আম্পান বিধ্বস্ত উপকূলে আট মাসেও ঘরে ফেরা হয়নি
সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদে সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতের আট মাস পার হয়ে গেছে। আম্পান দুর্গত জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখনো নদীর জোয়ার ভাটার সাথে বসবাস করছে। আট মাস অতিবাহিত হলেও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা এখনো নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের উপর টং ঘর বেঁধে শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। দুর্গত মানুষেরা বসতভিটায় কবে ফিরতে পারবে সেটিও জানেন না তারা। অনেকের বসতভিটা ভেসে গেছে স্রোতে।
২০২০ সালের ২০ মে সাতক্ষীরায় শক্তিশালী রূপ নিয়ে আঘাত হানে আম্পান। বিলীন হয়ে যায় নদীর বেড়িবাঁধ। অনেকেই হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন, কর্মহীন।ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকেই চলে গেছেন অন্যত্র। আবার কাজের সন্ধানে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে।
২০১০ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সাতক্ষীরা জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫৯ জন। যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ লাখে। পরিবারের সংখ্যা ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯০টি। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলার ৪৬.৩০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। আর ২৯.০৭ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র। দেশের সকল জেলার মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।
প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার ২২ লাখ মানুষকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। সাতক্ষীরা জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও সব চেয়ে বেশি। অথচ সিডর-আইলা-বুলবুল-আম্পানের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এ জেলার জন্য সরকারের অতিরিক্ত কোন বরাদ্দ নেই। সরকার মঙ্গাদুর্গত এলাকার মানুষকে বাঁচাতে সেখানে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারের নেই কোন বিশেষ বরাদ্দ। ফলে সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নাকাল।
সাতক্ষীরা উপকূলবর্তী জেলা হওয়ায় প্রতিবছর এখানকার মানুষকে কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। দুর্যোগপ্রবন জেলা হিসেবে চিহ্নিত সাতক্ষীরা। সরকারের অতিরিক্ত বরাদ্দ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দিন দিন দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষরা এখনো দাঁড়াতে পারেনি মেরুদণ্ড সোজা করে। সম্প্রতি আশাশুনির দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকা এখনো বিধ্বস্ত। কৃষিজমি, মৎস্য ঘের নদীর পানির সাথে মিশে একাকার।
আশাশুনির শ্রিপুর গ্রামের গফফার গাজীর স্ত্রী শাহিনা খাতুন জানান, 'আম্পানের পর ধ্বসেপড়া বেঁড়িবাঁধ মেরামতের জন্য প্রায় এক সপ্তাহ কাজ করেছে তার স্বামী। কাজের বিনিময়ে সেসময় পৃথক দুটি স্লিপের মাধ্যমে প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮ কেজি করে ১৬ কেজি চাল ছাড়া এ পর্যন্ত কোন সরকারি সহযোগিতা পাইনি। এলাকায় কোন কাজ নেই। কাজের সন্ধানে স্বামী গফফার চার মাস আগে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। বাড়িতে ঠিক মতো টাকা পাঠায় না। এখন শুনছি রংপুর গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানে ঘর-সংসার পেতেছে। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে আমার'।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া গ্রামের বেসরকারি স্কুল শিক্ষক ওলিউর রহমান জানান, শ্রিপুর-কুড়িকাউনিয়া ওয়ার্ডে সাড়ে ১১শ পরিবারের বসবাস। আম্পানের পরে ১৭৫ পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এরমধ্যে অনেকেই স্ত্রী, সন্তান ফেলে অন্য জেলায় গিয়ে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে। স্বামীরা প্রথম স্ত্রী, সন্তানদেরকে খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অবস্থা নেই। গ্রামের ভিতর একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হলে একাধিক বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যেতে হয়। রাস্তাঘাট বলতে কিছুই নেই। গ্রামের উপর দিয়ে এখনো জোয়ার-ভাটা বইছে।
চাকলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভিটেবাড়ি সবই নদীতে ভেসে গেছে। কিছুই নেই। কপোতাক্ষ নদের বেঁড়িবাঁধের উপর আম্পানের পর থেকে আমরা ২৫ পরিবার বসবাস করছি। সরকারি সহায়তা হিসেবে পরিবার প্রতি ২০ কেজি চাল ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেটিও ৫ দিন বাঁধ মেরামতের কাজ করার পর দিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ তাদের বসতভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকের পাকা বিল্ডিং, গোয়াল ঘর, রান্নাঘর, ধানের গোলা ছিল। এখন সেখানে কোন চিহ্ন নেই। আমাদের বসতভিটার উপর দিয়ে তৈরী হয়েছে নদী।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুর রহিম বলেন, 'শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, বাসস্থানসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত সাতক্ষীরা উপকূল অঞ্চলের মানুষ। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সাতক্ষীরা জেলা অনেক পিছিয়ে। এ জেলায় নিরক্ষরতার হার অন্য জেলা থেকে ১৮ ভাগ বেশি। আর স্বাস্থ্যসেবায় অন্যান্য জেলা থেকে ২০ ভাগ বেশি মানুষ বঞ্চিত। জেলায় তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় দিন দিন আরো পিছিয়ে পড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুর্নবাসনে সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন অতিরিক্ত বরাদ্দ। সরকার জরুরীভাবে পদক্ষেপ না নিলে সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চল বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে'।
তবে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল জানান, 'উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বাঁধ সেনা বাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যৌথভাবে তারা উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ সংস্কারে কাজ করছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবন এ অঞ্চলে প্রতি বছরই দুর্যোগের আঘাত বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। এসব জনপদের মানুষকে রক্ষায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে'।