আগামী ৫০ বছরের মধ্যে, কালুরঘাটের অধিকাংশ কারখানা জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ১৩৪টি শিল্প কারখানায় ঝুঁকি বাড়ছে। আগামী ২৫ এবং ৫০ বছরের মধ্যে কারখানাগুলোতে ঝুঁকির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
ভৌগলিক অবস্থান, নদীতে পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, উপকূলীয় প্রকৃতি, ঋতুগত প্রাকৃতিক পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প সহ বিভিন্ন কারণে শিল্পকারখানাগুলোতে ক্রমাগত ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
তবে ইপিজেডের কারখানাগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা এবং নির্মাণ হওয়ায় নন-ইপিজেড এরিয়ার কারখানাতে ঝুঁকির হার বেশি।
সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রাম বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়।
বৃহষ্পতিবার (৭ অক্টোবর) চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত ওই কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রাম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আহসান হোসাইন।
এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে গবেষক দল চট্টগ্রামের দুটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে কাজ করে। এর মধ্যে একটি কর্ণফুলী ইপিজেড (কেইপিজেড) এবং অন্যটি কালুরঘাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া।
গবেষণা প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, সাইক্লোন, বন্যা, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড এবং কোভিড-১৯ এর ক্ষতিজনিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই রিস্ক প্রোফাইলের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা এসব এলাকায় বিনিয়োগ করার আগে এখন কি ধরনের ঝুঁকি আছে তা জানতে পারবে। দুর্যোগ মাথায় রেখে যে কোন শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নির্ণয় করতে শিল্পোদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করবে এই প্রতিবেদন।
প্রকল্প প্রতিবেদনের মাধ্যমে দুটি শিল্প এলাকায় ২৫ বছর এবং ৫০ বছর পর কি কি ধরনের ঝুঁকি তৈরী হবে তা তুলে ধরা হয়েছে। ঝুঁকিগুলোকে খুব সামান্য থেকে খুব বেশি এমন ৫টি স্কেলে ভাগ করা হয়েছে।
স্টাডিতে নন-ইপিজেড এরিয়ার মধ্যে কালুরঘাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া এবং ইপিজেড এরিয়ার মধ্যে কর্ণফুলী ইপিজেডকে নির্ধারণ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কেইপিজেডের কারখানাগুলোর তুলনায় কালুরঘাট শিল্প এলাকার কারখানাগুলো উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কালুরঘাট এরিয়ায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ১৩৪টি ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি ইন্ডাস্ট্রি সার্ভে করা হয়েছে। এছাড়া কেইপিজেডে ৮৩ হেক্টর জমিতে ৫৭টি ইন্ডাস্ট্রি থেকে ৩৭টি ইন্ডাস্ট্রিতে সার্ভে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৫ বছরের মধ্যে বন্যায় কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ৫৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ মধ্যম ঝুঁকিতে (মিডিয়াম রিস্ক) এবং শূণ্য দশমিক ৭৫ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি উচ্চ ঝুঁকিতে (হাই রিস্ক) রয়েছে।
বন্যায় আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৩১ শতাংশ কম ঝুঁকিতে, ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি মাঝারি ঝুঁকিতে, ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি উচ্চ ঝুঁকিতে এবং শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলাবদ্ধতায় বছর হিসেবে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ১০০ ভাগ ইন্ডাস্ট্রি খুবই কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৫ বছর পরে ২ দশমিক ২৪ শতাশ খুবই কম ঝুঁকিতে, ৭২ দশমিক ৮৪ ভাগ ইন্ডাস্ট্রি কম ঝুঁকিতে, ১৪ দশমিক ১৮ ভাগ ইন্ডাস্ট্রি মাঝারি ঝুঁকিতে এবং শূণ্য দশমিক ৭৫ ভাগ ইন্ডাস্ট্রি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
এছাড়া জলাবদ্ধতায় আগামী ৫০ বছরে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ কম ঝুঁকিতে, ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশ মধ্যম ঝুঁকিতে, ২৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ উচ্চ ঝুঁকিতে এবং ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাইক্লোনে কালুরঘাট শিল্প এলাকার কারখানাগুলোর মধ্যে প্রতিবছরে ১০০ ভাগ কারখানা খুবই কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৫ বছর পরে ৯৮ দশমিক ২৮ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ৫০ বছর পরে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ উচ্চ ঝুঁকিতে এবং ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কর্ণফুলী ইপিজেডে বন্যায় প্রতিবছর এবং ২৫ বছর পর হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিগুলো খুবই কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ৫০ বছর পর ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি খুবই কম ঝুঁকিতে, ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম ঝুঁকিতে এবং ২ দশমিক ৭০ শতাংশ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে।
বন্যায় কর্ণফুলী ইপিজেড প্রতিবছর হিসেবে শতভাগ ইন্ডাস্ট্রি খুবই কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৫ বছর পরে ৯৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ খুবই কম ঝুঁকিতে, ৫ দশমিক ৪ শতাংশ কম ঝুঁকিতে থাকবে। এছাড়া ৫০ বছর পরে ৬৫ দশমিক ৬ ভাগ খুবই কম ঝুঁকিতে, ১৬ দশমিক ৯২ ভাগ কম ঝুঁকিতে এবং ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাইক্লোনে কর্ণফুলী ইপিজেডের শতভাগ ইন্ডাস্ট্রি খুবই কম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৫ বছর পরে ৫ দশমিক ৪১ ভাগ ইন্ডাস্ট্রি খুবই কম ঝুঁকিতে, ৯১ দশমিক ৬৯ ভাগ কম ঝুঁকিতে এবং ২ দশমিক ৭০ ভাগ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে।
এছাড়া ৫০ বছর পরে ২ দশমিক ৭০ ভাগ মধ্যম ঝুঁকি, ৫৪ দশমিক ৫ শতাশ উচ্চ ঝুঁকিতে এবং ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রি অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কালুরঘাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার ১৩৪টি ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে ৯টি খুবই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে রয়েছে। ১০১টি উচ্চ ঝুঁকিতে, ১৭টি মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে। কেইপিজেডের তুলনায় কালুরঘাট শিল্প এলাকার ভবনগুলো বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই স্টাডিটি শুরু হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে, শেষ হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে। ৯ মাসের মধ্যে স্টাডি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে ৩ মাস পিছিয়ে যায়। স্টাডিতে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
ওয়াকর্শপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম। গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রাম ডিভিশনের এনআরপি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. নুরুন নাহার, ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (আইডব্লিওএম) আবু সালেহ খান, ইউএনডিপির ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্টের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট আরিফ আবদুল্লাহ খান।
এতে কেইপিজেড এবং কালু্ঘারট শিল্প এলাকার শিল্পমালিক, বেপজা সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন।
স্টাডি রিপোর্ট উপস্থাপন করেন আইডব্লিওএমের আইসিটি- জিআইএস ডিভিশনের পরিচালক মোল্লা মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. রাকিব আহসান।
পরিকল্পনা কমিশনের এনআরপি প্রজেক্ট দাতা সংস্থা ইউকেএইড, সুইডেন সেভারিং, ইউএন ওমেন ইউএনওপিএস এবং ইউএনডিপির অর্থায়নে বংলাদেশ ওয়াটার মডিউলিং কে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে।