বেশি করে টাকা ছাপালেই তো হয়! আসলেই কি তা-ই? ইতিহাসের কয়েকটি উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতির গল্প
মুদ্রাস্ফীতি যখন অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ে, তখন তাকে উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতি বা হাইপারইনফ্লেশন বলে। সাধারণত প্রতি মাসে জিনিসপত্রের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেলে তাকে উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতি হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে খুব দ্রুতই স্থানীয় মুদ্রার মান পড়ে যায়।
১৯০০ সালের পর থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৫৫ বার উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, অনেকগুলো দেশই মারাত্মক উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। এর বেশিরভাগের পেছনেই মূল কারণ ছিল যুদ্ধ। চলুন জেনে আসা যাক নজিরবিহীন উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতির কয়েকটি ঘটনা ও তার পেছনের কারণগুলো।
ভাইমার জার্মানি (১৯২২-১৯২৩)
১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হয় (ডিফল্ট) জার্মানি। তার জবাবে মিত্রশক্তি দেশটির রুর ভ্যালি নামের একটি প্রধান শিল্প এলাকা দখল করে সেখানকার উৎপাদিত পণ্যগুলোকে জব্দ করে। তখন ভাইমার সরকার একধরনের 'পরোক্ষ প্রতিরোধ'-এর পন্থা অবলম্বন করে। এ কৌশল অনুযায়ী, সরকার কর্মীদের বেতনভাতা চালু না রাখলে কর্মীরা বিদেশি সেনাদের অধীনে কাজ করবে না বলে জানিয়ে দেয়।
তখন শ্রমিক-কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য বেশি করে মুদ্রা ছাপানো হয়। প্রাথমিকভাবে এটিকে সাময়িক বিকল্প হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু মিত্রশক্তির ক্রমাগত স্থান দখলের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ছাপানো ও তা জনগণের মধ্যে সরবরাহ করার পরিমাণও বেড়ে যায়।
এ জন্য তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩০টির বেশি কাগজ কারখানা, প্রায় ১৮০০ ছাপাখানা, ও ১৩৩টি কোম্পানি ব্যবহার করেছিল ব্যাংকনোট ছাপানোর জন্য। এর ফলে সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে এক টুকরা রুটি কিনতে ২৫০ রাইখসমার্ক খরচ হলেও নভেম্বরের মধ্যে তা পৌঁছে যায় দুই লাখ মিলিয়নে।
এভাবে দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে শ্রমিকদের প্রায়ই দিনে দুইবার বেতন পরিশোধ করা হতো। মুদ্রাস্ফীতি তখন কতটা বেড়েছিল তার একটি হিসাব দেওয়া যাক। ১৯২৩ সালে একটি ডিম কিনতে যত রাইখসমার্ক খরচ করা লাগতো, ১৯১৮ সালে একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৫০ হাজার কোটি ডিম কেনা যেত।
কিংডম অভ হাঙ্গেরি (১৯৪৫-১৯৪৬)
যদিও উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতি'র কথা আসলে সবাই ভাইমার জার্মানির ইতিহাসকেই উদাহরণ হিসেবে দেখায়, তবে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল হাঙ্গেরিতে (তৎকালীন কিংডম অভ হাঙ্গেরি)।
১৯৪৪ সালে জার্মান ও রাশিয়ান বাহিনী হাঙ্গেরিতে মুখোমুখি হয়েছিল। এর ফলে হাঙ্গেরির শিল্পোৎপাদন ক্ষমতার ৯০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি নাৎসিরা অনেক কিছু জার্মানিতে নিয়ে গিয়েছিল, আবার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাশিয়ানরাও হাঙ্গেরির সম্পদ নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল।
উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল। তা প্রতিরোধের চেষ্টা হিসেবে সরকার পেঙ্গোর (তৎকালীন হাঙ্গেরীয় মুদ্রা) সার্কুলেশন বাড়িয়ে দিলো।
ভাইমারের মতোই হাঙ্গেরিতেও জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করলো। প্রতি ১৫ ঘণ্টায় প্রতিটি জিনসের দাম দ্বিগুণহারে বেড়ে যেতে থাকল। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো জিনিস কিনতে ৩৭৯ পেঙ্গো লাগলে, ১৯৪৬ সালের জুলাইয়ে তার দাম বেড়ে পৌঁছাল এক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পেঙ্গোতে।
ট্রিলিয়নেরও ট্রিলিয়ন মানে অসংখ্য শূন্য। একদম ছোটখাটো কোনো কিছু কিনতেও এত পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতো। তখন পেঙ্গোর মান বাড়িয়ে এমপেঙ্গো ও বিপেঙ্গোতে পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
এ সময় বাধ্য হয়ে সরকার ট্যাক্স সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। তখন মুদ্রার মান বাড়িয়ে অ্যাডোপেঙ্গো করা হয়। কিন্তু জনগণের দুঃখ তাতে কোনোঅংশে কমেনি।
দ্য ফেডারেল রিপাবলিক অভ যুগোস্লাভিয়া (১৯৯২-১৯৯৪)
কয়েকবছর ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের পর ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের কারণে দেশের ভেতর বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এর ফলে নবগঠিত ফেডারেল রিপাবলিক অভ যুগোস্লাভিয়া'র উৎপাদন তলানিতে ঠেকে। আমদানিনির্ভর দেশটির প্রতি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে জাতিসংঘ একটি বাণিজ্য-অবরোধ আরোপ করে।
এসবের পাশাপাশি দেশটির আমলাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খাতের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যায় করার প্রয়োজন হয়। রাজস্ব ঘাটতি আরও বেশি হতে থাকলে দেশটিতে পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। সরকার মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর পথ অবলম্বন করে।
এতে যা হওয়ার তা-ই হয়। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি এক লাফে ৩১৩ মিলিয়ন শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতি আড়াইদিনে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে। অনেক দোকান তখন দিনার (মুদ্রা) গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করে। রুটি-দুধ এসব কেনার জন্য মানুষকে কালো বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়।
জিম্বাবুয়ে (২০০৭-২০০৮)
সেই ১৯৬০-এর দশক থেকেই জিম্বাবুয়েতে ব্যাপকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ছিল। কিন্তু ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এটি লাগামছাড়া হয়ে যায়। ফলে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটে।
বাজারে মুদ্রার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে এ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধও এর পেছনে বড় কারণ ছিল। ভূমি পুনর্ব্যবস্থাপনার কারণে দেশটির বহুমূল্য তামাক চাষও সংকুচিত হয়ে পড়ে।
অন্যান্য মুদ্রাস্ফীতির মতোই জিম্বাবুয়ের মানুষের কাছেও টাকার পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়। দেশটিতে তখন একশ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানের নোটও ছাপানো হয়। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ টাকার বদলে বিনিময় প্রথাও অবলম্বন করে।
দেশটিতে দৈনিক মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশে ও মাসিক সর্বোচ্চ ৭.৯৬ x ১০১০%-এ পৌঁছায়। পাঠক চাইলে বসে বসে এখানে কতগুলো শূন্য তা হিসাব করতে পারেন।
- সূত্র: স্কাই হিস্ট্রি