আইসিটি খাতে রপ্তানি বাড়াতে সরকারের নতুন উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ, তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এদের মাধ্যমে আইসিটি খাতে রপ্তানি বৃদ্ধি ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হবে।
এছাড়াও বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে আইসিটি ডেস্ক স্থাপন করে সেখানে প্রবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। তারা ওইসব দেশের আইসিটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্র স্থাপন করবে। এর মাধ্যমে এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
গত ২৮ ডিসেম্বর বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় আইসিটি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগমের যৌথ সভাপতিত্বে সভায় বিভিন্ন দেশে আইসিটি পণ্য ও সেবা রপ্তানিতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূতরা।
এজন্য প্রবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের কাজে লাগানো, দূতাবাসগুলোতে তাদের মাধ্যমে আইসিটি ডেস্ক স্থাপন, বিভিন্ন দেশের আইসিটি হাবগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক আলাদা আলাদা স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের ওপর জোর দেন তারা।
২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে রপ্তানির পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ ও বাজারের অভাবে তা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। গত অর্থবছরে আইসিটি খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের আইসিটি পণ্য ও সেবার প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর।
সরকার এখন ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি খাতের রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলার করতে চায়।
পররাষ্ট্র সচিব আইটি এবং আইটি-সমর্থিত সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা ফিনটেক, বিটকয়েন, গেমিং, এআই, রোবোটিক্স প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্যাদি ভাগাভাগি করেন; অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনার সময় এসব খাতের বিশেষজ্ঞ এবং প্রভাবশালীদের বুঝতে এসব তথ্য সহায়ক হয়ে উঠবে। বিদেশে অবস্থিত সব বাংলাদেশ মিশনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রযুক্তি বা বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রস্তাব বিনিময় করার অনুরোধও করেন তিনি।
ওয়াশিংটন ডিসিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, আইসিটি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি খাত। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী এনআরবি'দের জন্য একটি নেটওয়ার্ক বা প্ল্যাটফর্ম তৈরির গুরুত্ব প্রকাশ করেন।
লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী বলেন, বাংলাদেশে আইসিটি খাত সম্প্রসারণের জন্য বিশাল সুযোগ রয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গৃহযুদ্ধের আগে চীন ও ভারত মূলত লিবিয়ার আইসিটি সেক্টরে কাজ করেছিল, তবে যুদ্ধের ফলে তারা চলে যায়। এই শূন্যস্থান পূরণের সমূহ সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।
অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির বিভিন্ন দেশের শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষতা রয়েছে, তবে যোগাযোগ দক্ষতার অভাবে তারা ভালো করতে পারছেন না বলে রাষ্ট্রদূতরা উল্লেখ করেন।
এই মর্মে, পররাষ্ট্র সচিব যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে দক্ষ ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীদের প্রেরণের বিভিন্ন সম্ভাবনার অনুসন্ধানের অনুরোধ করেন।
নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, পাশ্চাত্য বিশ্ব এখন ডেটা মাইনিং, বিগ ডেটা ম্যানিপুলেশন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে ঝুঁকছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য সময় এসেছে এসব অগ্রগতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থী ও জনবলকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করে তোলা।
'আইনি সমস্যা, অর্থনৈতিক প্রকৃতি এবং অন্যান্য আইসিটিভিত্তিক সংবেদনশীল সমস্যাগুলো বাংলাদেশের স্পষ্ট করা উচিত। তথ্যপ্রযুক্তি অত্যন্ত পরিশীলিত জ্ঞানের বিষয় এবং এজন্য বাংলাদেশের উৎপাদন খাতের প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে,' তিনি আরও যোগ করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এই রাষ্ট্রদূতেরা আরও উল্লেখ করেন, ওই অঞ্চলে বাংলাদেশ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে- এমন প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে।
কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোঃ আশিকুজ্জামান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও এখানে ওষুধ, কৃষি, তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য খাতে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি দূতাবাসে আইটি ভিত্তিক পোস্ট নিয়োগ বা তৈরির গুরুত্বের ওপর জোর দেন তিনি।
বেইজিং মিশনের উপ-প্রধান মাসুদুর রহমান জানান, একটি চীনা সংস্থা ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে জাতীয় তথ্য কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ করেছে; এটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। সুতরাং, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশন, ডিজিটাল সরকার এবং অন্যান্য ডিজিটাল উদ্ভাবনের প্রচার করতে পারে।
'চীন এখন বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থান দখল করে নিচ্ছে: এআই, রোবোটিকস, সফটওয়্যার নির্মাণ ইত্যাদির পাশাপাশি চীন এখন ডেটা সুরক্ষা এবং নিরাপত্তায় কাজ করছে, যা বাংলাদেশের পক্ষেও উপকৃত হবার মতো একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। তাছাড়া, অনেকেই এখন তাদের শিল্পবাণিজ্য চীন থেকে অন্য দেশগুলোতে স্থানান্তর করছে, যা থেকে বাংলাদেশ সুযোগ নিতে পারে।'