বাংলাদেশের ‘ইউটিউব কিং’ কে? যাকে ভাবছেন তিনি নন
মে মাসের এক উত্তপ্ত দুপুরে নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম ঈশ্বরদেবতায় এক লোক হাতে কাঁঠাল নিয়ে বসে আছেন একটি গাছের নিচে।
তার পাশে দাঁড়ানো এক নারী। ভ্যানে স্থাপিত একটি অস্থায়ী দোকানের দেখভাল করছেন। আবির (রঙ) মেশানো পানির বয়াম বিক্রি করছেন তিনি। নাটকীয় কণ্ঠ ও অতিরঞ্জিত অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদের ডাকছেন এই নারী।
এখানে কী ঘটছে তা বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে ওই নারীর দিকে কাঁঠাল ছুঁড়ে মারল। কাঁঠালটি ভ্যানে আঘাত করায় কাঁচের বয়ামগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো রঙ মিশ্রিত পানি।
তাদের এই কাণ্ড দেখতে আসা আরও অনেককেই দেখা গেল চারপাশে জড় হয়ে উল্লাস করতে। আসলে তারা দুজনেই পেইড অভিনেতা। একটি ইউটিউব ভিডিওর শুটিং করেছেন তারা। কাঁঠাল নিয়ে মানুষ ঠিক কী ধরনের মশকরাতে মেতে ওঠে তা নিয়ে বানানো হচ্ছে ভিডিও।
পুরো ভিডিওটি এডিট করে, তাতে মজার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যোগ করে আপলোড করা হবে ইউটিউবে।
এই ভিডিওর লেন্সের পেছনের কারিগর দলের নেতা মতিউর রহমান মিথন। ঈশ্বরদেবতা গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে ভিডিওটি বানাচ্ছেন তিনি।
মিথন নিজেকে 'মজার রাজা' (কিং অব ফানি) বলে উল্লেখ করেন। হাস্যরসাত্মক ভিডিও সবধরনের দর্শককে আকৃষ্ট করে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মিথন সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের ইউটিউব কিং।
তার ভিডিওগুলো সবমিলিয়ে ইউটিউবে ৮ বিলিয়নেরও বেশিবার দেখা হয়েছে। একাধিক চ্যানেল রয়েছে তার। সবমিলিয়ে চ্যানেলগুলোতে সাবস্ক্রাইবার প্রায় ৩০ মিলিয়ন।
তবে অল্প কিছু লোকই তাকে দেশের শীর্ষ ইউটিউবার হিসেবে চেনেন। তার সমসাময়িকদের মতো মিথনের নাম সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নেই।
লাইমলাইট থেকে অব্যাহতি
যদিও মিথন তার কিছু ভিডিওতে অভিনয় করেছেন, তিনি লাইমলাইট থেকে দূরে থাকতে চান। তার আশঙ্কা, এর ফলে তার ওপর 'খারাপ নজর পড়বে'।
পর্দার আড়ালে থেকেই মিথন নিজের এবং তার আশেপাশের অন্যান্য গ্রামবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন করে আসছে।
তার অধীনে প্রায় ৭০ জন কাজ করে বলে জানান তিনি। কেউ অভিনেতা, কেউ নিরাপত্তা প্রহরী, কেউবা রসদে। তিনি প্রত্যেককে মাসিক বেতন হিসেবে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা দেন।
মিথন বলেন, "আমার সাথে যারা কাজ করে তারা বেশিরভাগই কোনো প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নয়। আমি তাদের নিয়োগ না করলে এই তরুণেরা মাদকাসক্ত হয়ে যেতে পারে।"
তার ভিডিওগুলো মূলত বাংলাদেশের গ্রাম্য পরিবেশের উপর ভিত্তি করে বানানো হলেও মিথনের ফ্যানবেস কিন্তু শুধু এই সীমানায় আবদ্ধ নয়। পর্তুগাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত থেকে সৌদি আরব- সারা বিশ্বের লোকেরা তার ভিডিওর নিয়মিত দর্শক।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওটি প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
মিথন বলেন, "আমার ভিডিওগুলো এক দিনে কয়েক মিলিয়নের কাছাকাছি ভিউ পেয়েছে।"
"যদি কোনো ভিডিও আপলোড করার পর প্রথম দিনে এক মিলিয়নেরও কম ভিউ পায়, তাহলে আমি এটাকে কম পারফরমিং কন্টেন্ট হিসেবে বিবেচনা করি," বলছিলেন তিনি।
মহা ফান টিভি এবং বিজি ফান লিমিটেড, তার দুটি প্রধান ইউটিউব চ্যানেল। ২৫ মিলিয়নেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে এই দুটি চ্যানেলে।
তবে মিথনের আরও কিছু চ্যানেল রয়েছে যেগুলোর নাম প্রকাশ করতে চান নি তিনি।
স্ক্রিপ্টেড প্র্যাঙ্ক ও সহজ কন্টেন্ট
মিথনের ভিডিও বিষয়বস্তু মূলত প্র্যাঙ্ক এবং স্ল্যাপস্টিকের উপর নির্ভরশীল। কিছু ভিডিও এতটাই অযৌক্তিক যে সেই অযৌক্তিকতাই হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু ভিডিও আছে যেগুলো বেশ গ্রাফিক। তবে মিথনের বেশিরভাগ ভিডিও তৈরি হয় অযৌক্তিক স্ক্রিপ্ট এবং অপেশাদার মানুষের ওভাররিয়্যাক্টিং নিয়ে।
ভিডিওগুলো স্ল্যাপস্টিক, শক হিউমার, প্র্যাঙ্ক এবং ক্রিঞ্জের মিশ্রণ। তবে মিথনের প্র্যাঙ্কগুলো স্ক্রিপ্টেড হওয়ায় কারো কোনো ক্ষতি হয়না এতে।
তার ভিডিওগুলো সবার জন্য নয়। এমনকি এগুলো কোনো ধরনের কমেডিও নয়।
কিন্তু মিথনের সব ধরনের দর্শকের প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েক বছর আগে বেঁচে থাকার জন্য একটি চাকরির আশায় মরিয়া মিথনের অধীনে এখন কাজ করছেন অন্যরা। এজন্যে যে সর্বপ্রকারের দর্শক প্রয়োজন হয়না তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন।
এখন তিনি জনগণের কাছে একজন হিরো হিসেবে গণ্য হন।
"আমি ছোটবেলায় আমার বাবাকে হারিয়েছি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমি মিথন ভাইয়ের জন্য কাজ শুরু করি। তখন থেকে আমি আর আমার মাকে কষ্ট করে কাজ করতে দেইনি," বলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী সাথী আক্তার। মিথনের দলে কাজ করে তার পরিবারকে সাহায্য করছেন এই অভিনেত্রী।
তার মতো আরও অনেক স্থানীয়দের সাহায্য করেছে মিথন।
তিন বছরে জিরো থেকে হিরো
"২০১৭ সালে যখন আমি একটি স্মার্টফোন কিনি তখন ফোন কোম্পানি আমাকে ৫ গিগাবাইট ইন্টারনেট বিনামূল্যে দেয়। ইন্টারনেটের মেয়াদ ছিল ৭ দিন," বলছিলেন মিথন।
"কেউ একজন আমাকে বলেছিল ইউটিউবে ভিডিও দেখার জন্য প্রচুর ডেটার প্রয়োজন হয়। তাই আমি ভিডিও দেখা শুরু করি। তখনই আমি বুঝি যে ইউটিউব ভিডিও তৈরি করে আমি আয়ও করতে পারি।"
মিথন বলেন, "আমি আমার বাবার কাছ থেকে নিজের খরচ চাইতে পারি। কিন্তু যখন আমার স্ত্রীর জন্য একটি সাবান কেনারও দরকার পড়ে, তখন বাবার কাছ থেকে টাকা চাওয়া সত্যিই কঠিন।"
অল্প বয়সেই বিয়ে করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছিলেন তিনি।
ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জন সম্ভব জানার পর তিনি কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের দলে নাম লেখান।
একটি যাত্রা থেকে কয়েকটি ভিডিও রেকর্ড করেন তিনি। ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি ইউটিউবে ৩ মিলিয়ন ভিউ পায়। অবশ্য সেগুলো তার নিজস্ব কন্টেন্ট ছিল না।
"আমি সবসময়ই দ্রুত ধনী হতে চেয়েছিলাম। মজার ভিডিওই একমাত্র উপায় যা আমাকে দ্রুত অর্থ এনে দিতে পারে," মিথন বলেন।
"ব্যাকগ্রাউন্ডে মজার মিউজিকসহ কাউকে পুকুরে ঠেলে দেওয়ার একটি ভিডিও আমি আমার বন্ধুদের দিয়েই বানাতে পারি। তাদেরকে চা বা হালকা কোনো খাবার খাওয়ালেই তারা এধরনের ভিডিও তৈরিতে আমাকে সাহায্য করে।"
মিথনের বন্ধুরা শুরুতে সন্দিহান থাকলেও অবশেষে তাকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়। তিনি তাদের সহায়তায় কয়েকটি ভিডিও বানান। সেগুলো দেড় বছরে তাকে ৪ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার পেতে সাহায্য করে। ভিডিওগুলোর যথেষ্ট ভিউ থাকায় সেখান থেকে উপার্জনও শুরু করেন তিনি।
কিন্তু কিছু কপিরাইট সমস্যার কারণে তিনি চ্যানেলটি মনেটাইজ করতে পারেননি।
"আমার বন্ধুরা এবং আমার সাথে যারা কাজ করেছে তারা জানত না যে আমি ইউটিউবে অর্থ উপার্জন করব। যদি তারা সেসময় জানত, তাহলে সেভাবে সহযোগিতা করতো না। তখন তারা নিজেদের আনন্দের জন্য কাজ করেছিল।"
এরইমধ্যে তার বাবা ও ভাইসহ গ্রামবাসীরা মিথনের অর্থ উপার্জনের মাধ্যমকে বিদ্রুপ করা শুরু করে।
২০১৯ সালে তিনি রাজশাহী থেকে একটি নগদীকৃত (মনেটাইজ করা) চ্যানেল কেনেন। মহা ফান টিভি নামক চ্যানেলটি বর্তমানে তার প্রধান চ্যানেলগুলোর মধ্যে একটি।
"সেই বছর ইউটিউব কোনো কারণে সব ফানি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কোনোভাবে মহা ফান টিভি সে যাত্রায় বেঁচে যায়," মিথন বলেন।
মাত্র ৩ হাজার সাবস্ক্রাইবার নিয়ে খুব ছোট একটি চ্যানেল ছিল সেটি।
"যখন আমি মহা ফান টিভিতে আমার কন্টেন্ট আপলোড করা শুরু করি তখন এই অঞ্চলে আমার চ্যানেলটিই একমাত্র কমেডি চ্যানেল ছিল। আমি যা ই পোস্ট করতাম তা ই লাখ লাখ ভিউ পেতো," বলছিলেন তিনি।
খুব শিগগিরই সাবস্ক্রাইবার বাড়তে থাকে তার চ্যানেলে। তবে সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি।
ভিউয়ার বাড়ানোর জন্য তিনি আরও কয়েকটি চ্যানেল খোলেন। আজ তিনি শুধুমাত্র শীর্ষ 'ফানি' কন্টেন্ট ক্রিয়েটরই নন; সাবস্ক্রাইবার, ভিউয়ের বিবেচনায় তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ ইউটিউবার।
এখন তার বৃদ্ধ বাবা রজব আলীও ছেলেকে নিয়ে গর্বিত।
"আমি কখনই ভাবিনি আমার ছেলে এত বড় হবে, এত লোককে নিয়োগ দিতে পারবে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে সে এত কিছু পাবে," মিথনের অফিসের পাশে একটি চায়ের স্টলে আমাদের সাথে কথোপকথনের সময় বলেন রজব আলী।
স্টলের বৃদ্ধ চা বিক্রেতাও আমাদের চায়ের বিল নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মিথনের বিলে তার স্টল চলে বলে জানান তিনি।
বিকেলে যখন আমরা ফিরতে যাচ্ছি, তখন মহা ফান টিভির অফিসের পাশে বেশ কয়েকটি দল কাজ করছিল।
আমরা মিথনকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে তার চেয়ে বড় ইউটিউবার আছে কি না।
"অবশ্যই আমি বাংলাদেশের শীর্ষ ইউটিউবার। আমার মত এত বেশি সাবস্ক্রাইবার আর কোন ইউটিউবারের নেই। সময় নিউজ চ্যানেলের চেয়েও আমার দুই চ্যানেল মিলিয়ে বেশি সাবস্ক্রাইবার আছে," বলেন তিনি।
মিথন হাসতে হাসতে বলেন, "মোগল নয়, আমি মজার রাজা।" তার ম্যানেজার আলমগীর হোসেন ব্যঙ্গ করে বললেন, "সবকিছুরই রাজা!"