বাংলার এক স্টিমার সার্ভিস যেভাবে রেঙ্গুনকে গ্রাম থেকে শহরে পরিণত করে
১৮৫০-এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। লন্ডনের পরে কলকাতাই তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ওই সময় কলকাতায় স্কটদের বড়সড় একটা সম্প্রদায় ছিল। সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের ফলে খুলে যাওয়া অবারিত সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে চাইছিল তারা। এই দলে ছিলেন উইলিয়াম ম্যাকিনন ও রবার্ট ম্যাকেঞ্জি। পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আর্গিল কাউন্টির বাসিন্দা। স্কুলজীবনের এই দুই বন্ধু ১৮৪০-এর দশকে ভারতে চলে আসেন। বঙ্গোপসাগরের বন্দরগুলোতে পণ্য বিকিকিনি করতেন তারা। দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাকিনন, ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং।
১৮৫৩ সালে লোয়ার বার্মাকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে ব্রিটিশরা। দুই বন্ধুর বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়। ওই সময় তারা অনুভব করেন, ভাগ্যদেবী কড়া নাড়ছেন তাদের দরজায়। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে গড়ে তুলতে পারবেন এক বহুজাতিক সাম্রাজ্য, যা বিশ্বজুড়ে মানুষ ও পণ্যের পরিবহনপদ্ধতির খোলনলচেই বদলে দেবে।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার অফিসার হিসেবে কাজ করা ডেভিড জে. মিচেল লিখেছেন, শুধু রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে উপমহাদেশে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। তাই ভারতীয় উপকূল এলাকার সমুদ্রপথের বাণিজ্য নজর কাড়ে ম্যাকিনন, ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোংয়ের।
ইরাবতী বদ্বীপের নিম্নাঞ্চল ও দক্ষিণ বার্মার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার দু-বছরের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা ও রেঙ্গুনের মধ্যে একটি নিয়মিত মেইল স্টিমশিপ চালুর জন্য দরপত্র ডাকে। এ দরপত্র জিতে নেন দুই স্কটিশ বন্ধু। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির পূর্বপুরুষ ক্যালকাটা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তারা।
রেঙ্গুনের সম্প্রসারণ
নতুন মেইল সেবার জন্য একটা ছোট স্টিমারের বহর কেনে ক্যালকাটা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। প্রতি পনেরো দিন অন্তর অন্তর কলকাতা থেকে আকিয়াব, রেঙ্গুন ও মৌলমেইনের উদ্দেশে দুটি জাহাজ ছাড়ত। কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে ডাক, পণ্য ও যাত্রীবাহী প্রথম জাহাজটির নাম কেপ অভ গুড হোপ। ৫০০ টনী জাহাজটি ১৮৫৬ সালে কাজ শুরু করে।
তবে তার এক বছরের মধ্যে, ১৮৫৭ সালে শুরু হয় সিপাহি বিদ্রোহ—অর্থাৎ সূত্রপাত ঘটে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের। তখন জাহাজটিকে কলম্বো থেকে কলকাতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কেপ অভ গুড হোপের সঙ্গে বাল্টিক নামের প্রায় একই আকারের আরেকটি স্টিমার যুক্ত হয় কলকাতা-রেঙ্গুন রুটে চলাচলের জন্য।
মিচেল লিখেছেন, অচিরেই যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাণিজ্য বিকশিত হয়। রেঙ্গুনে আটটি পৃথক মেইল ও যাত্রীবাহী জাহাজ চালু হয়। রোববার বাদে প্রতিদিনই রেঙ্গুনের উদ্দেশে অন্তত একটি জাহাজ ছাড়ত। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতার পরেই দ্বিতীয় স্থান দখল করে রেঙ্গুন।
১৮৫২-৫৩ সালে বার্মাকে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় তখন রেঙ্গুনের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। ১৮৮১ সাল নাগাদ রেঙ্গুনের জনসংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যায়।
স্টিমার সেবার সঙ্গে বার্মায় গিয়েছিল পণ্য ও শ্রমিক। এর সুবাদে বাড়ন্ত গ্রাম থেকে রেঙ্গুন পরিণত হয় শহর ও বাণিজ্যের কেন্দ্রে।
শিক্ষাবিদ উমা শঙ্কর সিং এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, রেঙ্গুনের কেন্দ্রীয় অংশ গড়ে তুলতে সময় লেগেছিল দুই দশক (১৮৫২ থেকে ১৮৭২)। আর শহরের এ অংশ গড়ে তোলার কাজ পুরোটা করেছিল ভারতীয় ঠিকাদারদের নিয়ে যাওয়া ভারতীয় শ্রমিকেরা। লোয়ার বার্মায় বাণিজ্য ও কৃষি বৃদ্ধির সাথে সাথে রেঙ্গুনও দ্রুত সম্প্রসারিত হয়।
১৮৬১ সাল নাগাদ ক্যালকাটা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিকে ম্যাকিননের প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি একীভূত করে নেয়। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে সাহায্যের জন্য কোম্পানিটি ব্রিটিশ শাসকদের সুনজরে ছিল। তাই ভারত থেকে অন্যান্য উপনিবেশে সৈন্য পরিবহনের জন্য নিয়মিত চুক্তি দেওয়া হতো কোম্পানিটিকে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির স্টিমারগুলো প্রায়ই কলকাতা ও রেঙ্গুন থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যেত। ১৮৬০-এর দশকে মাওরি যুদ্ধের জন্য সুদূর নিউজিল্যান্ডেও ব্রিটিশ সৈন্য পরিবহন করে কোম্পানিটি।
১৮৭০-এর দশকে কলকাতা বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাহাজ চলাচল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগর আর এর বাইরেও বেশ কিছু নতুন রুট ছিল। পোর্ট ব্লেয়ার ও কামোর্তা (নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ) হয়ে রেঙ্গুনের উদ্দেশে কলকাতা থেকে সপ্তাহে চারবার জাহাজ ছেড়ে যেত। কলকাতা থেকে রেঙ্গুন হয়ে পেনাং ও সিঙ্গাপুরের মতো মালয় প্রণালির বন্দরগুলোতেও পনেরো দিন অন্তর অন্তর একটি জাহাজ সেবা ছিল।
বার্মায় ভারতীয়দের থিতু হওয়া
কলকাতা থেকে রেঙ্গুন ও লোয়ার বার্মায় নিয়মিত স্টিমশিপ পরিষেবার চালু হওয়ায় ভাগ্যান্বেষণের জন্য বার্মায় পাড়ি জমানো ভারতীয়দের যাত্রা অনেক সহজ হয়ে যায়। বার্মা যেহেতু ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপনে ইচ্ছুক ভারতীয়দের জন্য তেমন কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।
বার্মার অর্থনীতি ক্রমেই বড় হতে থাকে। সেইসঙ্গে আমলাতন্ত্রে বাড়তে থাকে শূন্যপদের সংখ্যা। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি এসব শূন্যস্থান পূরণের জন্য দেশটিতে পাড়ি জমায়।
মাইকেল অ্যাডাসের লেখা দ্য বার্মা ডেল্টা: ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ অন অ্যান এশিয়ান রাইস ফ্রন্টিয়ার, ১৮৫২-১৯৪১ বইয়ের তথ্য অনুসারে, ১৮৮১ সালে বার্মার মোট ভারতীয় জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ ছিল বাঙালি।
উমা শঙ্কর সিং তার ১৯৮০ সালের গবেষণাপত্রে আরও বলেছেন, বার্মায় যাওয়া ৪০ শতাংশ বাঙালি অভিবাসীই ছিল চট্টগ্রামের। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত একটি পাক্ষিক স্টিমার সেবা বার্মার বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্টিমারটি বর্তমান বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ছোট বন্দরে থামত, তারপর কক্সবাজার হয়ে পাড়ি দিত বার্মায়।
ভারতীয় অভিবাসীদের বার্মায় নিয়ে যাওয়া ফেরির চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে মাদ্রাজ ও পূর্ব ভারতের বিশাখাপত্তনমের মতো জায়গা পর্যন্ত জাহাজ সেবা বিস্তৃত করা হয়েছিল। ভারতীয় অভিবাসীদের বার্মায় পরিবহনের জন্য জাহাজ কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি পর্যন্ত দিত ব্রিটিশ শাসকরা। এর ফলে ২০ শতকের মধ্যে রেঙ্গুনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশই হয়ে যায় ভারতীয়রা। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতীয়রা নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলে।
১৮৭০-এর দশক থেকে ভারতীয় মৌসুমি শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যায়। এ চাহিদা মেটাতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি মাদ্রাজ-রেঙ্গুন স্টিমশিপ সেবা চালু করে। মাইকেল অ্যাডাসের তথ্যানুসারে, ১৯ শতকের শেষের দিকে বার্মায় বসবাসরত মোট ভারতীয় অভিবাসীর ৬০ শতাংশের বেশি ছিল মাদ্রাজ থেকে যাওয়া।
একটি যুগের অবসান
বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা কলকাতা-রেঙ্গুন মেইল স্টিমারকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। ওই সময় মহামন্দার কারণে ব্যাপক লোকসানে ছিল বৈশ্বিক শিপিং শিল্প, কিন্তু তার মধ্যেও রেঙ্গুন-কলকাতা লাইনে লাভ করতে থাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। ১৯৩০-এর দশকে শহর দুটির মধ্যে ১০টি সাপ্তাহিক স্টিমার সেবা চালু ছিল। ওই সময়ের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সময় মেনে চলার জন্য এ সেবা বিখ্যাত ছিল। কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে যেতে সময় লাগত দুদিন। রেঙ্গুনে মালামাল ওঠানামা করা হতো আড়াই দিনে। তারপর ফের কলকাতার পথ ধরত জাহাজ।
ব্রিটেন ও বার্মার মধ্যে মেইল পাঠানোর প্রধান উপায় ছিল এ সেবা। বার্মায় পাঠানো মেইল প্রথমে জাহাজে করে বোম্বে পৌঁছত। সেখান থেকে ট্রেনে করে মেইল চলে যেত কলকাতায়। তারপর ডায়মন্ড হারবার থেকে তুলে দেওয়া হতো রেঙ্গুনের ফেরিতে। ১৯৪২ সালে বার্মায় জাপান আক্রমণ করার আগপর্যন্ত এই ব্যবস্থা জারি ছিল। ওই সময় ভারতবর্ষ ও প্রতিবেশীর মধ্যে স্টিমশিপ সেবা স্থগিত করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেরি সেবা ফের চালু করা হয়। ভারত ও বার্মা যথাক্রমে ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এ সেবা ফের চালু করা হয়। ১৯৫০-এর দশক থেকে ব্রিটেন থেকে বার্মায় ডাক পৌঁছানোর জন্য এয়ারমেইলের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর মেইল স্টিমার অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
কলকাতা-রেঙ্গুন ফেরি চলাচল কবে বন্ধ হয়, সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। রেঙ্গুনের (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) ওয়াইএমসিএ-র একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী বলেছেন যে, তিনি ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ফেরিতে করে নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করেছেন। তিনি জানান, ডেকে প্রচুর শ্রমিক-শ্রেণির ভারতীয় অভিবাসী ছিল। এছাড়া ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদেরও দেখেছেন প্রথম শ্রেণিতে।
অশোক কুমার ও মধুবালা অভিনীত ১৯৫৮ সালের হিন্দি সিনেমা 'হাওড়া ব্রিজ'-এ দুই নায়ককে স্টিমশিপে করে রেঙ্গুন থেকে কলকাতায় যাওয়ার দৃশ্য দেখা হয়েছে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অশোক কুমার ডায়মন্ড হারবারে জাহাজ থেকে নামেন। ওই জাহাজে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির প্রতীক দেখা যায়। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, স্টিমশিপ সেবা ১৯৫০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই চালু ছিল।
১৯৬২ সালে বার্মিজ নেতা জেনারেল নে উইন ভারতীয়দের বার্মা থেকে বের করে দেওয়ার পরই সম্ভবত ধীরে ধীরে ফেরি সেবাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬০-এর দশকে প্রায় ৩ লাখ ভারতীয়কে বার্মা থেকে বের করে দেওয়া হয়। কেবল চায়ের দোকানদার, পানের দোকানদার ও নাপিতদের বার্মায় থাকার অনুমতি দেয় বার্মিজ সরকার। সেই ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে ভারত সরকার বিশেষ ফেরি ও বিমানের ব্যবস্থা করেছিল।
২০১৪ সালে শিপিং কর্পোরেশন অভ ইন্ডিয়া চেন্নাই থেকে ইয়াঙ্গুন পর্যন্ত একটি স্বতন্ত্র কার্গো ফেরি সেবা চালু করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারে (বার্মার বর্তমান নাম) যাত্রী ফেরি পরিষেবাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। দুদেশের সরকারই মণিপুর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বাস সেবা চালু করতে আগ্রহী। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলে মান্দালয়-ইম্ফল বাস সেবার চালু করার পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন