অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্ধকার দিক
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে স্ববিরোধী বা প্যারাডক্স বলা যেতে পারে। দিনের অধিকাংশ সময়জুড়ে চলা লোডশেডিংয়ের অন্ধকার দিনগুলো থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে, উৎপাদিত হচ্ছে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল এখনও ঘন্টার পর ঘন্টা অন্ধকারে ডুবে থাকে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ২১ জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ এবং মফস্বল শহর অঞ্চল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখতে পায় যে, গড়ে বেশ কিছু জায়গায় ছয় ঘন্টার বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকে না। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ না থাকার সবথেকে দীর্ঘতম সময় ১২ ঘন্টা পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
বেশ কয়েকটি জায়গায় দিনে পাঁচ থেকে সাতবার বিদ্যুৎ চলে যায়। অথচ, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকায় জরিমানা স্বরূপ সরকার বছরে নয় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করছে।
কিন্তু, বাংলাদেশ চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সত্ত্বেও কেন এমন ঘটছে?
দীর্ঘকালীন বিদ্যুৎ ঘাটতি থেকে প্রায় এক দশকের মাথায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য একটি সফলতার গল্প। তবে, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) অধীনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় থাকা গ্রাম এবং মফস্বলের মানুষ দুর্বল সঞ্চালন সংযোগের কারণে পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন না।
এধরনের বহু অঞ্চলেই লোডশেডিং দৈনন্দিন জীবনের অংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় উৎপাদনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একইসঙ্গে, উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পায়।
লোডশেডিংয়ের কোনো দাপ্তরিক তথ্য না থাকায়; বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে যুক্তিসংগত কোনো ব্যাখ্যাও নেই।
দেশের ৮৪ হাজার ৮০০ গ্রামে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে আছে বিআরইবি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের অধীনে থাকা অঞ্চলে কোনো লোডশেডিং নেই।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, "বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়ে থাকি। আর তাই, আমাদের বিতরণকৃত অঞ্চলে কোনো লোডশেডিং নেই।"
তবে, দিনের বেলায় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে বিভিন্ন সময় তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"১৯৮০ সাল থেকে চলতে থাকা আমাদের এই সংযোগ ব্যবস্থা পুরনো হয়ে পড়েছে। আর তাই, ঝড়-বৃষ্টির সময় সঞ্চালন লাইনগুলো প্রায়ই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মেরামত কাজ পরিচালনা করতে বাধ্য হয়ে দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থগিত রাখতে হয়," বলেন তিনি।
সিস্টেম আপগ্রেড বা ব্যবস্থাপনা উন্নীত করা হলে সমস্যাগুলো আর থাকবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, বাস্তবতা ভিন্ন।
জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় কুমিল্লার প্রায় সকল উপজেলার গ্রাহকরা নিয়মিত বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ভুক্তভোগী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুসারে, দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা ৫৩২ মেগাওয়াট হলেও, পুরো জেলায় মাত্র ৪৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহিত হয়।
রংপুরের বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরাও দিনে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হন।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ জানান, সমিতি দৈনিক ৯০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৬২-৬৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়ে থাকে।
১২ জুন অনুষ্ঠিত এক আয়োজনে লোডশেডিং নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে তার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, যেখানে দিনের প্রায় ১২ ঘন্টাই বিদ্যুৎ থাকে না।
"প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য আমরা ১২.৫ টাকা করে পরিশোধ করলেও, সেই তুলনায় আমরা কোনো উপকার পাচ্ছি না। আমাদের সবসময় জেনারেটর চালাতে হয়," বলেন তিনি।
ভোল্টেজের ওঠানামা ও অস্থিতিশীলতার কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
"মানুষ যেন গ্রিড ব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারে সেজন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।অন্যথায়, বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অব্যাহত থাকবে," বলেন তিনি।
গত এক দশকে, দেশে নতুন করে ২০ হাজার ২৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশ ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সক্ষমতা অব্যবহৃত রেখে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চার কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এছাড়া, এক দশক আগে বিদ্যুৎ সরবরাহের সময়সীমা যা ছিল তার থেকে বর্তমানে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
আকাশে মেঘ জমলেই বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ:
বর্ষাকালে দেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই দীর্ঘসময় ধরে লোডশেডিং চলে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলেই বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
নড়াইল, খুলনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকরা চলতি বর্ষার মৌসুমে সবথেকে বেশি সমস্যায় ভুগছেন। অনেকেই দিনে কয়েক ঘন্টা বিদ্যুতের দেখা পান না।
নড়াইলের আউরিয়ার ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম প্রিন্স জানান, "লোডশেডিংয়ের কারণে বাচ্চারা ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারে না।" সম্প্রতি তিনি বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন।
তবে, দুই বছর ধরে নড়াইলে কোনো বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন নড়াইল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ-মহাব্যবস্থাপক আবু আনাস মোহাম্মদ নাসের।
কিন্তু, বিভিন্ন স্থানে মেরামতের কাজ করতে প্রায় প্রতিদিনই কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করতে হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গ্রামীণ অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের আরেকটি প্রধান কারণ হলো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ।
প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই লোডশেডিংয়ের শিকার হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে একটি হলো মানিকগঞ্জ। বছরব্যাপী সড়ক মেরামতের জন্য সঞ্চালন লাইন স্থানান্তরের কাজ করার প্রয়োজন পড়ে। আর তাই, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রাখতে হয়।
মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ দপ্তরের মহাব্যবস্থাপক আবদুর রশিদ মৃধা বলেন, "বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায়ই বিচ্ছিন্ন করার কারণ বিদ্যুৎ ঘাটতি নয়। পুরো ব্যবস্থার মেরামত এবং উন্নয়নমূলক কাজের কারণে সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।"
প্রতিবেদন তৈরিতে আমাদের পাবনা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালি, কুমিল্লা, রংপুর, যশোর, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, শরীয়তপুর, গাজীপুর, নড়াইল, কক্সবাজার, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা এবং নেত্রকোণা প্রতিনিধি সহায়তা করেছেন।