কোনো কিছুই আর অধরা নেই! বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের ঘড়ি, জুতা- সব পৌঁছে যাবে দোরগোড়ায়!
অনেকেই একটু বেশি টাকা দিয়ে হলেও পছন্দের ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করতে চায়। জুতা, ঘড়ি কিংবা পারফিউম, পোশাক- এই তালিকায় উপরের দিকে। কিন্তু মুশকিল হলো সাধ্য থাকলেও চাইলেই এসব হাই-এন্ড মার্কেটের বিদেশি পণ্য দেশের বাজারে সহজলভ্য নয়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় জুতা বা স্নিকার্সের কথা। বিশ্বখ্যাত নাইকি, অ্যাডিডাস, পুমা এখানে সঠিক দামে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সঙ্গে এমন যদি হয় আপনি নাইকির একেবারে 'লেটেস্ট' স্নিকারটিই পরতে চান! এক্ষেত্রে হয় কি, যাদের বিদেশে আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের মাধ্যমে আনার চেষ্টা করে। এজন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হয় লম্বা সময়। আর বিকল্প হচ্ছে চীন থেকে আসা কপি কিনে সন্তুষ্ট থাকা। কিন্তু এই পথে আসলে শৌখিন মানুষের অধিংকাশই হাঁটতে চান না।
বিদেশ থেকে কাঙ্খিত পণ্যটি কিনতে না পেরে অনেকেই প্রতিবেশী ভারতের বাজারের কথাও ভাবে। তবে সময়ে 'ধরা যায় না' এমন অনেক কিছুও সহজ হয়ে ধরা দিতে পারে।
এরকম একটি উদ্যোগের নাম 'আর্টিশিপ'।
২০২০ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানটির। দুই বন্ধু জারীর ইবনে কামাল মিলু ও মাহমুদুল হক মুন্সি বাঁধনের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন এই ব্যবসা। মিলু কাজ করতেন 'আউটডোর অ্যাডভারটাইজিং ফার্ম' এ। এখন প্রবাসী মুন্সি বাইরে থেকে পণ্য ক্রয় করা ও তা বাংলাদেশে পাঠানোর কাজ করেন। বাংলাদেশের অংশ সামলান মিলু।
এটি মূলত অনলাইনেই এর কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বিদেশের কোনো পণ্য পছন্দ হলে পণ্যটির কোম্পানি ও কোড টুকে নিয়ে আর্টিশিপের সাথে যোগাযোগ করুন। সেই কোড ও সাইজ দিয়ে আর্টিশিপের ফেসবুক পেইজে (Artyship) মেসেজ দিয়ে পণ্যটি সম্পর্কে জানালে সেখান থেকে পণ্যের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে পূর্বেই টাকা পরিশোধ করতে হয়। টাকা পরিশোধের চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে যায়। পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর ক্রেতাকে আর অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না।
এছাড়াও যারা নিজ হাতে পরখ করে ক্রয় করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যও রয়েছে আলাদা সুবিধা। রামপুরায় আর্টিশিপের আউটলেটে গিয়ে নিজের পছন্দমতো জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে পূর্বে টাকা পরিশোধ করতে হয় না।
বিদেশ থেকে কোন ধরনের পণ্য আনা যাবে
২০২০ সালের ২২ মে এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। প্রথমদিকে শুধুই স্নিকার্স আনা-নেওয়া করতো এই প্রতিষ্ঠানটি। জুতার ক্ষেত্রেই কেন এই বিশেষ গুরুত্ব তা জানতে চাইলে এই সহ-উদ্যোক্তা জানান, "আমাদের দেশে অনেক ক্রীড়াবিদ রয়েছেন তারা জুতা নিয়ে নানান ধরনের সমস্যায় পড়েন। এছাড়াও যারা প্রফেশনালি ম্যারাথন করেন কিংবা স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করেন তারা এই সমস্যায় একটু বেশীই পড়েন। মূলত দেশীয় বাজারে ভালো জুতার অপ্রতুলতা ও ভোক্তাদের ভালো পণ্যের প্রতি আগ্রহই আমাদের এই ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।"
প্রথমদিকে জুতা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও সময় ও মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে এই ব্যবসার পরিধিও। নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হচ্ছে এর পণ্য তালিকায়। জুতার সাথে এখন এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে জার্সি, ওয়ালেট, ভ্যানিটি ব্যাগ, ঘড়ি, সানগ্লাস, খেলাধুলা সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্য আনার সুযোগ রয়েছে।
পণ্যের দাম ও ব্রান্ড
বাংলাদেশে যেসকল কোম্পানির পণ্য পাওয়া যায় না কিন্তু দেশে চাহিদা রয়েছে সেসকল কোম্পানির জিনিসই মূলত এখানে অর্ডার করে কেনার সুযোগ রয়েছে। তবে ইউরোপের ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানিই হতে পারে। তবে প্রধানত এখানে অ্যাডিডাস, নাইকি, গুচ্চি, হুগো বস, নিউ ব্যালেন্স, ফেরারি, জি-সক, রে-ব্যান, মাইকেল কর্স, রিবকসহ বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের প্রাধান্য রয়েছে।
পণ্যের দামের সাথে শিপিং চার্জ ও ডলার চার্জ যুক্ত করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয় বলে জানিয়েছেন মিলু। নির্ধারিত দামের চেয়ে যদি পরিবহন চার্জ কিংবা অন্য কোন বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে তা আর্টিশিপই বহন করে।
মিলু বলেন, "এসব ব্রান্ডের নাম শুনতেই অনেকে কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ভাবেন এসব উচ্চবিত্তের জন্য। কিন্তু বাস্তবে এসব পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতা মধ্যবিত্তেরও রয়েছে।"
এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্ব অর্ডারের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য এনে দেওয়ার পাশাপাশি অনেক পণ্য বিক্রয়ও করা হয়। এই পণ্যগুলোর মধ্যে জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ, ওয়ালেট, ঘড়ি, শটস ও জার্সি অন্যতম। সর্বোচ্চ দামের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নাই তবে এখানে থাকা পণ্যের বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের সর্বনিম্ন দামের একটি তালিকা দেওয়া যেতে পারে। স্নিকার্স, ভ্যানিটি ব্যাগ, ঘড়ি, জার্সি ও সানগ্লাসের দাম যথাক্রমে ৭ হাজার, ১০ হাজার, ১২ হাজার, ৩ হাজার ও ১২ হাজার থেকে শুরু হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ দামের ক্ষেত্রে কোনো সীমা দেওয়া নেই এই আর্টিশিপে।
অন্যদের থেকে এই প্রতিষ্ঠান কেন আলাদা
দেশে এইধরনের আরও প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের প্রক্রিয়া একটু জটিল হওয়ায় মানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি। ডলারের হিসেবে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয় বলে ডলার চার্জ দিতে হয়। এছাড়াও তারা পণ্যের দামের সাথে শিপিং চার্জ কিংবা আরও অন্যান্য খরচ আলাদা করে জুড়ে দেয়। পণ্যের ওজন জানা, ছাড়ার শিপিং চার্জ নির্ধারণ কিংবা আরও কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে যার কারণে তারা আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। আর্টিশিপ এক্ষেত্রে আলাদা। তারা অর্ডারকৃত পণ্যের সকল হিসাব নিকাশ করে টাকার অঙ্কে হিসেব দেন বলে মানুষের বোধগম্য হয়েছে বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা জারীর ইবনে কামাল মিলু।
এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠান অর্ডারকৃত পণ্যগুলো কেনার পর পাঠানোর পূর্বেই ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী দেখিয়ে নেয়। আর কোনো পণ্য কিনতে পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ক্রেতাকে তার টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
এছাড়াও অনলাইনে সবার অর্ডারের হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে, তাই কোনো ভুল হবারও সম্ভাবনা নেই। এসব কারণেই ক্রেতারা আর্টিশিপকে বিশ্বাস করে বলে দাবি করেছেন মিলু।
আগামীর বাজার ও পরিকল্পনা
দিন দিন মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ছে। তাই এখনও সন্তানদের পায়ে জুতা গলিয়ে বাবা-মা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন সাইজ ঠিক আছে কি-না। তাদের বুঝতে হবে জুতা কিংবা অন্য যেকোনো পণ্যই হোক না কেন তা সম্পর্কে প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত, 'এটি আরামদায়ক কি-না?'। যুব সমাজের একটি বিরাট অংশের মধ্যে আরামদায়ক পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা তৈরী হয়েছে। পাশাপাশি ডাক্তাররাও এখন অনেককেই আরামদায়ক জুতা পরিধানের পরামর্শ দেন। এতে করে বাজারে ভালো মানের পণ্যের চাহিদা তৈরী হচ্ছে। সুতরাং ভালো পণ্যের চাহিদা সবসময়ই থাকবে।
এই শপের প্রচারে তাই নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তারা। মেলায়ও অংশ নিচ্ছেন।
আগামীতে আর্টিশিপের ধানমন্ডি কিংবা উত্তরায় আরও দু'টি আউটলেট করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের। তখন সেখানে পূর্ব অর্ডার ছাড়াই ক্রেতারা পণ্য কিনতে পারবেন।
কীভাবে আনা হয় পণ্য
মূলত মধ্য ইউরোপের দেশ জার্মানি থেকেই বেশীরভাগ পণ্য আনা হয়। অর্ডার দেওয়ার পর সে অনুযায়ী জার্মানিতে থাকা কোম্পানির প্রতিনিধি সকল পণ্য ক্রয় করেন। পণ্য ক্রয় করার পর প্রতিষ্ঠানটির বিদেশে থাকা প্রতিনিধি অনলাইনের মাধ্যমে ক্রেতাদের দেখিয়ে পণ্যের কালার ও সাইজ নিশ্চিত করেন। এরপরেই সেসব পণ্য ওঠে কার্গোতে; বাংলাদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমায়।
বাংলাদেশে থাকা কোম্পানির প্রতিনিধি কাস্টমস ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া মেনে সেসব পণ্য বুঝে নেন। নিয়ে আসেন তাদের ঘরে। সেখান থেকে একে একে পৌঁছে যায় ক্রেতাদের দ্বারে দ্বারে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ।
জার্মানি ছাড়াও বর্তমানে এ কোম্পানি আমেরিকা থেকেও পণ্য আমদানি করতে শুরু করেছে। এই ব্যবসাকে আরও অনেকদূরে এগিয়ে নেওয়াই এখন মিলু ও বাঁধনের লক্ষ্য।