নগরী সেজেছে ফুলের রঙে
ভ্যাপসা গরম হতে নগরবাসীকে একটু প্রশান্তি দিতে আগমন হয়েছে বৃষ্টির। বৃষ্টির আগমনে পরিবর্তন এসেছে প্রকৃতিতেও। এর সুযোগটা লুফে নিচ্ছে শহরের প্রাণ প্রকৃতিও।
শহরের ধুলোবালি থেকে নিজেকে ধুইয়ে নিয়ে সেজেছে নতুন রূপে। যে যৎসামান্য বৃক্ষরাজি শহরের বাসিন্দাদের একটুখানি খোলা বাতাসের ঝাপটা গায়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে সেগুলো নিজেকে মেলে ধরেছে নতুন আঙ্গিকে।
গাছে গাছে এসেছে নতুন নতুন ফুল। রাস্তার কিনারা দিয়ে হাঁটতেই হয়তো আপনার চোখ আটকে যাবে সেই সব রঙ বেরঙের ফুলে। মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকবেন কিংবা বাতাস আপনার কাছে এর সুগন্ধ পৌঁছে দিয়ে জানান দিবে 'গাছে গাছে ফুল ফুটেছে'।
ইট পাথরের এই শহরে সারা বছরই কিছু না কিছু ফুল ফোটে। তবে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে গ্রীষ্ম এবং বসন্তে। কৃষ্ণচূড়ার উজ্জল রঙয়ের কারণে গ্রীষ্ম একটু বেশিই রঙিন। এর পাশাপাশি জারুল, সোনালু, স্বর্ণচূড়ার রঙ আর ঘ্রাণ একে আলাদা করে তোলে অন্যসব ঋতু থেকে।
কৃষ্ণচূড়া
কৃষ্ণচূড়ার রঙে মন মাতিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। লিখেছেন "কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে / আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে"। তাঁর এই পঙতি দুটিই বারবার মনে পড়ে যখন প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়া ফুটতে শুরু করে। সত্যিই তো! উজ্জল লাল, কমলা ও হলুদ বর্ণের অপার সংমিশ্রণের কারণে এই ফুলের দিকে চোখ আটকে যায় অনেক দূর থেকেই। ভাবুক হয়ে পড়েন প্রকৃতি প্রেমীরা।
কৃষ্ণচূড়া একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিখ রেজিয়া। রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক, লেক ও রাস্তার ধারে এই ফুল দেখা যায়। তবে কেউ যদি এর নিরেট সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চায় তাকে যেতে হবে চন্দ্রিমা উদ্যানের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ক্রিসেন্ট লেকের ধারে। সেখানে কৃষ্ণচূড়ার একটি বীথি রয়েছে।
জারুল
জারুলের আদি নিবাস শ্রীলঙ্কায় হলেও এটি ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব বৃক্ষ। জারুল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওসা। গ্রীষ্মের শুরুতেই এর ফুল ফোটে এবং শরৎ পর্যন্ত দেখা যায়। ফুল শেষে গাছে বীজ হয়। জারুলগাছের বীজ, ছাল ও পাতা ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এছাড়া জ্বর, অনিদ্রা, কাশি ও অজীর্ণতার চিকিৎসায়ও জারুল যথার্থ উপকারী। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের বিপরীতে মাঠের কোল ঘেঁষে রাস্তার পাশে দিয়ে যাতায়াতকালে একটু সময়ের জন্য থমকে যান সকলেই। গাঢ় বেগুনি রঙয়ের জারুল ফুলের সৌন্দর্য, থমকে তো যেতেই হবে! এই এলাকা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে, টিএসসির পাশে প্রধানত এই ফুলের দেখা মেলে।
সোনালু
সোনালু গাছে কানের দুলের মতোই দুলছে সোনালু ফুল। এই ফুল দেখতে অনেকটার ঝুমকা'র মতো। হলুদ-সোনালি রঙের ফুলের বাহার থেকেই 'সোনালু' নামে নামকরণ। তবে এই ফুল ও গাছের রয়েছে নানাবিধ নাম। বৈজ্ঞানিক নাম 'কেসিও ফেস্টুলা' এবং প্রকৃত শুদ্ধ নাম কর্ণিকার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছেন 'অমলতাস'। আবার গ্রামা লে এই ফুল পরিচিত বানরলাঠি ফুল হিসেবে। সংসদ ভবন এলাকার মাঝখানে যে রাস্তা রয়েছে সেখানে এই ফুল বেশি দেখা যায়।
কনকচূড়া
কনকচূড়ার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে অনেকের মাঝেই। কেউ কেউ এটিকে রাধাচূড়া বলে জানেন কিন্তু এটি রাধাচূড়া নয়।
রাধাচূড়া গুল্ম শ্রেণির দুর্বল কাণ্ডের উদ্ভিদ। এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম 'পেল্টোফোরাম পেট্রোকার্পাম'। এই তো গেলো নাম নিয়ে বিভ্রান্তি। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ও বিজয়সরণীর খেজুর বাগানের কিনারা থেকে প্লেন পর্যন্ত যে দীর্ঘ রাস্তার রয়েছে সেখানে এই ফুল অধিক পরিমানে দেখা যায়। শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা এই ফুলের নামকরণ করেছেন। ৫ পাপড়ি বিশিষ্ট্য গাঢ় হলুদ রঙয়ের এই ফুলে সুগন্ধে মৌ মৌ করে চারপাশ। তাই এই গাছে মৌমাছিরও দেখা মেলে প্রচুর পরিমাণে।
এই ফুলগুলোর পাশাপাশি গ্রীষ্মে কিছু অপ্রধান ফুলও দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। সেগুলোর মাঝে উদয়পদ্ম, নাগলিঙ্গম, লাল সোনাইল, অশোক, দুলিচাঁপা, পাদাউক অন্যতম। এই ফুলগুলো সাধারণত রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সংসদ ভবন এলাকা, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।
রাজধানীর বাসিন্দা ও প্রকৃতিপ্রেমী নুপুর আক্তার বলেন, "কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল, বকুলসহ বাহারি রকমের ফুলের রঙে রঙ্গিন হয়ে গেছে ঢাকা শহর। মোহনীয় ফুলের সুবাস, হরেক সবুজবীথি, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত সৌন্দর্য কার না ভালো লাগে।
ঢাকা শহর রুপান্তরিত হয়েছে রূপের নগরীতে, যে রুপ দেখলে সারাদিনের ক্লান্তি হতাশা এক নিমিষেই হারিয়ে যায়। কাঠফাটা রোদের মধ্যে এক পশলা বৃষ্টির হাতছানি সাথে রঙবেরঙের ফুল, এ যেন স্বর্গীয় আনন্দ। ফুলগুলো যেন নিরেট কংক্রিটের বুকে ফুটে থাকা একগুচ্ছ সতেজ প্রাণ।"
প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন বলেন, "জাপানে একটিমাত্র ফুল 'চেরী' ফোটার জন্যে উৎসব হয়। আমাদের এখানে জারুল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়ার মতো বর্ণিল এবং বর্ণাঢ্য ফুল রয়েছে এগুলো নিয়েও আমাদের দেশে খুব সহজেই পুষ্প উৎসবের আয়োজন করা যেতে পারে।"
তিনি পরিকল্পিতভাবে এইসব ফুল গাছ রোপনের আহ্বান করে বলেন, "পরিকল্পিতভাবে পৌর শহরগুলোতে এই গাছগুলো রোপন করা হলে শহরের সৌন্দর্য বেড়ে যাবে অনেকগুণে।"