এখন কেবল আমাদেরই আছে জলের রকেট, যার পাখাগুলো লোহার যার গায়ের রঙ কমলা
'ট্যান্ডল' শব্দটা সেদিন অনেকদিন পরে শুনলাম। যারা স্টিমার জেটিতে বাঁধার জন্য দড়িদাড়া গোছায়, বাঁধে, খোলে তাদেরকে বলে লস্কর আর লস্করদের সর্দারকে বলে ট্যান্ডল। স্টিমার কর্মীদের এমন আরো কিছু পদবী আছে; ভান্ডারী তার একটি, তবে সে কাজ করে ইঞ্জিন সেকশনে। ডেক আর ইঞ্জিন এই দুই ভাগে জাহাজ কর্মীরা বিভক্ত। ইঞ্জিন সেকশনে মাস্টারসহ কাজ করেন মোট নয়জন। একজন আছেন গ্রিজম্যান বা অয়েলম্যান। ডেকেও পাইলট বা হুইল মাস্টারের সঙ্গে, কোয়ার্টার মাস্টার, সুকানি, টালি সুকানিসহ নয়জন কাজ করেন। সব মিলিয়ে একটি প্যাডেল স্টিমারে কর্মী থাকেন প্রায় ৩০ জন। আমরা কথা বলছিলাম জাহাজের খোলের ভিতর বসে। প্যাডেল স্টিমারগুলো এখন বসেই থাকে বেশি সময়। প্রায় শত বছর বয়সী জাহাজগুলো এখন ধুঁকছে। অব্যবস্থাপনায় বলতে গেলে দেউলিয়া। অথচ একসময় ঢাকা খুলনা বা নারায়ণগঞ্জ-কলকাতা যাত্রায় এগুলো ছিল অতুলনীয়। দেখতে রাজহংসের মতো। উটপাখি, ময়ূরপঙ্খির মতোও বুঝিবা। একটি জাহাজের নামও- অস্ট্রিচ।
সেকালে এই জাহাজ গতিতেও ছিল দুর্বার। ২০-২২ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনা পৌঁছে গিয়ে যাত্রীরা তখন অবাকই হতেন। তাই একে বলা হতো রকেট সার্ভিস। আবার গাত্রবর্ণ কমলা বলে কাব্য করে লোকে বলত কমলা রকেট। কেন এগুলোয় এখন আর লোকে ভিড় করছে না? প্রশ্নটা টেবিলে ছুড়ে দিলে একজন বললেন, 'কবে যে এখন স্টিমার ছাড়ে তারই তো ঠিক নাই। লোকে এসে তো খালি হাতে ফিরে যাওয়ার ভয় করে। কোনো কোনো জাহাজ বসে আছে বছরখানেকই হলো।'
তবে মাহসুদ গত ৪ রমজান একটা ট্রিপ দিয়েছে। জাহাজটি তিন চার মাস হলো ডক থেকে ফিরেছে, এখনো গা চকচক করছে। লাইট, ফ্যান, সুইচবোর্ড, সিড়ি, বয়া, বালির বালতি, মেঝে, রেলিং মায় চিমনিটাও ঝলমল করছে। মাহসুদের মোরেলগঞ্জ যেতে সময় লাগে ১৭ ঘণ্টা। আসা-যাওয়ায় তেল খায় ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ লিটার। দুই তলা জাহাজটি প্রায় আড়াইশ ফুট দীর্ঘ, চওড়ায় ৬০ ফুট। গভীরতা ছয় ফুট। প্রতি তলা সাড়ে ৯ ফুট উঁচু। ১০০ টনের বেশি মালামাল বহন করতে পারে, যাত্রী ধরতে পারে সাড়ে ৮০০ জন। মাহসুদের নাম নাকি রাখা হয়েছে সেই মেরিন আর্কিটেক্টের নামে যিনি জাহাজ নকশা করতেন। ঠাকুর পরিবারের মালিকানাধীন কলকাতার গার্ডেনরিচ ডকইয়ার্ডে ডজন ডজন প্যাডেল স্টিমার তৈরি হয়েছিল- সান্দ্রা, লালী, কিউই, ইমু, পেলিক্যান, গাজী, অস্ট্রিচ, মাহসুদ, টার্ন বা শেলা।
বেসরকারি ওই ডকইয়ার্ডের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৪ সালে, হুগলী নদীর পূব পাড়ে। ১৯১৬ সালে এর নতুন নাম হয় গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপ। ১৯৬০ সালে এটি ভারত সরকারের আওতায় চলে যায়। আমাদের চেনা প্যাডেল স্টিমারগুলো তৈরি শুরু হয় ১৯১৮ সালে। পিএস মাহসুদ তৈরি হয়েছিল ১৯২৮ সালে। সবগুলো জাহাজের নামের আগেই আছে পিএস মানে প্যাডেল স্টিমার। এখন যেমন লঞ্চের গায়ে লেখা থাকে এমভি মানে মোটর ভ্যাসেল।
মাহসুদে প্রথম শ্রেণীর কেবিন আছে ১২টি। প্রতিটি কেবিনে ২ জনের থাকার ব্যবস্থা। কেবিনগুলো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। এর খাটগুলো কাঠের, চেয়ারগুলো বেতের। প্রতিজনের জন্য একটি করে ২৪টি বেতের চেয়ার আছে। এর সেলুন বা ডাইনিংয়ের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। চেয়ার-টেবিল ছাড়াও আছে সোফা। প্রথম শ্রেণী যতটুকু জায়গায় তার দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। প্যাডেল স্টিমারের কিচেনকে বলা হয় প্যান্ট্রি। তিনজন বাবুর্চি আছে প্যান্ট্রিতে। বাংলা ও ইংলিশ ডিনার সার্ভ করা হয়, আরো পাওয়া যায় স্ন্যাকস। ইংলিশ ডিনারে মটন ও চিকেনের সঙ্গে আছে স্যুপ, ফিশ ফ্রাই, রুটি, জেলি, পুডিং, বয়েলড ভেজিটেবল, চা। বাংলা ডিনারে পাওয়া যায় ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, ডিম, সবজি ও চিকেন। স্ন্যাকসে থাকে ফিশ কাটলেট, চিকেন কাটলেট, ফিশ ফ্রাই (ইলিশ বা কোরাল), চিকেন ফ্রাই ও স্মোকড ইলিশ। অর্ডার দেওয়ার পর খাবার রান্না করা হয়। জনপ্রতি ২২০ টাকার সেট মেন্যুও আছে। খাবার সঙ্গে নিয়ে গেলে অবশ্য প্লেট-গ্লাস-বাটি বাবদ জনপ্রতি দিতে হয় ৫০ টাকা।
যদি ইকোসাউন্ডার আর রাডার থাকত!
মাহসুদে আগে লাইফবোটও ছিল। প্যাডেল স্টিমারগুলোয় এখন জিপিএস দেওয়া হয়েছে। আরো আছে দূরবীন ও কম্পাস। নাবিকদের আক্ষেপ যদি ইকোসাউন্ডার ও রাডার থাকত! মাহসুদে দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিন আছে ১০টি। প্রথম ও দ্বিতীয় তলা মিলিয়ে টয়লেট আছে ৩২টি। তবে সবগুলো যাত্রীদের জন্য নয়, স্টাফদের জন্য গোসলখানাও আছে। স্টাফদের রান্নাবান্নার জন্য আলাদা বাবুর্চি ২ জন। প্যাডেল স্টিমারে তৃতীয় শ্রেণী মানে ডেক। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, চরখালী, মঠবাড়িয়ার বড় মছুয়া ও মোরেলগঞ্জ স্টেশনে থামে জাহাজগুলো। পথে পড়ে বুড়িগঙ্গার পর ধলেশ্বরী, মেঘনা, পদ্মা, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, বাঁশখালী, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, কাতছা, বলেশ্বর এবং পাঙ্গুচি নামের নদীগুলো।
ঢাকা থেকে মোড়েলগঞ্জ ১৬১ কিলোমিটার। প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ১৬১৫ টাকা, ঢাকা থেকে চাঁদপুর (৬৯ কিমি) ৪০০ টাকা এবং বরিশাল (১৬৯ কিমি) ১,০০০ টাকা ভাড়া জনপ্রতি। জাহাজগুলো চলে ঘণ্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল মানে প্রায় ১৯ কিলোমিটার বেগে। জাহাজগুলোয় বেশি আছে গোল গোল পাখা যা লোহার খাচায় বন্দি। মাহসুদে টিউবলাইট ও হলুদ বাল্ব মিলিয়ে বাতি আছে দেড়শর মতো। চাঁদপুর পার হওয়ার পর থেকে মেঘনার ডুবোচরগুলো জাহাজদের কষ্ট দেয়। তখন ঠেকে ঠেকে চলতে হয়। জাহাজে যাত্রী প্রবেশের পথ পেটের দিক দিয়ে। লঞ্চ ও জাহাজের মধ্যকার এটিও একটি ফারাক। মূল ফারাক মূলত আকারে। লঞ্চগুলো সোয়াশ ফুটের বেশি হয় না সাধারণত। প্যাডেল স্টিমার ৩০০ ফুটও ধরে। মাহসুদের ইঞ্জিন একটি, ১২০০ হর্স পাওয়ারের। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) বলছে, আপনি গর্ববোধ করতে পারেন এই কারণে যে প্যাডেল স্টিমার সার্ভিস কেবল বাংলাদেশেই আছে এখন, পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
আর আমার দুঃখটাও এই কারণেই যে স্টিমারগুলো নিয়মিত চলে না। আগে তো সপ্তাহে সাতদিনই চলত। তারপর ছয়দিন। ২০১৯ সাল পর্যন্তও প্যাডেল স্টিমার নিয়মিত চলাচল করেছে। এখনও বিআইডব্লিউটিসির দুটি জাহাজ বাঙালি আর মধুমতি সপ্তাহে দুইদিন- সোম ও বৃহস্পতিবার মোড়েলগঞ্জ যায়, তবে এগুলোর কোনোটিই প্যাডেল স্টিমার নয়। এগুলোর নকশা লঞ্চের মতোই, আলোবাতাস চলাচলও সেভাবে করে না, এগুলোর পাখা (প্রপেলার) নীচে। যদিও বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম মিশা জানালেন, না, সপ্তাহে একদিন প্যাডেল স্টিমার চলাচল করে। এখন বিআইডব্লিউটিসির তিনটি প্যাডেল স্টিমার কার্যকর আছে মাহসুদ, লেপচা আর টার্ন। অস্ট্রিচকে চার্টার করা হয়েছে মানে প্রাইভেট সেক্টরে দেওয়া হয়েছে। সেটি হেরিটেজ ট্যুরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে অথবা হবে একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ।
মজার কিছু তথ্য
তবে বেশ কিছু মজার তথ্য দিলেন জনাব মিশা। একটি হলো, ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাজার মেয়াদ কমানো হতো যদি তারা স্টিমারে বেগার খাটতে রাজি হতো। আরো জানালেন, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে স্টিমারগুলোর জন্য কয়লার ডিপো আছে। কারণ আগে তো স্টিমারগুলো বাষ্প ইঞ্জিনে চলত মানে কয়লা পুড়িয়ে এর জ্বালানি তৈরি করা হতো। স্টিমারের দুই পাশে যে দৈত্যাকার পাখাগুলো (প্যাডেল) আছে আগে সেগুলো হতো কাঠের। এখন হয় লোহার। এই ব্যাপারে নাবিকদের একটি আক্ষেপ আছে, প্যাডেলগুলো কাঁচা লোহার না হয়ে যদি এসএসের হতো তবে গতি বাড়ত স্টিমারের। কারণ যাত্রীদের অভিযোগ, স্টিমারে সময় লাগে বেশি। অথচ স্টিমারে ভাড়া কম, স্টিমার আরামদায়ক, স্টিমার রাজকীয়। এ পর্যায়ে জাহাজের খোলের আড্ডার নাবিকদের একজন যোগ করলেন, 'মানুষের হাতে এখন টাকা আছে, কিন্তু সময় নেই। তাই সময় বাঁচাতে ছুটছে সবাই আর পিছিয়ে পড়ছে প্যাডেল স্টিমার।'
স্টিমারে কি একাধিক ইঞ্জিন লাগানোর সুযোগ আছে? উত্তর এলো, 'না।' আমি ভাবি, তাহলে খুলনা তো দূর অস্ত। অথচ ১৯১২ সালে ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গাবখান চ্যানেল (বাংলার সুয়েজ খাল) খোঁড়া হয়েছিল খুলনার দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্যই। ১১২ কিলোমিটার কমেও গেছে। নদীপথে কলকাতা যাওয়ার জন্য স্টিমারগুলো কৃত্রিম এ চ্যানেলটাই ব্যবহার করত। ২০ মিটার পর্যন্ত গভীর এ চ্যানেল।
আবার জনাব মিশার শরণাপন্ন হই। জানতে চাই, আর কখনো কি স্টিমার খুলনা যাবে না?
মিশা: মোংলা ঘষিয়াখালী চ্যানেলটির দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। এখানে গিয়ে আটকে যেত স্টিমার। এছাড়া ভাটি অঞ্চল বলে প্রতি বছর এতো পলি পড়ে যে নদীর তলদেশ ফুলে ওঠে, ইতিউতি চর তৈরি হয়। আপনি বিদেশে দশ-বিশ বছর কোনো নদীকে খেয়াল করতে থাকলে তার গতিপথ ধরে ফেলতে পারবেন। আর আমাদের এখানে নদীর পথ বদল হয় বলতে গেলে ফি বছর। এই যেমন যমুনা। আসলে তো ব্রহ্মপুত্র ফুঁড়ে বেরিয়েছে নদীটা, ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের ফসল। আরেকটি ব্যাপার হলো নদী বা চ্যানেল খনন, সংরক্ষণ, সুরক্ষা আমাদের কাজ নয়, এটি বিআইডব্লিউটিএর কাজ।
বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ) আর আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কি?
মিশা: টিএ হলো অথরিটি। আমরা মানে টিসি নৌবহর পরিচালনা করি। আমাদের আছে ফেরী, ওয়াটার বাস, সি ট্রাক, যাত্রাবাহী জাহাজ, ঘাট পন্টুন, কন্টেইনার ভেসেল ইত্যাদি। টিএর ইতিহাস আছে ব্রিটিশ আমলেরও। পরে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৮ সালে। দেশ স্বাধীন হলে এটি হয় বিআইডব্লিউটিএ। আর আমাদের সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। তিনি ১০টি নৌ পরিবহন প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সাত শতাধিক নৌযান ছিল আমাদের তখন। বঙ্গবন্ধু ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে স্টিম নেভিগেশন কোম্পানী লিমিটেড ও পাকিস্তান রিভার স্টিমার সার্ভিসের নৌযানগুলোকেও একীভূত করেন। আগে কিন্তু রেলওয়ের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময়ে আপনাদের ছয় শতাধিক জলযানের বহর ছিল? এখন বোধহয় একশর কিছু বেশি আছে। তাই না?
মিশা: হ্যা সময়ের বিবর্তনে এটা হয়েছে। আমাদের দেশে স্থলপথে দারুণ উন্নতি হয়েছে। মানুষ সময়ের মূল্য দিচ্ছে বেশি। আগে আমাদের নৌ পথ ছিল ২৬০০০ কিলোমিটার এখন তা ৬০০০ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। অনেক জায়গাতেই জলযান চালানোর সুযোগ কমে গেছে। কিন্তু আমরাও বসে নেই। এর মধ্যে নতুন নতুন জলযানও যোগ করেছি। যেমন ঢাকা-মোড়েলগঞ্জ রুটে আধুনিক নতুন দুটি জাহাজ এমভি বাঙ্গালী আর মধুমতি চলাচল করছে। উপকূলীয় রুটে (সন্দ্বীপ-হাতিয়া-বরিশাল) চলাচল করছে আব্দুল মতিন, মনিরুল হক ও বার আউলিয়া। চরচেঙ্গা, চরবাটা,বয়ারচর, মগনামা, কুতুবদিয়া ইত্যাদি রুটে আছে সি ট্রাক খিজির, এসটি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ কামাল, শেখ রাসেল ও সুকান্ত বাবু। শীতলক্ষ্যার পাড়ে আমাদের ৪টি ডকইয়ার্ড ও ১টি ফ্লোটিং ডক আছে। পিএন মাহসুদ তো সেখান থেকেই আবার নতুন হয়ে এসেছে কিছুদিন হলো। নারায়ণগঞ্জে আমাদের একটি ফাইবার গ্লাস ফ্যাক্টরিও আছে। সেখানকার ফাইবার গ্লাস দিয়ে স্পিডবোটের হাল, হেলমেট, চেয়ার এবং বিভিন্ন আসবাব তৈরি হয়।
জনাব উমরের স্মৃতিচারণা
রেলওয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জনাব মিশার কথা সূত্র ধরে বিবিসিতে প্রকাশ হওয়া রাজনীতিবিদ বদরউদ্দিন উমরের স্মৃতিকথা মনে পড়ল। তিনি ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্রই ১৪ বছর বয়সে প্রথম স্টিমারে চড়েছিলেন। উমর বলছিলেন, "স্টিমারে যাত্রা ওই বয়সে খুব এক্সাইটিং ছিল। কারণ আমরা তো পশ্চিমবঙ্গের লোক, খুব একটা নৌকো বা স্টিমার-টিমারে চড়তাম না। প্রথম চড়লাম। সেটা খুব ভাল লেগেছিল। তখন ঢাকায় আসতে গেলে গোয়ালন্দ নারায়ণগঞ্জ লাইনের স্টিমার ছাড়া আর কিছু ছিল না। ট্রেনে আসা শুরু হল অনেক পরে। শেয়ালদা থেকে চড়তাম, ট্রেন থেকে এসে আমরা গোয়ালন্দ ঘাটে নামতাম। ট্রেনের যে টিকেট কাটতাম, সেটা হত একদম নারায়ণগঞ্জ পর্যন্তই। টিকিট আর করতে হত না। রাস্তায় যেতে যেতে দুটো বড় স্টেশন পড়ত। একটি ছিল তারপাশা। আরেকটি ছিল মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জে যেটা দেখা যেত, বিরাট বিরাট সব ঝুড়িতে সাগর কলা। আমাদের ওখানে হচ্ছে মর্তমান কলা সবচেয়ে বড় কলা, এখানে যেটাকে সবরী কলা বলে। বিরাট বড় স্টিমার। যেরকম স্টিমার হয়তো এখন আছে বোধ হয় কিছুটা ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল করে। আগেকার দিনে চট্টগ্রামেও যেত। যাত্রীরা চাঁদপুরে নেমে (ট্রেনে চড়ে) চট্টগ্রামে চলে যেত। খাওয়ার ব্যবস্থাও সেরকম ছিল। ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের যারা প্যাসেঞ্জার তাদের জন্য আলাদা কিচেন ছিল, সেখানে রান্না হত। আর একটা কিচেন ছিল বড়, যেখানে ইন্টার ক্লাস আর থার্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জাররা খেত। দুটি জিনিস খুব ভাল রান্না করত ওরা, ইলিশ মাছ আর মুরগি। মুরগির ওই কারির খুব সুখ্যাতি ছিল। আর ইলিশ মাছও রাঁধত খুব ভাল করে। স্টিমারের জার্নিটা খারাপ ছিল না, কিন্তু সময় বেশী নিত। নদীর উপর দিয়ে জার্নিটাই একটা আনন্দময় ব্যাপার ছিল।"
উনিশ শতকের নৌপথ
১৮৯০ সালের দিকে বছরে প্রায় ৯০০টি নৌযান সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে কলকাতা থেকে খুলনা অবধি চলাচল করত। সুনীল কুমার মুনশির পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা নামের নিবন্ধ থেকে বিশ শতকের গোড়ায় স্টেশন দিয়ে বড় স্টিমারের মাসওয়াড়ি যাতায়াতের পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জ ছিল শীর্ষে ১৯২ বার। তারপর ছিল খুলনা ১৯৮ বার, গোয়ালন্দ ১৭৮ বার, কলকাতা ১০৮ বার, শিলচর ৪৬ বার, গুয়াহাটি ৩৪ বার।
১৯১৫ সালে রোহিনী কুমার সেনের লেখা বাকেরগঞ্জের প্রত্নতত্ত্ব ও আধুনিক ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৮৫ সালে বরিশাল থেকে খুলনায় স্টিমার চালু করে প্লোটিলা কোম্পানি। কাছাকাছি সময়ে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারও এই রুটে আরেকটি স্টিমার চালু করে। তাদের প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিতে বরিশাল-খুলনা রুটে ভাড়া নির্ধারিত হয় ৪ আনা। কিছুদিন পর ঠাকুর পরিবার প্লোটিলা কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে ঠাকুররা লাইন ছেড়ে দেয়। এরপর লাইনে আসে ধনকুবের আরএসএন কোম্পানী। তারা বরিশাল শহরে স্টেশন ও কারখানা স্থাপন করে। লাখুটিয়ার খ্যাতনামা জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের বড় ছেলে রাখাল চন্দ্র রায় এবং জলাবাড়ির জমিদার বৈকুণ্ঠনাথ বিশ্বাস আর তার ভাইয়েরাও কয়েক মাস স্টিমার চালিয়েছিলেন। ভাগ্যকূল জমিদারদের একটি কোম্পানির কথাও জানা যায় যার নাম ছিল ইস্ট বেঙ্গল রিভার স্টিমার।
নদী-খাল বিধৌত বরিশাল অঞ্চলে রেললাইন স্থাপনেরও কিন্তু চেষ্টা চলেছিল কিন্তু স্টিমার কোম্পানিগুলোর বিশেষ করে আরএসএনের বিরোধিতাই তা আলোর মুখ দেখেনি। তপন রায়চৌধুরী তাঁর রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চায় লিখছেন, গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রায় শেষ সীমায় অবস্থিত এই জেলায় নদী-নালা এত বেশি যে রেলসংযোগ আর সম্ভব হয়নি। দুয়েকবার যা চেষ্টা হয়েছিল স্টিমার কোম্পানির মালিক লর্ড ইঞ্চকেপ বিলেতে বসে কলকাঠি নেড়ে তার দফা শেষ করেন।
কত কত মানুষ চড়েছেন
জাহাজের খোলে আমাদের আড্ডা হচ্ছিল দফায় দফায়। বিকালে কখনো, রাতেও একদিন। এক নাবিক বলছিলেন, 'এরশাদ আমলে বেশ কয়েক দফায় বিশ্বনেতৃবৃন্দ প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণ করেছেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় হয়েছিল সার্ক সম্মেলন। তখন ঢাকায় উপস্থিত দক্ষিণ এশীয় নেতৃবৃন্দের অনেকে এবং তাদের সফর সঙ্গীরা প্যাডেল স্টিমার পরিদর্শন ও ভ্রমণ করেছেন। তাদের জন্য হোটেল শেরাটন থেকে খাবার আনানো হয়েছিল। তবে পানি তাঁরা পান করেছেন বিলাত থেকে আমদানি করা বোতল থেকে। একবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চল্লিশের বেশি সাংসদ স্টিমার ভ্রমণ করেছিলেন। আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসা কোনো কোনো সাংসদ ওজনে ছিলেন দেড়-দুইশ কেজি। তারা মাহসুদের ওপর যখন নাচছিলেন তখন সকলেই পাটাতন ভেঙে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিলেন। সেবার তাদের সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে এক বাউল শিল্পী গেয়েছিলেন, 'আয়না বসাইয়া দে মোর কলবের ভিতর'- সবাই তা উপভোগ করেছিলেন। তারপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও এসেছিলেন। তার চলাচলের সকল পথে মায় বাথরুমেও পুরু লাল গালিচা বিছানো হয়েছিল। তাতে পা দিলে গোড়ালি ডুবে যেত। সেগুলোর পানি শোষণ ক্ষমতাও ছিল ব্যাপক। বেশি জাঁকজমক হয়েছিল ঝাও জিয়াংয়ের (চীনের প্রধানমন্ত্রী, ১৯৮০-১৯৮৭) ভ্রমণের সময়। পুরো জাহাজ কাপড়, বাতি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছিল। নদীতে ভাসমান অন্য কিছু লঞ্চ বা নৌকাও সাজানো হয়েছিল। নদীর পাড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা জড়ো হয়েছিল। সে ছিল এক দেখার মতো দৃশ্য।'
জনাব মিশা জানিয়েছিলেন, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে। এ ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো মানুষ চড়েছেন প্যাডেল স্টিমার। মহাত্মা গান্ধী এই বাহন পছন্দ করতেন।
গবেষক হোসাইন মোহাম্মদ জাকি লিখছেন, 'জাপান গমনকারী প্রথম ভারতীয় মহিলা হরিপ্রভা তাকেদা ১৯১২ সালে তাঁর স্বামী ওয়েমন তাকেদার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে এই রুটেই গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা যান। তারপর জাহাজে করেই কলকাতা থেকে জাপান।'
উল্লেখ্য ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাহিত্যও কম হয়নি
'পদ্মা নদীর মাঝি'র (১৯৩৫) প্রেক্ষাপট ছিল সে সময়কার গোয়ালন্দ, তৎকালীন গোয়ালন্দের রেল, স্টিমার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জমজমাট শহর জীবন।
'… নদীর তীরে, নদীর জলে, এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া স্টিমারের বাঁশি বাজিয়া উঠে। সশব্দে নোঙর তুলিয়া কোনো স্টিমার ছাড়িয়া যায়, কোনো স্টিমার ভেড়ে গিয়া জেটিতে। কলিকাতা হইতে মেল ট্রেনটি আসিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের ও স্টেশনের দোকানপাট সমস্ত খোলা হইয়াছে।… মেছো নৌকার ঘাটটি একপাশে। ইতিমধ্যে অনেকগুলি নৌকা মাছ লইয়া হাজির হইয়াছে। …পাশেই কাঠের প্যাকিং কেসে এক সারি মাছ ও এক পরত করিয়া বরফ বিছাইয়া চালানর ব্যবস্থা হইতেছে। খানিক দূরে মেইন লাইন হইতে গায়ের জোরে টানিয়া আনা একজোড়া উঁচু-নিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের উপর চার-পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। মাছে বোঝাই হইয়া যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছাইবে। সকালে-বিকালে বাজারে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ ফিরবে বাড়ি। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।'
কবি জীবনানন্দ দাশ বরিশালের মানুষ। স্টিমারের সঙ্গে তাঁর যোগ থাকারই কথা। তার ওপর ১৯৩০ সালে বিয়ে করেন খুলনার সেনহাটি গ্রামের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। তাদের বিয়ে হয়েছিল ঢাকায় ব্রামহসমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর তারা সদরঘাট টার্মিনাল থেকে নৌযানে করেই বরিশাল যান।
মৃত্যুর গন্ধ নামের গল্পে তিনি লিখছেন, বিবাহ করিয়া আসিবার সময় সেই স্টিমারেই তো, 'দুপুরের গরম অসহ্য হইয়া উঠিল নীলিমার কাছে। বড়ো নদীর উপর স্টিমারের ঘুরপাকে সে মাথা ঠিক রাখিতে পারিল না।'
জীবনানন্দের ডায়েরিতেও স্টিমারযাত্রার কথা এসেছে অনেকবার। কত বারই তো বরিশাল থেকে কলকাতা গিয়েছেন। স্টিমারের থার্ড ক্লাসেই যাতায়াত করেছেন বেশি। থার্ড ক্লাস ডেকেরও বর্ণনা রয়েছে তাঁর প্রেতিনীর রূপকথা গল্পে-'যে যেখানে খুশি আখের ছিবড়ে ও থুতু ছিটিয়ে ফেলছে, কলার বাকল, আমের খোসা সাবধানে এড়িয়ে চলতে হয়।' জীবনান্দের অভিজ্ঞতায় থার্ড ক্লাসের ইলেকট্রিক বাতি কেরোসিনের কুপির চেয়েও অধম, এক-একবার জ্বলছে, এক-একবার নিভে যাচ্ছে প্রায় জোনাকির জেল্লার মতো। স্টিমারের বয়লারের চারপাশে মানুষকে দলা পাকিয়ে ঘুমাতেও তিনি দেখেছেন।
কথা তবু রয়ে যায়
আমাদের জাহাজের খোলের আড্ডাতেই কেউ একজন বলেছিলেন, 'স্টিমারের একটি কেবিন থাকত ডাক বিভাগের জন্য বরাদ্দ। সেটা একটা মোবাইল পোস্ট অফিসের মতো ছিল। সেখানে চিঠি বাছাইয়ের কাজ চলত দিনরাত। ঘাটে স্টিমার ভিড়লে চিঠির বস্তা নামিয়ে দেওয়া হতো। পোস্ট অফিসের লোক উপস্থিত থাকত ঘাটে চিঠি নেওয়ার জন্য।'
এখনও কি তেমন হয়? জানতে চাইলে বলেছিলেন, এখন তো মোবাইল এসে গেছে। মানুষ চিঠিপত্র আর সেরকম লেখে মনে হয় না। সরকারি টাকা আর দলিলদস্তাবেজও জাহাজে করে খুলনায় যেত। এখন এটা কালেভদ্রে হয়।
কিন্তু নিরাপত্তা? প্রশ্ন করে জানলাম, স্টিমারে ৮ সদস্যের এক পুলিশ বাহিনী নিয়মিত হাজির থাকে। ঘাটে ঘাটে দলটির মানুষ বদল হয়।
শুধু প্যাডেল স্টিমারকে ঘিরেই কত কত ঘটনা যে ঘটে গেছে গেল প্রায় একশ বছরে, তার ইয়ত্তা নেই। এখন তো গোয়ালন্দে স্টিমারই যায় না। এখন তো স্টিমার প্রতিদিন চলেও না। শুরুর দিকে কাঠকয়লার আগুনে রান্না হতো স্টিমারের খাবার, তারপরে এলো তেলের চুলা আর এখন রান্না সিলিন্ডারের গ্যাসে। এরমধ্যে প্যাডেল স্টিমারকে রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়েছে। জনাব মিশা জানিয়েছেন, গিনেস বুকে প্যাডেল স্টিমারের রেকর্ড লেখানোর জন্য চিঠিপত্র প্রস্তুত হচ্ছে। তাহলে কি প্যাডেল স্টিমারের গন্তব্য ওই জাদুঘর?
উপসংহার
প্যাডেল স্টিমার যেন ইতিহাসের পুস্তক। টাইম মেশিন যেনবা, চড়ে চলে যাওয়া যায় শতবর্ষ আগে। বুঝিবা স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি জমানো যায়। তাইতো যারা কখনো চড়েননি, তাদেরকে আজ মাঝে মধ্যে আফসোস করতে শুনি। আর তিনটি স্টিমারের শতজন কর্মীকে বসিয়ে রাখাটা শোভন যেমন দেখায় না, অভিজ্ঞতা আর অর্থেরও অপচয়। তাই আমাদের চাওয়া, প্যাডেল স্টিমার আরো কিছুকাল চলুক। এখনো ওগুলোর গা শক্ত আছে, ইঞ্জিনও আছে সচল। বাঙ্গালী বা মধুমতির তুলনায় প্যাডেল স্টিমারে খরচও কম আর অভিজ্ঞ মানুষ তো আছেনই। তাই চলুক টার্ন, লেপচা, মাহসুদ। ট্যান্ডলের বাড়ুক ব্যস্ততা, জলের রকেট ভাসুক।