ঈদের পর সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা, থার্ড ওয়েভ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়ার তাগিদ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জারি করা চলমান লকডাউনের মধ্যে মার্কেট, গণপরিবহন সব খুলে দেয়া হয়েছে। কমেছে মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতাও। ভ্যাকসিন সংকটের কারণে প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সপ্তাহখানেক দেয়ার মত দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিনের মজুত রয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভারতে সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্সিজেনের মজুত বাড়ানো, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা, শতভাগ মাস্ক নিশ্চিত করা, ভারত ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা ও জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যখনই কোন দেশে সংক্রমণ কমে যায় তখন স্বাস্থ্যবিধি মানায় অনীহা দেখা দেয় এবং সংক্রমণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশে থার্ড ওয়েভ আসার শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের এখন সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে এর ফলে দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণ ও তিন সপ্তাহ পর মৃত্যু বেড়ে যেতে পারে'।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'শপিংমল- দোকানপাটগুলোতে যেভাবে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে এতে বলা যায়, দেশে সংক্রমণ আবারও বাড়বে। যার প্রভাব আমরা ১৬ মে'র পরে দেখতে পারব'।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. টিটু মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'এখন বাজার খুলে গেছে, ছোট গাড়িতে মানুষ গাদাগাদি করে যাচ্ছে এসব কারণে ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া সীমান্ত বন্ধ থাকলেও ভারত থেকে অনেকেই আমাদের দেশে আসছে তাদের ঠিকমত কোয়ারেন্টাইন করা না হলে সংক্রমণ বাড়তে পারে'।
ডা. টিটু মিয়া বলেন, 'কেসের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে কোন দেশেই সামলাতে পারেনি আমরাও পারবো না। তাই আমাদের করোনা প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। যে ধরনই আসুক না কেন মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানলে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। যে যেখানে আছে সেখানে থেকে ঈদ করতে হবে, ঈদে যেন চলাচল না বাড়ে'।
কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এরইমধ্যে ভারত বাংলাদেশে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে দিনে ৭০-৮০ টন মেডিকেল অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিক টাইমে দিনে সর্বোচ্চ অক্সিজেন চাহিদা ছিল ২১০ টন পর্যন্ত। এই মুহুর্তে দেশে দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টন। সরকারিভাবে আপদকালীন সময়ের জন্য এই মুহুর্তে দেশে প্রায় ৯০০ টন অক্সিজেন মজুদ রাখা হয়েছে।
ডা. টিটু মিয়া বলেন, 'সংক্রমণ মোকাবিলায় এখনো পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে। তারপরও এখন আমাদের অক্সিজেন ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। শুধু যাদের প্রয়োজন তাদেরই অক্সিজেন দিতে হবে'।
সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে দ্রুত অধিক মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু ভ্যাকসিন সংকটের কারণে আমাদের দেশে টিকাদান কার্যক্রম থমকে গেছে। এখন পর্যন্ত ৫% মানুষকেও টিকাদানের আওতায় আনা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে যদি থার্ড ওয়েভ আসে তাহলে মৃত্যু আরো বাড়বে। চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন কেনার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন চুক্তি হয়নি।
ভারতের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ
করোনাভাইরাসের ডাবল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্টের কারণে প্রতিবেশি দেশ ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।
গত বুধবার ভারত সরকারের শীর্ষ বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা জানান, করোনাভাইরাসের থার্ড ওয়েভ 'অনিবার্য', ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলোতে ছাপিয়ে গেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এ অবস্থায় করোনার নতুন স্ট্রেইন মোকাবিলায় ভ্যাকসিনগুলোর 'আপডেট' করা দরকার প্রতিনিয়ত। খবর এনডিটিভির।
সীমান্ত বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন ভারত থেকে অনেক মানুষ এদেশে আসছে। তাদের ঠিকমত কোয়ারেন্টাইন করা না হলে সেই ভেরিয়েন্ট যেকোন সময় দেশে প্রবেশ করতে পারে এবং আমাদের দেশে ছড়াতে পারে। এ পর্যন্ত ভারত থেকে ৬০ জন করোনাভাইরাস পজেটিভ রোগী দেশে এসেছে। তারা করোনাভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত কিনা তা জানতে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে। তবে আরো বেশি জিনোম সিকোয়েন্সিং করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমো (কোভিড -১৯ মডেলিং) কনসোর্টিয়াম দলের সদস্য অধ্যাপক শফিউন শিমুল বলেন, 'ভারতের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক বেশি ভাবাচ্ছে। কারণ ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে আমাদের অনেক অমিল রয়েছে কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভারতের সঙ্গে মিল অনেক। তাই সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। অক্সিজেনের মজুত পর্যাপ্ত রাখতে হবে যদি থার্ড ওয়েভ আসে, তাহলে সিস্টেম যেন ভেঙ্গে না পড়ে'।
ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা নিন: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ভারতের করোনা পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
গতকাল এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আজকে ভারতের এই পরিস্থিতি। আমাদের এখানেও ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমাদের অবস্থাও ভারতের মতো হতে পারে। ঈদে নতুন জামা আনন্দ দিতে পারে তবে এই আনন্দ ট্র্যাজেডিতেও রূপান্তর হতে পারে'।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'ভারতের করোনা সংক্রমণ বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সর্তক হতে হবে। ভারতেও করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে তারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে করোনার মধ্যে নির্বাচন, হোলি খেলা, বিয়ে অনুষ্ঠান করেছে। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত'।
মন্ত্রী বলেন, 'এখন যে অক্সিজেন আছে তা দিয়ে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে তা মোকাবিলা করতে কোন সমস্যা হবে না। তবে, কোভিডে আক্রান্তের মাত্রা নিয়ন্ত্রণহীন হলে এবং মানুষ অস্বাভাবিকভাবে আক্রান্ত হলে বড় রকম সমস্যা হতে পারে'।