যে দুধকুমারে ভেসেছিল মীর জুমলার নাও
উত্তরে মানে যেখান দিয়ে দুধকুমার ঢুকেছে বাংলাদেশে সেখানটায় যাওয়ার ইচ্ছা আমার সফরসঙ্গী রিফাত ভাইয়ের। আরেক সফরসঙ্গী গনি ভাইও সায় দিল। তাই নৌকা চলা শুরু করল। ৭৫ ফুট দীর্ঘ এক ছইওয়ালা নৌকায় আমরা সতেরজন ভাসছি দু দিন ধরে।
উজানে চলেছি বলে নৌকা খুব গতি তুলতে পারছিল না, ৭-৮ কিলোমিটার বেগে চলছিল। ঘোলা পানির নদ দুধকুমার। বেশ বেগে পানি নামছে উজান থেকে, মনে হয় ভারতের ওই জায়গায় (পশ্চিমবঙ্গের পাটেশ্বরী) বুঝি খুব বৃষ্টি হয়েছে। পানির সঙ্গে অনেক বালি বয়ে আনছে দুধকুমার।
আমাদের এখানে নদটা ৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ, গড় প্রস্থ ২৪ মিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড একে চিহ্নিত করেছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৫৭ নম্বর নদী হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গে এর নাম রায়ডাক বা সঙ্কোশ। ভুটানী হিমালয়ের পাদদেশে এর জন্ম। তারপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ভুরুঙ্গামারির শিলখুরির কাছ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। উৎস থেকে ২২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এটি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখোয়ার কাছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে।
যাত্রাপুরে নৌকা বাঁধা ছিল
কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে চড়ে প্রায় ৯ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ১৪ জন গতকাল (১৩ মে) ভোরে এসে নেমেছিলাম কুড়িগ্রাম। উদ্দেশ্য শহরের জট এড়িয়ে ৩-৪ দিন প্রকৃতিতে থাকা।
ট্রেন থেকে নামার পর স্টেশনের ধারের এক হোটেলে রুটি-ভাজি দিয়ে নাস্তা সারছিলাম আর তখনই নামল বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি! ভুবন ভাসানো বৃষ্টি। আমরা বর্ষাতি গায়ে চড়িয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে ঢুকে বৃষ্টি দেখতে থাকলাম। বেলা দশটা বেজে গেল বৃষ্টি থামতে। তারপর এক অটোয় গাট্টি বোচকা ও শুকনো খাবার-দাবার, এবং অন্য তিনটিতে আমরা সকলে চাপাচাপি করে রওনা হয়ে গেলাম।
ধরলা ব্রিজ পার হয়ে যাত্রাপুরে যাওয়ার মুখের চায়ের দোকানটায় সফি ভাই আমাদের চা খাওয়াতে বসালেন। গরম গরম পুরি, চিনি চাম্পা কলাও খেলাম। কাঁচা ভিটির বাঁশ বেড়ার ছাউনির হোটেল। সদ্য লেপা নাদুস নুদুস মাটির চুলায় দুটি টিনের কেটলি চাপানো। বৃষ্টিদিনে চা খাওয়ার আনন্দ ভাগ করা মুশকিল। চা ও টা শেষ করে আবার অটো চলল।
পথে পথে বাড়ি ছড়ানো ছিটানো, হালকা বসতি। বাড়িগুলো কাঁচা ভিটি এবং টিনেরই বেশি, প্রায় সব বাড়িতেই উঁচু করে খড়ের গাদা রাখা। ধান উঠতে শুরু করেছে এখন, বৃষ্টিটা আর দুই দিন পরে এলে চাষীদের কষ্ট থাকত না। অনেক জমিরই পাকা ধান পানিতে ভেসে যাচ্ছে। চাষীদের কোষা নৌকায় করে ধান কাটতে দেখলাম হাঁটু পানিভরা মাঠে আর ঘাটে। পথে বয়স্ক গাছ দেখলাম না সেরকম। আর গাছ বলতে এখানে একাশিয়া বেশি।
যাত্রাপুর যখন গিয়ে নামলাম তখন দুপুর হবে হবে করছে। বিরাট বাজার বলতে হয়। চালের, ডালের, তেলের, পাউরুটির, ক্রিমের, পেস্টের, গামছার, শাকের, সবজির, পাখার, টিভির, বিস্কুটের, সারের, কীটনাশকের, শাড়ি-লুঙ্গির, দর্জির, ডাক্তারের, কামারের- মানে সবরকমের এবং সবার দোকান আছে বাজারে। কোনো কোনো দোকানে ফ্রিজ, টিউবওয়েল এবং পরিবেশসম্মত মাটির চুলা একসঙ্গেই বিক্রি হয়।
শুক্রবার নামাজের সময় বলে তখন বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ ছিল। আমরা নামাজ শেষ করে বাজার ছাড়িয়ে ধু ধু বালির চর মাড়িয়ে নৌকা ঘাটে গেলাম। একটা দোকানে সবার দুপুরের খাবারের সিস্টেম করা হয়েছে।
বৈরালা মাছ আর ডিমের তরকারি সঙ্গে পাইজাম চালের ভাত। দুধকুমার নদীর বৈরালা মাছ পুরো উত্তরে জনপ্রিয়। কাচকি মাছের মতো দেখতে, মাছটির দামও কম নয়; ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। ঝোল ঝোল রান্না করে খেতে বেশি ভালো। খেয়ে দেয়ে আমরা নৌকা দেখতে গেলাম।
নৌকাটির গলুই বেশ চওড়া, দুইজন পাশাপাশি শুয়ে জলের সৌন্দর্য দেখতে পারবে, তারপর কিছুটা খালি জায়গা আর তারপর ছাউনি দেওয়া জায়গাটি ৪৫ ফুটের কম হবে না। তিন ধাপে সেটি বিভক্ত যেখানে আমরা শুতে পারব, চার-পাঁচজন। মাঝি-মাল্লাদের থাকার জন্যও আলাদা পাটাতন আছে। আমাদের আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো কারণ চটের ঘেরাও দিয়ে বাঁশ খুঁটির অস্থায়ী টয়লেট তৈরি হচ্ছে। প্রধান মাঝি শাহজাহান ভাইও ডিজেল আনতে গিয়ে ততক্ষণে ফেরেননি।
যাহোক সব সামলে নিয়ে নৌকা ছাড়তে চারটা বাজল। উজানে উঠতে থাকলাম। নদীটার দুই পাড়ে বালি আর বালি। দূরে দূরে ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে তিনকোনা নীল রঙা ঠেলা জাল দিয়ে কেউ কেউ মাছ ধরছে। উজান থেকে ঢল নামছে জোর। এটা হচ্ছে সেই নদী যে নিত্যই একূল ভাঙে ওকূল গড়ে। নদীটা আঁকাবাঁকাও বটে। আমরা চলার পর থেকেই পূবধারে ভাঙনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। নদীর মাঝখানেও এক দুজায়গা উঁচু হয়ে থাকতে দেখলাম। মনে হলো সদ্য প্রসূত চর; চরগুলোর এখানে সেখানে দুচার গাছি ঘাস দেখলাম। কাছে পিঠে দেখলাম কিছু ধ্যানী বক আর মাছরাঙা।
এরমধ্যে আকাশে মেঘেরা ঘোট পাকাতে শুরু করেছে। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো। আমাদের সহযাত্রী কাম পাচক হোমায়েদ ইসহাক নুডলস আর চা বানাতে বসে পড়ল। সন্ধ্যা যখন রাতে গড়াল তখন আমরা নৌকা থামানোর কথা ভাবলাম। সহযাত্রী হাসিবের বুঝি মনে ছিল বৌদ্ধ পূর্ণিমার আর মোটে দুই রাত বাকি। তাই কবিতা ভর করে থাকবে তার মাথায়।
সে একটা নীরব বালির চরে নৌকা লাগাতে বলতেই আমরা গুটিকয় মানুষ রে রে করে উঠলাম। চায়ের দোকান নেই, মেঘে চাঁদটাও ঢাকা, ডাকাত পড়লে কী করব, ঝড় এলে ঠাই নিব কোথায়, কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে না ইত্যাদি সব ভাবনা আমাদের মনে জেঁকে বসেছিল। তাই আমরা আরো এগুনোর পক্ষে মত দিলাম।
কাছে পিঠে একটা ড্রেজারেই কেবল কিছু আলো জ্বলছে দেখতে পেলাম। ড্রেজারটি ছাড়িয়ে আরো আধাঘণ্টা চলে আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আলোর দেখা পেলাম। এটি আয়নালের ঘাট। শফি ভাই জানিয়েছিলেন, কুড়িগ্রামে সাড়ে চারশ চর আছে। সংখ্যাটা অবাক হওয়ার মতোই, তবে ছোট-বড় মিলিয়ে তেমনটাই দাঁড়াবে বোধকরি।
বসতি আছে যে চরগুলোর তার সবগুলোতেই বিদ্যুৎ আছে। তবে চরের লোক পাঁকা ঘর বাঁধে না। বসতিগুলো বয়স্ক হওয়ার সময়ও পায় কম। বারবারই ভাঙাগড়ার মধ্যে থাকতে হয় লোকেদের। বড়জোড় মসজিদটা হয় পাঁকা আর তা নদীর ধার থেকে দূরেই হয়।
কুড়িগ্রাম কৃষি প্রধান অঞ্চল। ধান, গবাদি পশু আর মাছ নিয়েই তাদের জীবন। কোনো কোনো চরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই।
আয়নালের ঘাটে রাত গুজরান
ভোর ছয়টা থেকে রাত ১২টা অব্দি আয়নালের ঘাটে জনাসমাগম থাকে। স্থলেপথে যারা বগুড়া থেকে, রংপুর থেকে বা ঢাকা থেকে এসে পূবপাড়ে যেতে চায় তারা এ ঘাটের ওপরই নির্ভরশীল। পারাপারের নৌকাগুলো ফেরি কিছিমের। মাথা চোখা আর পেট মোটা। বসার কোনো ব্যবস্থা নেই এগুলোয়। লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পার হয়। তবে বেশি পার হয় মোটর সাইকেল, ধান মাড়ানো ও ঝাড়ার কল, চাল বা ডালের বস্তা ইত্যাদি।
রাতে আমরা ঘাটে নৌকা ভিড়াতেই চ্যাংড়াপোংড়া কিছু ভিড় করে আমাদের দেখতে দাঁড়ালো। কেউ কেউ কৌতূহলী- কত দূর থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন ইত্যাদি। অনেকে দিল পরামর্শ, যেমন নৌকায় না এসে গাড়িতে এলেই ভালো করতেন।
ঘাট ইজারাদারের ঘরটিই এখানে বড়। তাতে মাঝিদের জন্য রান্নাও হয়। মোট ৮ জন মাঝি ইজারাদারের। একই সময়ে ওইপাড় থেকে একে একটি ছেড়ে আসে এবং আরেকটি এপাড় থেকে ছেড়ে যায়। খুব কমই বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায় মাঝিরা। প্রায়ই বৃষ্টির তোড়ে কাঠে বোনা জেটির মাটি আলগা হয়ে যায় তখন জেটি দুই আড়াই গজ ডান বাম করতে হয়।
সেদিন মাঝিদের জন্য পাংগাস মাছ রান্না হয়েছিল। ইজারাদারের ঘরের দুই পাশে দুইটি করে চারটি চায়ের দোকান। দোকানে প্যাকেট বিস্কুট, চানাচুর, মিনি প্যাক শ্যাম্পু, সাবান, টুথ ব্রাশ, দাঁতের মাজন, চিরুনি, ছোট আয়নাও মেলে। আমরা দল বেধে নেমে চা-বিস্কুট খেলাম।
ওদিকে হোমায়েদ ইসহাক আজগর মাঝিকে নিয়ে মুরগি কাটতে বসেছে। গোটা চারেক ব্রয়লার মুরগি আমরা যাত্রাপুর থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। হোমায়েদও নামতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে ডাবল মুরগির গোশত দেওয়ার লোভ দেখিয়ে গনি ভাই কাজে লাগিয়ে এসেছেন।
সকাল হলো
দশটা নাগাদ আমরা রাতের খাবার খেলাম। এরপর কিছুক্ষণ গান শুনলাম। আমাদের সঙ্গে বয়াতী নেই কেউ তাই মোবাইলে নচিকেতা আর লোপামুদ্রার বৃষ্টির গান শুনলাম। মনিরের মনে পড়ল এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না গানটি। গাইলও দু চার লাইন। আমরা ক্লান্ত ছিলাম বলে আড্ডা বেশি জমল না। ঘুমও চলে এলো দ্রুত। পরদিন সকালে আকাশ ছিল তেঁতুলমাজা কাসার থালার মতো চকচকে।
পাড়ে নেমে আবার চা খেতে গিয়ে জানলাম, আয়নাল নামে ইজারাদার ছিলেন একজন, পূবপাড়ে তার বাড়ি, বেঁচে আছেন এখনো, তার নামেই ঘাটের নাম হয়েছে।
দেখলাম, ঘাট বেয়ে পাড় হওয়াদের মধ্যে বেসরকারি সংস্থার কর্মীরাও আছেন। ওপার থেকে ৯ জনের একটা দল এলো। তাদের মধ্যে দুজন জিন্স পরা অল্পবয়সী আছে বাকীদের বয়স ত্রিশের আশপাশে, লুঙ্গি আর শার্ট পরা। দুএকজনের মুখে ঘন কালো দাড়ি। দলটি একটা অটোর পুরোটা দখল করে ফেলল। তারা বগুড়া যাচ্ছে, সেখানে এখন ধান কাটার ধুম লেগেছে। ঘাটে অপেক্ষমাণ একজনকে দেখলাম একটা বড় কার্টন রেখেছেন ধারে। দেখি তাতে বাচ্চাদের গুঁড়োদুধ বায়োমিলের এক ডজন কৌটা। জানলাম, ওপারে তার দোকান আছে। সকালে আমরা ডিমভাজা ও পান্তাভাত খেলাম, কেউ কেউ নুডলস গিললো।
ফকিরের চরে
সাড়ে দশটায় আজগর মাঝি নাও ছাড়ল। পুরোনো দৃশ্যপট ফিরে এলো আবার- ধু ধু বালি, ঘেসো চর আর আর দূরে দূরে ঘর। ছইয়ের ওপর বসে আমরা ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছি শুধু।
ঘণ্টাখানেক চলে অভিজিৎ কলম্বাসের মতো চেঁচাল, ওই যে ডাঙ্গা, ওখানে থামা যায়। চরটার খাড়া পাড়, চত্বরটা সবুজে মোড়ানো। আমরা থামলাম। দোলন ড্রোনের যন্ত্রপাতি সেট করে ওড়াতে শুরু করে দিল। অভির বুদ্ধিতে আমরা খাঁড়া পাড়ে পা দুলিয়ে বসলাম। দোলন ছবি তুলল টপাটপ।
একবার দোলনের ড্রোন একটা সাদা বককে ট্র্যাক করল কিছুক্ষণ কিন্তু অল্প পরে হেরে গিয়ে রণে ভঙ্গ দিল। এর মধ্যে একটা নৌকা এসে ভিড়ল চরে। দুচারজন নামলেন। একজন গোলাম মোস্তফা। ঘাড়ে বাঁশের বাক বহন করছিলেন। দু প্রান্তে দুটি বড় বড় সিলভারের হাড়ি। খুলে দেখা গেল রসে ডোবানো মোটাতাজা চমচম। মোস্তফা সেই রৌমারি থেকে মিষ্টি নিয়ে এসেছেন এই ফকিরের চরে বিক্রি করতে। রৌমারিতে তার দোকান নেই, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মিষ্টি বানান আর ঘুরে ঘুরে নানান চরে বিক্রি করেন। মোটমাট ৩৭ কেজি মিষ্টি আছে তার দুই হাঁড়িতে। খেয়ে দেখলাম, সুস্বাদু। দাম ঢাকার সমান প্রায়, সাড়ে তিনশ টাকা কেজি। মোস্তফা বললেন, 'কোনো কোনো সময় দুধের কেজি ১০০ টাকাও উঠে যায়। আমরা আপনাদের কমে দিব কিভাবে?' আমরা মাথা ঝাকিয়ে সায় দিতে বাধ্য হলাম।
তারপর দূর থেকে হেঁটে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের এক বয়স্ক লোককে আসতে দেখলাম। তার ঘাড়ে গামছা ঝুলছে। কাছে এসে সেই একই প্রশ্ন করলেন, কোথা থেকে এবং কেন এসেছেন? এবার আমরাও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর? তিনি বললেন, বাড়ি তো সেই পাবনায়। নদী ভাঙল বলেই না দাদা এসে এখানে ঘর তুললেন। ওইপাড়ে মানে পূব পাড়ে বাড়ি তুলেছিলেন শুরুতে। তারপর ভাঙল একবার, ভাঙল দুইবার, ভাঙল তিনবার – শেষে সইতে না পেরে এই পাড়ে চলে এসেছি।
আবার যাত্রা
চলতে চলতে সূর্য যখন পশ্চিমে হেলেছে তখনই রবিন ভাই তাল তুললেন, গোসল করবেন। অন্যরাও এক পায়ে খাঁড়া। একটা আধা ডোবা চর দেখে আমরা থামলাম। দূর থেকে একটা বড় জেলে নৌকা দেখলাম। অনেক ডেকে নৌকাটিকে কাছে আনা গেল। চার পাঁচজন নৌকায়, জালও বড় তবে মাছ সেরকম পায়নি। একটা বড় কাৎলা মাছ আর সাথে কিছু ছোট মাছ আমরা কিনে নিলাম। তারপর গোসল করা চলল ঘণ্টাখানেক। শেষে ভাজা মাছ উল্টে খেয়ে আমরা যাত্রা আবার শুরু করলাম। যেতে যেতে বিকাল নামলে সোনাহাট ব্রিজ দেখতে পেলাম।
ভুরুঙ্গামারিতে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম আরো ৩০-৪০ মিনিট আগেই। ব্রিজটা দেখার আগ্রহ ছিল সকলেরই। এটি উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার পূবে বঙ্গ সোনাহাট ইউনিয়নে (এর পূর্ব পাশে আসাম আর পশ্চিমে পাইকের ছড়া ইউনিয়ন) পড়েছে। স্থানীয়রা একে পাটেশ্বরী সেতু নামেই বেশি চেনে। ব্রিজের ১ কিলোমিটার দূরে পাটেশ্বরী বাজার এককালে দারুণ জমজমাট ছিল।
যাহোক শুরুতে ব্রিজটি ছিল রেল সেতু এখন সড়ক সেতু। তিনটি যুদ্ধের সাক্ষী এ সেতু তার মধ্যে দুটিই বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাস বলছে, ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশরা তাদের সৈন্য ও রসদ পরিবহনের জন্য লালমনিরহাট থেকে ভুরুঙ্গামারি হয়ে মনিপুর যাওয়ার জন্য গোয়াহাটি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে। তারই অংশ হিসাবে এটি তৈরি করা হয়।
সেতুটি ১২০০ ফুট দীর্ঘ। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এর একটি অংশ ভেঙে দেয় যেন পাকবাহিনীর চলাচল ব্যাহত হয়। আমরা নিচ থেকে ব্রিজটি দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর সফি ভাই নৌকা ঘোরানোর তাড়া দিলেন কিন্তু রিফাত ভাই সীমান্তের কাছে যতটা যাওয়া সম্ভব ততটাই যেতে চাইলেন। গনি ভাই সায় দিলে নৌকা এগিয়ে চলল উজানে।
শেষে শেষ চরটায় নৌকা থামল সূর্য ডোবার মুখে। পূব দিক থেকে হালকা বাতাস বইছিল, আকাশে মেঘ ছিল খণ্ড খণ্ড। ভালো লাগছিল কিন্তু এবার যে ফিরতে হয়। রাতে বেশিক্ষণ তো চলার জো নেই। চলতে চলতে আমরা সোনাহাট ব্রিজের নীচে নৌকা ভিড়ালাম।
এ পথ দিয়েই গেছেন মীর জুমলা!
ব্রিজের পূব পাড়ের একটা হোটেলে যেখানে চা, পুরী, পিয়াজু, মিষ্টি সব পাওয়া যায় সেখানে বসলাম। সফি ভাইয়ের সাগরেদ মঞ্জু ভাই যিনি কি না সোনাহাটের স্থানীয়, জানালেন, এখান থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই মীর জুমলার গড়া এক মসজিদ আছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে মগজে ঢেউ খেলে গেল।
মীর জুমলা (১৫৯১-১৬৬৩) ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি এবং বাংলায় সম্রাটের প্রতিনিধি মানে সুবাদার ছিলেন। তিনি ঢাকা ও এর আশপাশে সৈন্য চলাচল, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ পরিবহনের নিমিত্তে দুটি রাস্তা ও সেতু তৈরি করিয়েছিলেন। কয়েকটি দুর্গ তৈরি করেছিলেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংহত করার স্বার্থে।
বুড়িগঙ্গার তীরে মীর জুমলা দুটি কামান স্থাপন করেছিলেন। তার একটির নাম ছিল কালে খা জমজম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মকর্তা রবার্ট লিন্ডসে এটি দেখে অবাক হয়েছিলেন আর বলেছেন কামানটি ছিল ৩৬ ফুট লম্বা।
কামরুপ ও আসাম অভিযান ছিল মীর জুমলার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি কামরুপ রাজ্যের বিরুদ্ধে মূল সৈন্যবাহিনী ও নৌবহর পাঠান, নিজে রওনা হন কোচবিহারের রাজাকে শায়েস্তা করতে। কোচবিহার দখলের পর তিনি মূল বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে আসাম যাত্রা করেন। সেটা ছিল ১৬৬১ সাল। তাঁর বাহিনীতে ছিল ১২ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৩২৩টি জাহাজ ও নৌকার বিশাল বহর।
আরো জানা গেল, ওই অভিযানকালে তিনি ভুরুঙ্গামারিতে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। অবস্থানকালে মীর জুমলা পাইকের ছড়া ইউনিয়নের ফুটানী বাজারের দক্ষিণে একটি মসজিদ নির্মাণ করান। তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন ঢাকা থেকেই আর রণতরী ও নৌকাগুলোকে দুধকুমার নদে অবস্থান নিতে বলেছিলেন।
নিজে স্থল পথে রওয়ানা দিয়ে ভূরুঙ্গামারী পৌঁছান। আবহাওয়া প্রতিকূল ছিল বলেই তিনি ভূরুঙ্গামারিতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন আর মসজিদটি সেই সময়েই নির্মাণ করিয়েছিলেন মীর জুমলা। ইতিহাস বলছে, সেই অভিযানে জুমলার প্রতিটি বড় জাহাজ বা গুরবে ছিল ১৪টি করে কামান আর ৫০-৬০ জন কামান অপারেটর। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে ছিল চারটি করে কোষা নৌকা।
উল্লেখ্য মীর জুমলার আসাম অভিযানে ব্যবহৃত একটি কামান যার নাম বিবি মরিয়ম সেটি এখনো ঢাকার ওসমানী উদ্যানের শোভা বাড়াচ্ছে। ৬৪ হাজার ৮১৫ পাউন্ড ওজনের কামানটি প্রথমে রাখা হয়েছিল সওয়ারিঘাটে। ১৮৪০ সালে এটিকে চকবাজার এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ১৯১৭ সালে ছিল সদরঘাটে আর ১৯৮০ এর দশকে আনা হয় ওসমানী উদ্যানে।
রিফাত ভাইয়ের সঙ্গে ব্যাপারটি শেয়ার করলে তিনি বললেন, ব্রহ্মপুত্র ধরেই মীর জুমলার যাত্রা করার কথা। আসাম অভিযানে সেটাই সহজ পথ। আমি ভাবলাম, এটা ভারি অবাক করা ব্যাপার, আমরা মীর জুমলার পথ ধরে চলেছি!
রাতটা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল
মনজু ও সফি ভাইকে সোনাহাট ব্রিজে বিদায় জানিয়ে আমরা নৌকায় উঠে পড়েছিলাম। অন্ধকার ততক্ষণে জেকে বসেছে। চাঁদ মেঘের আড়াল ফুড়ে বের হতেই পারছিল না। আমরা চলতে চলতে চলে এলাম আয়নালের ঘাটে কিন্তু থামলাম না।
আমরা আগের রাতে হাসিবের পছন্দের ওই নীরব বালির চর খুঁজতে সামনে এগিয়ে গেলাম কিন্তু কোনোভাবেই জায়গাটি চিহ্নিত করা গেল না, শেষে বৃষ্টি চলে এলো। আমরা একটা বালুচরে নৌকা বাধতে বাধ্য হলাম। দুপুরের কেনা মাছগুলো এর মধ্যেই রান্না ও ভাজা হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভোজ সেরে নিতে নিতেই ঝড় উঠল। মাঝিরা পলিথিন দিয়ে পুরো নৌকা ঘিরে দিল কিন্তু মাঝে মধ্যে পলিথিনের ফাঁক গলে বৃষ্টি ঢুকে পড়তে লাগল নৌকার ভিতর। গনি ভাই আর রবিন ভাই কষ্টেসৃষ্টে সামাল দিলেন, ততক্ষণে রাত বেজে গেছে দুইটা।
চিলমারি হয়ে ফেরা
পরদিন ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল সূর্য জাগারও আগে। ভোরের আলোয় চরটাকে মায়াবী দেখাল। বালির ওপর হেঁটে যেতে ভালো লাগল। লম্বা পায়ের হট্টিটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, আরো কিছু নাম না জানা পাখিও পেলাম।
সেদিন আমরা তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে ছিলাম। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে আজ। নিচের দিকে মানে স্রোতের অনুকূলে নৌকায় করে নামতে বেশ আরাম। অভির হাতে বাঁধা ডিভাইস জানাচ্ছে নৌকার বেগ ১৭ কিলোমিটার প্রায়।
আজ দুধকুমার পেরিয়ে আমরা পাবো ধরলার মুখ, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তার মুখ তারপর যমুনা। কুড়িগ্রাম থেকে গাইবান্ধার ওপর দিয়ে যাবো জামালপুর। যাত্রাপুরে কিয়ৎকাল যাত্রাবিরতি দিয়ে আবার চলে দুপুরের আগেই পৌঁছালাম চিলমারি।
আব্বাসউদ্দিন গেয়েছিলেন, হাকাও গাড়ি তুমি চিলমারি বন্দরে রে। ব্রিটিশ আমলে বন্দরটিতে বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। নদীর নাব্যতা না থাকায় এখন আর জাহাজ ভিড়ে না। বন্দরের পাড় সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধানো। আমরা দূর থেকে অনেক নৌকা ঘাটে লেগে থাকতে দেখলাম।
আমাদের আজগর মাঝি জানাল আজ হাটবার। দূর দূর চর থেকে হাজার হাজার মানুষ চিলমারিতে হাট করতে আসে। গরুর বড় বাজারও বসে হাটে। বেশিরভাগ নৌকাতেই গরু দেখলাম, দেশি গরু বেশি। হাটের লাগোয়া চরে অস্থায়ী চায়ের দোকান বসেছে বেশ কিছু।
আমরা ঘোরার সময় পেলাম অল্প। তার মধ্যে ভাগ্যবদলকারী আংটি বিক্রেতাকে দেখলাম, মুড়ি মুড়কি বিক্রেতাও দেখলাম। গাছ-গাছড়ার বনাজী শরবতের দোকানও আছে। অভি সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটি রুই মাছ কিনল। নৌকা আবার ছাড়তেই সে মাছ ভাজা হতে থাকল।
আমরা শেষে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছাতে পেরেছিলাম যমুনার বাহাদুরাবাদ ঘাটে। বহুজনের বহু স্মৃতি বিজড়িত এ ঘাট। এখানে রেলপথ এসে পৌঁছেছিল একশ দশ বছর আগে ১৯১২ সালে। যমুনার ওপারে রেলফেরি দিয়ে তিস্তামুখ ঘাটে যাওয়া যেত, সেখান থেকে রেলপথ আবার চলে গিয়েছিল শান্তাহার।
ট্রেনের সঙ্গে আমাদের সময়ের মিলমিশ হলো না বলে বাসে করে ঢাকায় ফেরার পথ ধরতে হয়েছিল আমাদের। বাসে উঠেই ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। আর পরের ভোরেই পৌঁছে গিয়েছিলাম শব্দ, ধোঁয়া, ধুলা, যান ইত্যাদি সব জটের এ শহর ঢাকায়।