বার্মা কীভাবে ব্রিটিশ ভারত থেকে আলাদা হলো
বার্মার ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা মূলত ভারতের বাকি অংশ থেকে প্রদেশটিকে সরিয়ে একটি পৃথক উপনিবেশ হিসাবে পরিচালনা করার পক্ষে ছিল।
১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল, ভারতীয় উপমহাদেশের শহরগুলোকে যেন বিষণ্নতা গ্রাস করেছে। সুদূরপ্রসারী এক আইন কার্যকর করার পরেই ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আন্দোলন করছে। "কংগ্রেস বড় মিছিল আর হরতালের মত কর্মসূচি পালন করছে নতুন এই সংবিধানের বিরুদ্ধে"- সেদিন সংবাদপত্রগুলোতে এইরকম কিছু সংবাদই করা হয়েছিলো। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সমগ্র এশিয়াতে প্রভাব ফেলা এক বড় ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা ভারতীয় নেতাদের দৃষ্টিগোচর হলো না: ভারত থেকে বার্মা প্রদেশ আলাদা হয়ে গিয়েছে।
বার্মা এই সংবাদকে স্বাগত জানিয়েছিল। এপ্রিলের ১ তারিখকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিলো এবং আনন্দের সাথে উদযাপন করা হয়েছিল। কিন্তু বার্মা তখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনেই ছিল।
ব্রিটিশ রাজা সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঘোষণা দিয়েছিলেন, "আজ থেকে বার্মা ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে বার্মা ব্রিটিশ রাজবংশের সার্বভৌমত্বের অধীনে ছিল এবং তখন থেকেই বার্মা বৈষয়িক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে গেছে।" তাঁর ভাষ্যমতে দেশটি ভারত থেকে স্বাধীন হয়েই আরো উন্নতি করতে পারবে।
৫ যুগ ভারতের অংশ হিসেবে থাকার পর বার্মাকে আলাদা করে ফেলা হয়। ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত জর্জ অরওয়েল সেখানে 'ইন্ডিয়ান ইমপেরিয়াল পুলিশের' অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন এবং তাঁর প্রথম উপন্যাস "বার্মিজ ডেইজ"-এর পটভূমি এখানেই ছিল। শ্রমিকরা অবাধে পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারত থেকে অল্প জনবসতিপূর্ণ দেশটিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এর ফলে বার্মিজ ভারতীয়রা প্রশাসন ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য মামলা
১৯২০এর দশক থেকেই বার্মায় সামাজিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। জাতিগত বার্মিজসহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল কারণ ভারতীয় এবং চাইনিজ অভিবাসীরা তাদের থেকেও আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে ছিল। তাদের সেগুন কাঠের শিল্প থেকে যে অর্থ আয় করা হত সেগুলো চলে যেত ইউরোপীয়দের কাছে।
বার্মাকে আলাদা করে ফেলার বিষয়টি প্রথম ১৯১৮ সালে বিবেচনা করা হয়েছিল যখন এডউইন মন্টাগু এবং লর্ড চেমসফোর্ড ভারতে ধীরে ধীরে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান চালু করার জন্য সংবিধানের সংস্কারের আলাপ তুলেছিলেন। কিন্তু তখন সামরিক কারণে বার্মা ভারতের সাথে থাকলেই সুবিধা হয় এই মর্মে আলোচনা বেশিদূর যায়নি।
ভারত থেকে বার্মাকে আলাদা করার দাবি জোরালো হয় ১৯২০-এর দশকের শুরু থেকেই। বার্মিজ বিধায়ক মং পো বাই ১৯২২ সালে অনুরোধ করেছিলেন একটি কমিটি গঠন করার জন্য, যারা বার্মার "ভারতীয় সাম্রাজ্য" থেকে আলাদা হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে। তাঁর এই আবেদন বার্মা আইন পরিষদের স্পিকার খারিজ করে দেন যার ভাষ্যমতে, দাবি জানানোর সময় তখনো হয়নি এবং এই দাবি তখনই উত্থাপিত হতে পারে যখন বার্মায় একটি সঠিক সংবিধান প্রবর্তিত হবে।
তারপরও ১৯২৪ সালে রাজ্যটির আইন পরিষদে ভারত থেকে আলাদা হওয়ার ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা পাশ করা হয়। প্রস্তাবনাটিতে ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষমূলক কিছু না লিখে বলা হয়: "এটি একটি প্রস্তাবনা যা জাতীয়তাবাদী দল সতর্কতার সাথে প্রণয়ন করেছে কারণ দলের সদস্য এবং বার্মিজদের মধ্যেও এই প্রশ্নটি কখন এবং কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই একমত যে একদিন বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করতেই হবে। এমন নয় যে ভারতীয়দের প্রতি আমাদের কোনো খারাপ অনুভূতি আছে বা আমরা ভারতীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞ নই। আমরা অতীতে ভারতের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পেয়েছি। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখেছি যে বিষয়গুলি এমন দাঁড়িয়েছে যে বার্মার পক্ষে চিরকালের জন্য ভারতের সাথে থাকা যুক্তিযুক্ত নয়। এমন কিছু লোক আছে যারা বিচ্ছিন্নতা প্রশ্নে এতটাই দৃঢ় সংকল্প যে তারা অবিলম্বে ভারত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায়। এবং বার্মিজদের মধ্যে এমন ভাগও আছে যারা মনে করেন আলাদা হওয়ার আলাপ ধীরে সুস্থে করা উচিত যতক্ষণ না আমাদের কাছে সংস্কারের ভালো পন্থা আছে।"
১৯২৮ সালে ভারতীয় আইন প্রণয়ন কমিশন (যা সাইমন কমিশন নামে পরিচিত ছিল) বার্মা সফরে গেলে বিচ্ছেদের ধারণা আরো জোরালো হতে থাকে। ব্রিটিশ পার্লামান্টের এই সাত সদস্যের কমিটির মধ্যে অন্যতম ছিলেন ক্লিমেন্ট এটলি। তাঁর হাতে বার্মার সরকার গোপনে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করে যেখানে ব্রিটিশ ভারত থেকে প্রদেশের বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি মামলা করে হয়েছিল।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, "বার্মিজরা ভারতীয়দের থেকে জাতিগত ও ভাষার দিক থেকে আলাদা যেমনটা তারা আলাদা ব্রিটিশদের থেকে।" বার্মার সংকটগুলো আসলে ভারতের সংকট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।
আলাদা জাতি
বিচ্ছেদের জন্য মামলা করার সময় স্মারকলিপিতে কিছু দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হয়: "ঐতিহাসিকভাবে (১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যখন আনাওরাতা প্যাগান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন) ১৯ শতকের আগ পর্যন্ত ভারত ও বার্মার মধ্যে খুব কম বা কোন মিল ছিল না এবং বার্মার লোকেরা ভারতীয়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা একটি ভিন্ন জাতি থেকে এসেছে এবং তাদের একটি ভিন্ন ইতিহাস, একটি ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ভাষা, একটি ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা, ভিন্ন আচারব্যবহার, ভিন্ন রীতিনীতি এবং জীবনের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।"
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, "বার্মিজদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছিল। তাদের সাধারণ অনুভূতি এমন ছিল যে, এর দূরবর্তী অবস্থানের জন্য এবং এর ভিন্ন এবং তুলনামূলকভাবে ছোট জনসংখ্যার কারণে প্রদেশটির বিশেষ পরিস্থিতি এবং চাহিদার প্রতি যথেষ্ট বিবেচনা করা হয়নি।"
বার্মার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল যে, ভারতে গণতান্ত্রিক সংস্কার চালু হওয়ার সাথে সাথে বার্মার জনগণের অনুভূতিকেও সম্মান করা দরকার। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, "কোন সচেতন বার্মিজ এই সত্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে না যে বার্মার জনসংখ্যা (১৩ মিলিয়ন) ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যার (২৪৭ মিলিয়ন) একটি ভগ্নাংশ মাত্র। এবং এখানে অবশ্যই বার্মা বিভিন্ন রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হয় কারণ অপেক্ষাকৃত এই ছোট দেশটি যার নিজস্ব ঐতিহ্য ও নিজস্ব সামাজিক ব্যবস্থা আছে, সেটি অনেক বড় এবং অধিক জনবহুল এমন একটি দেশের সাথে যুক্ত করা হয়েছে যার সাথে এর কোনো জাতিগত বা সামাজিক বা ধর্মীয় সম্পর্ক নেই। এবং দুটি দেশ পরস্পরের সাথে ৭০০ মাইল সমুদ্র দ্বারা এবং পাহাড় ও জঙ্গলের বিস্তৃত অংশ দ্বারা বিচ্ছিন্ন কিন্তু শুধু রাস্তা এবং রেলপথ দ্বারা দুটি দেশ সংযুক্ত। দেখে মনে হবে যে এই ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান কেবল অর্থনৈতিক বা জাতীয় প্রয়োজনীয়তা দ্বারাই ন্যায়সংগত হতে পারে।"
যে কর্মকর্তারা স্মারকলিপি লিখেছিলেন তাদের কাছে জাতি হিসেবে বার্মা প্রদেশে ভারতের চেয়ে বৈশিষ্ট্য বেশি ছিল। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, "এর জনসংখ্যা ১৩ মিলিয়নের কিছু বেশী কিন্তু এটি একটি সমজাতীয় জনসংখ্যার দেশ। বার্মিজরা (বার্মিজ, ক্যারেন, শান এবং তালাইং) দেশটির মোট জনসংখ্যার ৯১ শতাংশ।"
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে অল্প সময়ের জন্য বার্মার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ এটি ভারতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই সময় বার্মা শ্রম এবং কয়লার মত পণ্যগুলির জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিল যেখানে। অন্যদিকে ভারত চাল, ধান, পেট্রোল এবং সেগুন কাঠের জন্য বার্মার উপর নির্ভরশীল ছিল।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, "এটি বোঝা যায় দুটি দেশের মধ্যে কোন বিবাদ থাকতে পারে না। এবং এটি সবচেয়ে বেশি কাম্য যে যদি বিচ্ছেদ ঘটে তবে তা পরস্পরের সম্মতি এবং পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে হওয়া উচিত। এবং এর পিছনে কোনও ধরনের বিরক্তি বা তিক্ততা থাকা উচিত নয়।"
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
সাইমন কমিশনের কাছে যেই যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়েছিলো তাঁর উপর ভিত্তি করে লন্ডনের কর্তৃপক্ষ বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রথমে তারা এই ব্যাপারে বার্মা থেকে ভোট নিতে চেয়েছিল এবং ফোটের ফলাফল তাদের বিস্মিত করেছিল।
১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিলে দ্য গার্ডিয়ানের করা একটি রিপোর্টে ভোটের ব্যাপারে ভালো তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, "নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বার্মিজ সরকারকে হতাশ করে বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতাকারী দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তাদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তাদের বিচ্ছিনতার বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে না পারা। তারা হয়ত ফেডারেশনের অংশীদারিত্বের প্রকৃতিকে ভুল বুঝে থাকতে পারে যা বিচ্ছিন্নতার একমাত্র বিকল্প হতে পারে অথবা এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গিও হতে পারে। যাই হোক না কেন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বার্মিজরা তাদের নিজেদের ভালো বুঝতে পারছে না এবং তারা বার্মাকে আলাদা করার পাশাপাশি বিস্তৃত সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।"
বার্মায় বসবাসরত ভারতীয়দের উপর তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্নতার কোনো প্রভাব পড়েনি। রেঙ্গুনের মতো শহরে বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায় ১৯৪১-৪২ সালে জাপানি আক্রমণের আগ পর্যন্ত বিকাশ লাভ করতে থাকে। ১৯৪২ সালে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল নে উইন তাদের জোরপূর্বক দেশটি থেকে বিতাড়িত করেন।