অক্সিজেন সংকট: ভারতের মতো পরিস্থিতি হলে আমরা কতটা প্রস্তুত
সোমবার (২৬ এপ্রিল) ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড চারটি সরকারি হাসপাতালের একটিতেও আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। এখনো জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, আইসিইউ নেই; সংকট রয়েছে জনবলের। এর মধ্যে যদি প্রতিবেশী দেশ ভারতের ডাবল/ত্রিপল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশ করে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এখনকার প্রস্তুতি দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে কিন্তু এর বেশি সংক্রমণ হলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে। তাই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকানো ও প্রতিরোধের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ভারতের করোনাভাইরাসের ডাবল-ট্রিপল মিউটেন্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে তা ধরে নিয়ে এখনই জোর প্রস্তুতি নেয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ ইতিমধ্যে ভারতীয় ধরনের ফলে নেপালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নেপালে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, হিমালয়ের দেশের কয়েক হাজার মানুষ ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়া মিউট্যান্ট স্ট্রেইনের মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়েছে।
গত রবিবার নেপালে নতুন সংক্রমণ হয়েছে ৩,০৩২ জনের দেহে, যা এ বছরে দেশটিতে সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "করোনা মোকাবেলায় ৭৯টা হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২৯টিতে স্থাপন করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণে যে রোগী বেড়েছে তা সামলাতেই আমরা গত কয়েকদিন হিমশিম খাচ্ছিলাম। এর মধ্যে ভারতের ভ্যারিয়েন্ট আসলে তো পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে"।
এদিকে ভ্যাকসিন সংকটের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে টিকাদান কার্যক্রমেও। এরইমধ্যে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। মজুত না থাকায় প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেয়া ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কমেছে করোনা টেস্টের সংখ্যাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমো (কোভিড-১৯ মডেলিং) কনসোর্টিয়াম দলের সদস্য অধ্যাপক শফিউন শিমুল বলেন, "বর্ডার বন্ধ থাকলেও পণ্য পরিবহনের জন্য যারা দেশে আসছে তাদের মাধ্যমেও নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেশে আসতে পারে। তাই জিনোম সিকুয়েন্সিং করে নিশ্চিত হতে হবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে এসেছে কিনা"।
শফিউন শিমুল বলেন, "ভারতের অক্সিজেন সংকট আমরা দেখছি। তাই আমাদের এখনই ভারতের বাইরে চীন বা অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে অক্সিজেন আমদানি করতে হবে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতেও অক্সিজেনের মজুত বাড়াতে হবে, যাতে ঢাকার ওপর চাপ না বাড়ে। একেবারে খারাপ সময়ের কথা ভেবে প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে"।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কোভিড রোগীদের জন্য ঢাকা শহরে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৩০টি হাসপাতালের ৫৫৭০ টি সাধারণ বেডের মধ্যে খালি আছে ২৭৭৩টি। এছাড়া ৭৫৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি আছে ২৪৮টি। সারাদেশে ১০৬৯ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি আছে মাত্র ৩৮৪টি। হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড বাড়ানো হলেও আইসিইউ চালানোর মত দক্ষ জনবলের অভাবে সেবা দিতে পারছে না।
সারাদেশে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২০,৯৩৭টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ১,৫৬৩টি ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে ১,৩৪৩টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, "ভারতের ভ্যারিয়েন্ট যাতে দেশে না আসে তাই আমরা কোয়ারেন্টিনের ওপর জোর দিচ্ছি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকল ভাঙতে হবে। সংক্রমণ মোকাবিলায় আমরা প্রতিদিনই কিছু না কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে তা না হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে"।
ভারতের অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধে নতুন শঙ্কা
দেশের চিকিৎসা খাতে অক্সিজেনের চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। করোনাকালীন আক্রান্তদের জীবন বাঁচাতে সম্প্রতি এ অক্সিজেনের চাহিদা আরও বাড়ে। কিন্তু ভারতেও অক্সিজেন সংকট দেখা দেওয়ায় কোন ঘোষণা ছাড়াই তারা অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীসহ স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরবরাহকৃত অক্সিজেনের অধিকাংশই আসে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান থেকে। এর পাশাপাশি স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড, ইসলাম অক্সিজেন, পিউর অক্সিজেন এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানও স্বাস্থ্যসেবা খাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।
লিন্ডের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৯০ টন অক্সিজেন। তারা এই গ্যাস চিকিৎসা এবং শিল্প উভয় খাতের জন্যই উৎপাদন করে। স্পেকট্রার দৈনিক ক্ষমতা ২৫ টন এবং ইসলাম অক্সিজেনের ৪০ টন।
অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে তারা প্রত্যেকে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করে। তবে ভারত ২২ শে এপ্রিল থেকে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, লিন্ডে বাংলাদেশ, স্পেকট্রা, পিউর অক্সিজেন, ইসলাম অক্সিজেন সহ পাঁচ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে তরল অক্সিজেন আমদানি করে। ২১ শে এপ্রিলের আগের সপ্তাহে, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে ৪৯৮ টনেরও বেশি তরল অক্সিজেন দেশে আসে।
লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, "বর্তমানে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত অক্সিজেনের তুলনায় মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের প্রাধান্য বেশি। ভারতের চলমান অক্সিজেন সংকটের কারণে আমরা অক্সিজেন আমদানি করতে না পারলে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত অক্সিজেনের সংকট সৃষ্টি হবে।"
সাইকা মাজেদ বলেন, "গত দুই মাসে বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত অক্সিজেনের চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা পুরোদমে উৎপাদন বজায় রেখেছি। আমাদের দুটি প্ল্যান্টে দৈনিক ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদিত হচ্ছে।"
"আমরা শীঘ্রই গুরুতর সংকটের মুখে পড়ব না। তবে, আমরা চাহিদাসম্পন্ন এই সরবরাহ চেইন বজায় রাখতে এখন থেকেই সাবধানে পা ফেলছি," বলেন তিনি।
এছাড়া চট্টগ্রাম ভিত্তিক অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেডের উপদেষ্টা সোহরাব হোসেন বলেন, "আমরা মূলত শিল্পখাতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকি। আমাদের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা নয় হাজার ৬০০ টন। তবে, কয়েকবার আমরা স্থানীয় হাসপাতালগুলোর অক্সিজেন সিলিন্ডার ভরে দিয়েছি।"
"কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা এখন হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি। সেজন্য, কারখানার সরঞ্জামাদি উন্নত করার পাশাপাশি আমরা পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েও কাজ করছি," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, "প্রস্তুতি হিসেবে অক্সিজেন সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। এ ছাড়া অক্সিজেন সংকট দেখা দিলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বন্ধ রেখে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করা হবে"।