুল ইসলাম বাবুল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও এনামুল হক এনাম।
গবেষণার তিন মাসের ওই সময়ে দেখা যায়, দীপু মনি সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫৭১টি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। মাহবুবউল আলম হানিফ পোস্ট করেছেন ২৩টি। দীপু মনির পোস্টের ৭৭ শতাংশ রাজনৈতিক পোস্ট। অন্যদিকে মাহবুবউল আলম হানিফের মোট পোস্টের ৮২ শতাংশ রাজনৈতিক পোস্ট।
অন্যদিকে একই সময়ে বিএনপির সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স সর্বোচ্চ ১১৯টি পোস্ট করেছেন, আর সালাউদ্দিন টুকু ৩১টি পোস্ট করেছেন। সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের ৯২ শতাংশ ছিল রাজনৈতিক পোস্ট। অন্যদিকে সালাউদ্দিন টুকু শতভাগ রাজনৈতিক পোস্ট করেন।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের পোস্টগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক পোস্ট। প্রায় ৯ শতাংশ পোস্টের বিষয়বস্তু রাজনীতি-বহির্ভূত। প্রায় ৫৬.৩৬ শতাংশ রাজনৈতিক পোস্টে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা (যেমন নিজের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার খবর) ছিল। অন্যদিকে রাজনীতিবিদেরা অন্য কোনো রাজনীতিবিদের পোস্ট শেয়ার করেছেন ৩৩.৯৭ শতাংশ।
ফেসবুকের রাজনৈতিক ব্যবহার
এক দশক আগে যখন ফেসবুক দেশে এতটা জনপ্রিয় ছিল না, সে সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার একটি টু্ইটার অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি অ্যাকাউন্টটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তার বিশ্বাস ওই অ্যাকাউন্টটি কেউ হ্যাক করেছিল।
২০১০ সালের ১১ মে মোস্তাফা জব্বার তার টুইটার অ্যকাউন্ট শেষবারের মতো ব্যবহার করেন। তার শেষ টুইটটি ছিল কিছুটা বিভ্রান্তিকর। তাতে লেখা হয়েছে, 'আমি বিপদে পড়েছি (আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার)'। মোস্তাফা জব্বার এখনো বিশ্বাস করেন তার অ্যাকাউন্টটি খুব সম্ভবত হ্যাক করা হয়েছে।
এখন মোস্তাফা জব্বার সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী। তার ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ তাকে অনুসরণ করেন। দিনে গড় হিসেবে তিনি প্রায় ১০টির মতো পোস্ট করেন। যদিও মাঝেমধ্যে পোস্ট করার পর তা মুছে ফেলার অভ্যাস আছে তার।
২৩ এপ্রিল তিনি প্রায় ১৮টি পোস্ট করেন ফেসবুকে। পোস্টগুলো হয় রাজনৈতিক অথবা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ছিল। এমনিতে সাধারণত তিনি ফেসবুকে বিভিন্ন সংবাদ শেয়ার করেন এবং ফুলের ছবি পোস্ট করেন।
মোস্তাফা জব্বারের ২৩ এপ্রিলের করা পোস্টগুলোর একটি ছিল সতর্কতামূলক পোস্ট। ওই পোস্টে তিনি যারা বাংলায় নাম লিখে তাকে বন্ধু হিসেবে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ পাঠিয়ে কার্যসিদ্ধির পরে সেটি রোমান হরফে (ইংরেজি হরফ) পরিবর্তন করে নিয়েছে যারা, তাদেরকে সতর্ক করে দেন।
ওই পোস্টে মোস্তাফা জব্বার লেখেন, 'ফেসবুকে আমার বন্ধু হবার জন্য যারা বাংলা হরফে নাম লিখে বন্ধু হয়ে আবার সেটিকে রোমান হরফে বদলে ফেলেন তারা জেনে রাখুন আমি নিয়মিত বন্ধু তালিকা পরিক্ষা করি ও রোমান হরফে নাম পেলে বন্ধু তালিকা থেকে বের করে দেই।'
তিনি জানান, ওই দিনও তিনি ২৮ জনকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি অনুরোধ করেন তাকে রোমান হরফে নাম লিখে বন্ধু হবার অনুরোধ না করতে। ওই পোস্টে তিনি আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের বা সাম্প্রদায়িক কাউকে তিনি বন্ধু বানান না।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, রাজনীতিবিদদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এ কাজের জন্য ফেসবুক খুবই সহজ একটি উপায়। তিনি বলেন, 'টুইটার বাংলাদেশে জনপ্রিয় নয়, ফেসবুক বেশি জনপ্রিয়। আমরা সেই প্ল্যাটফর্মটাই ব্যবহার করব যেটা জনপ্রিয়। এটাই স্বাভাবিক।'
মোস্তাফা জব্বার তার ফেসবুক উপস্থিতির আরও কিছু কারণ থাকার কথার উল্লেখ করেন। 'আমাদের একটা দায়িত্ব আছে, আর আমাকে ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখভাল করতে হয়। আমি লক্ষ করেছি ফেসবুক ও ইউটিউব-সংশ্লিষ্ট সমস্যাই সংখ্যার দিক থেকে বেশি। আমাদেরকে এগুলো মনিটর করতে হয়।' তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু (বাংলাদেশের) মানুষ টুইটার কম ব্যবহার করে, তাই টুইটারের ওপর আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হয় না। টুইটারকে আমরা ঝুঁকি হিসেবে দেখি না।'
ফেসবুকের অরাজনৈতিক ব্যবহার
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ২০০৯ সাল থেকে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তবে প্ল্যাটফর্মটিতে নিয়মিত তাকে লিখতে বা শেয়ার করতে দেখা যায় না। এর পুরোটাই নির্ভর করে তার অনুভূতির ওপর। তার একটি টুইটার অ্যাকাউন্টও রয়েছে। তবে সেটিও তিনি কালেভদ্রে ব্যবহার করেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তার সাম্প্রতিককালের এক পোস্টে কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি সাদা-কালো ছবি শেয়ার করেন। পোস্টের ক্যাপশনে তিনি লিখেন, '১৯৫৬ সালে জাতির জনকের আমেরিকার বোস্টন ভ্রমণ'।
ইচ্ছে হলেই কেবল খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ফেসবুকে সময় কাটান বা কোনো কিছু পোস্ট করেন। তিনি বলেন, চলতি অনেক ঘটনা নিয়েই তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারেন। এর একটি বিশেষ কারণ হলো, ফেসবুকে মানুষ খোলাখুলিভাবে তাদের মতামত দিতে পারে এবং তারা সেটা করছে।
'যেহেতু জনগণের মনোভাব ফেসবুকে কোনো প্রকার ফিল্টারিং ছাড়াই প্রকাশিত হয়, তাই আপনি সে সম্পর্কে ফেসবুকে ভালোই ধারণা পেতে পারেন। মূলধারার গণমাধ্যমে আপনি অনেক কিছুই পাবেন না, যেগুলো ফেসবুক থেকে খুব সহজেই জানা যাবে,' বলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ফেসবুক থেকে মানুষের মন-মানসিকতাও জানা যায় বলে মত প্রকাশ করেন এ প্রতিমন্ত্রী।
'আপনি আরও বিচার করতে পারবেন কত মানুষ অন্ধভাবে অন্যকে বা কোনো ধারণাকে অনুসরণ করছে। এখানে ভালো জিনিস, খারাপ জিনিস; সবই আছে। মূল ব্যাপারটি হলো আমরা কোনো কিছুকে কোন দৃষ্টিতে দেখছি,' বলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তবে নিজে ফেসবুকে কিছু লেখার সময় তার মনে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করে না। নিজের ভোটারদের কথা মাথায় রেখে তিনি ফেসবুক ব্যবহার করেন না। 'যেসব জিনিস ভালো লাগে, সেগুলো নিয়ে পোস্ট করি। যখন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করি বা কোনো কিছুর কথা চিন্তা করলে ভালো অনুভূতি হয়, তখন আমি সেসব নিয়ে পোস্ট করি,' বলেন তিনি। তবে তিনি জানান, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ফেসবুকে কোনো নিরর্থক কিছু পোস্ট করতে পারেন না।
সংসদ সদস্য মির্জা আজমের একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বশেষ তিনি ২০২০ সালের ২০ জুন পোস্ট শেয়ার করেন। ওই পোস্টের বিষয় হচ্ছে ২০০৬ সালে যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানকের এক র্যালিতে দেওয়া বক্তব্য।
মির্জা আজম জানান তিনি সচরাচর তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন না। তার চেয়ে বরং তিনি এটি ব্যবহার করেন অন্যরা কী বলছে, তা জানতে। তবে সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকার সময়ও তার নেই বলে জানান তিনি।
'আমি নিজে নিজেই এটি ব্যবহার করি। কিন্তু কীভাবে লগইন বা লগআউট করতে হয় সেসব আমি জানি না। মানুষজন আমাকে ট্যাগ করেন, তখন তাদের পোস্ট দেখার সুযোগ হয় আমার,' বলেন তিনি।
মির্জা আজমের অন্য ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা সেগুলো পরিচালনা করে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে তিনি আরও জানান, অতীতের কোনো এক সময়ে তার একজন ছোটভাই তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কিছু ছবি পোস্ট করেছিলেন।
'ফেসবুক জিনিসটাকে আমি ভয় পাই'
তবে সব রাজনীতিবিদ তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্য এখনো নয়া-মাধ্যমের ব্যবহার শুরু করেননি। অনেক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ব্যতিব্যস্ত হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে থাকেন।
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে তিনি জানান, তিনি ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তার দাবি, তার নামে যে কোনো ফেসবুক অ্যকাউন্ট আছে, তা-ও জানেন না তিনি। যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখনও ফেসবুকে তার কোনো অ্যাকাউন্ট ছিল না বলে জানিয়েছেন তিনি।
'ফেসবুক জিনিসটাকে আমি ভয় পাই,' হাসতে হাসতে বলেন শাহজাহান খান। 'কোনো গ্যারান্টি আছে যে কেউ এটা হ্যাক করে ক্ষতিকর কিছু করবে না? আমার কেন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা লাগবে?'
শাহজাহান খান কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই ব্যবহার করেন না। 'আমি এখনো আপনাদের সবার মতো ডিজিটাল হয়ে উঠতে পারিনি,' বলেন তিনি। তবে তিনি জানান, তিনি শুনেছেন কোনো এক যুবক তার নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছে ফেসবুকে।
'ওকে পেলে আমি জিজ্ঞেস করতাম যে সে কী করছে। কোনো ভুল কিছু হলে তার দায়াভার কিন্তু আমার ওপরেই পড়বে,' বলেন তিনি।
জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ উপায়
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভাইস-চেয়ারপার্সন শামসুজ্জামান দুদু মূলত ফেসবুক ব্যবহার করেন রাজনৈতিক অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য। তার ১৮ হাজারের বেশি অনুসারীসমৃদ্ধ একটি টুইটার অ্যাকাউন্টও রয়েছে।
নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম, সংবাদ, পছন্দের ছবি ইত্যাদি শেয়ার করেন। তিনি বলেন, তার নামে একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে যেগুলো ভুয়া। এজন্য তিনি ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন।
দুদু জানান, তিনি ফেসবুক ব্যবহার করছেন মানুষের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে। 'আমি যখন আমার ফেসবুকে একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা শেয়ার করি, হাজার হাজার মানুষ তা দেখতে পায় ও বার্তাটি জানতে পারে। ফেসবুকে কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের নিখাদ সেন্টিমেন্ট সহজেই বোঝা যায়,' বলেন তিনি।
ফেসবুকের এসব সুবিধার পাশাপাশি দুদু কিছু অসুবিধার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে প্রচুর গুজব ছড়ায়, তাই এগুলো ব্যবহারকারীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক হোসেন ফেসবুকে বিপুল জনপ্রিয়। এ প্ল্যাটফর্মে তার প্রায় ২০ লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে। প্রতিদিন তিনি ফেসবুকে লিখেন ও পোস্ট শেয়ার করেন। তার প্রায় সবগুলো পোস্টই খবর, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের সংবাদ।
২৪ এপ্রিল এক পোস্টে নিউ মার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় নিউ মার্কেট থানা বিএনপির মহাসচিব হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটওয়ারিকে অভিযুক্ত করার নিন্দা জানান ইশরাক। ওই পোস্টে তিনি জাহাঙ্গির হোসেনের সঙ্গে তোলা তার দুটি ছবি যুক্ত করেন।
মো. আসাদুজ্জামান জানান, তার গবেষণায় তিনি দেখেছেন, গণযোগাযোগের জন্য দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাই ক্রমশ ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন। তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো থেকে রাজনীতিবিদেরা দুইভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
'ঢাকায় অবস্থান করে অনেক রাজনীতিবিদ তাদের স্থানীয় এলাকায় কী ঘটছে তা জানার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করেন। তাদেরকে আর সরাসরি এলাকায় যেতে হচ্ছে না। কম সময়ে রাজনীতিবিদেরা বড় সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন,' বলেন মো. আসাদুজ্জামান।
'একইভাবে জনসাধারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ক্ষোভ ঝাড়তে পারেন বা ফিডব্যাক দিতে পারেন যেটা রাজনীতিবিদেরা সরাসরি দেখতে পান। একজন এমপির কাছে এত সহজে পৌঁছানো সবসময় সহজ হয় না,' বলেন এ শিক্ষক।
তবে এ প্রভাষক আরও যোগ করেন, এসব কিছুর একটি নেতিবাচক দিকও আছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতারা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন তাদের সবকিছু নিয়ে জানাশোনা আছে এবং স্থানীয় এলাকায় তাদের যথেষ্ট সমর্থন আছে। কিন্তু বাস্তবে তা সবসময় দেখা যায় না।
বিহাইন্ড দ্য সিন
জনসংযোগ খাতে রাজনৈতিক যোগাযোগের এ নয়া-মাধ্যম এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। আজ থেকে চয় বছর আগেও কোনো কোনো মন্ত্রী, এমনকি নগরের মেয়রেরাও ঢাকার অনেক পিআর (পাবলিক রিলেশনস) কোম্পানিকে ভাড়া করতেন তাদের ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো পরিচালনা করার জন্য।
'কিন্তু এখন অনেক রাজনীতিবিদ তাদের নিজস্ব দল তৈরি গঠন করে নিয়েছেন এ কাজের জন্য,' প্রায় বিশ বছর এ খাতে কাজ করা একটি পিআর কোম্পানির মালিক বলেন। 'আপনি যদি তাদের ফেসবুকের ছবি বা ভিডিওর মান দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন ওগুলোতে পেশাদারিত্বের নিদর্শন রয়েছে,' তিনি যোগ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপক বলেন, তিনি গত চার বছর ধরে একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীর ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট দেখাশোনা করছেন। তিনি জানান, একজন রাজনীতিবিদের জন্য প্রতিটি পোস্টই অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই তারা এমন কাউকে এ কাজে নিয়োগ করেন যাদের বিশ্বাস করেন।
তবে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক রাজনীতিবিদই পিআর এজেন্সির সেবা নেবেন বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট মালিকেরা। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচির তোড়জোড় শুরু হলে এ বাজারে চাহিদা কিছুটা বাড়বে।