একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ...তারপর বিস্মৃতির অতলে!
পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব, হাসপাতালের ধরন ও সুবিধাভোগী কারা হবে এবং জনবল নিয়োগ জটিলতায় অবকাঠামো নির্মাণের চার বছরেও চালু করা যায়নি ৫০ বেডের একটি সরকারি হাসপাতাল।
এ অবস্থায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে অব্যহৃত থাকায় ভেন্টিলেটর , অ্যানালাইজার , বার্ন ট্যাঙ্কসহ দামি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেক মেডিকেল যন্ত্রপাতি।
হাসপাতালটি হলো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল। ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বারে, ১০ তলা ভিতে ৫ তলা বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনসহ ২ তলার একটি কিচেন ও বিনোদন ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের জুনে।
নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হাসপাতালটি চালু করা হলে এটি হত বাংলাদেশের প্রথম বার্ন হাসপাতাল। কারণ সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিট ছাড়া একক কোনো বার্ন হাসপাতাল ছিল না।
২০১৯ সালে চালু হয়, ৫০০ বেডের 'শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারী'। আর এর পরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতালটির প্রয়োজনীয়তা হারায়।
হাসপাতালটির গুরুত্ব হারানোর প্রভাব পড়ে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াতে। ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালটির জনবল নিয়োগের সম্মতিতে দুটি শর্ত আরোপ করে অর্থ বিভাগ। এর একটি হলো বার্ন হাসপাতালটি জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তর করা এবং অন্যটি জনসাধারণের জন্য ২৫% সেবা উন্মুক্ত করা। এই দুই শর্তে গত বছর চাহিদার ৪১ শতাংশ জনবল নিয়োগে সম্মতি দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ বিভাগের শর্তে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর রাজী থাকলেও জনবলের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি রয়েছেতাদের। ফলে কবে হাসপাতালটি চালু করা যাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের (এফএসসিডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, 'বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতালটি জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তর এবং ২৫% সেবা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখার বিষয়ে এফএসসিডি অধিদপ্তর একমত হলেও কবে এটি চালু করা যাবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ হাসপাতালটি চালু করতে যে পরিমাণ জনবলের প্রয়োজন তার সম্মতি এখনও পাওয়া যায়নি'।
পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা
এফএসসিডি অধিদপ্তরের জন্য বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের জুনে। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে হাসপাতালের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। হাসপাতালের জন্য বার্ন ইক্যুপমেন্ট কেনা হয় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বেডের সংখ্যা ৩০০ এ উন্নীত করা এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। ২০১৫ সালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট স্থাপন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন ইনস্টিটিউট।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দুটি প্রকল্পই প্রায় সমসাময়িক । শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট স্থাপনের পর ফায়ার সার্ভিস ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল গুরুত্ব হারাবে, বিষয়টি সরকারের সংস্থাগুলোর মধ্যে বোধগম্য হয়নি। ফায়ার সার্ভিস বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি একবার সংশোধন করা হলেও সাধারণ হাসপাতালে রূপান্তরের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বার্ন ট্রিটমেন্ট বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, 'ফায়ার্স সার্ভিসের বার্ন হাসপাতালটির এখন আর প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালেও পর্যালোচনা করার সুযোগ ছিল। তিনি আরও বলেন, দেশে অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসার জন্য দক্ষ ডাক্তার ও জনবলের অভাব রয়েছে। এখন এত ডাক্তার কোথা থেকে আসবে! বার্ন হাসপাতাল হিসেবে চালু করলেও এখান থেকে উন্নতমানের বার্ন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। এ প্রেক্ষাপটে হাসপাতালটি প্রাথমিক বার্ন চিকিৎসা কেন্দ্র বা জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে'।
বাস্তবায়ণ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, ২০১০ সালের এপ্রিলে দেশে এফএসসিডির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৬৩৩৬ জন, যা বেড়ে বর্তমানে ১২০০০ হয়েছে। কিন্ত প্রকল্পটি নেওয়ার সময়, সে সময়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৫ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৭১,৭০৭ জন হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এ বিবেচনায় প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে উদ্ধারকাজে ফায়ারম্যানদের হতাহতের তথ্য পর্যালোচনা না করেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। এতে প্রকল্পে প্রয়োজনটা উঠে আসেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এফএসসিডি'র দমকল ও উদ্ধারকর্মীদের আহত হওয়ার ধরন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১০ বছরে বিভিন্নভাবে মোট ৭৭ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ২৭ জন । জখম, হাত-পা ভেঙ্গে বা কেটে আহত হয়েছেন ৪৫ জন। চোখে আঘাত পেয়েছেন ৩ জন।এ ধরণের পর্যালোচনা প্রকল্প নেওয়ার আগে করা হলে, প্রকল্পের যৌক্তিকতা উঠে আসত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছয় বছর
২০১৫ সালের নভেম্বরে চাহিদা অনুযায়ী হাসপাতালটি চালু করতে রাজস্ব খাতে বার্ন ট্রিটমেন্টে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ ১৫২ জন জনবল নিয়োগের চাহিদা দেয় এফএসসিডি অধিদপ্তর। এর প্রায় দেড় বছর পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৭৮টি পদের সম্মতি পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বিভাগও এতে সম্মতি দেয়।
কিন্ত অর্থবিভাগ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজস্ব খাতে ৩৮ জন এবং আউটসোর্সিয়ের মাধ্যমে ২৪ পদে জনবল নিয়োগে শর্ত সাপেক্ষে সম্মতি জানায়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব পদ সৃজনের জন্য প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
এফএসসিডি অধিদপ্তর জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৭৮ জন জনবলের পদের জন্য সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়। তবে ৭৪ পদের ঘাটতি রয়ে যায়। অন্যদিকে হাসপাতালে কার্যক্রম শুরু করতে অর্থ বিভাগ ৬২ জনবলে (রাজস্ব খাতে ৩৮ ও আউটসোর্সিং ২৪) সম্মতি দেয়। এক্ষেত্রে জন প্রশাসনের সস্মতির তুলনায় ১৬টি এবং প্রকল্প প্রস্তাবের তুলনায় ৯০ জন জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এত ঘাটতি জনবল নিয়ে তিন শিফটে (২৪ ঘন্টা) চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হবে।
চিকিৎসা সরঞ্জামাদি
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বার্ণ ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল স্থাপনের লক্ষ্যে ৩৩০ প্রকারের চিকিৎসা সরঞ্জামাদির আইটেম কেনা হয়। এর মধ্যে মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট, বার্ন ইক্যুপমেন্ট, সার্জিকাল ইক্যুপমেন্ট ও এক্সেসরিজ, ল্যাব ইক্যুপমেন্ট, অফিস ফার্নিচার ও আইটি ইক্যুপমেন্ট হিসেবে ভাগ করা যায়।
টিবিএসের সরেজমিনে পরিদর্শন ও আইএমইডির প্রতিবেদন অনুয়ায়ী প্রকল্পের আওতায় কেনা ৪৬ আইটেম বিশেষ করে সার্জিকাল আইটেমগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ল্যাটেক্স গ্লোভস, সিরিঞ্জ, ইজিবি স্ট্যাট কার্তুজ, ক্যাথেটার, এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব, এক্স-রে ফিল্ম, ইনফিউশন সেট, ওয়াশ কিট, সাকশন ক্যাথেটার, পুরষের জন্য অভ্যন্তরীণ ক্যাথেটার, বাইন সার্কিট অ্যাডাল্ট, মূত্র সংগ্রহের ব্যাগ।
পাঁচটি আইটেম আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা মেরামত বা সার্ভিসিং করে চালানো যেতে পারে।
হাসপাতালের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির মধ্যে বার্ন ট্যাঙ্ক, শাওয়ার ট্রলি, পেশেন্ট লিফটার, স্কিন মেশার ইত্যাদর বিশেষায়িত বার্ন হাসপাতালে ব্যবহারযোগ্য।
অন্যান্য আইটেমগুলো যেকোন জেনারেল হাসপাতালে মেয়াদ থাকা সাপেক্ষে ব্যবহার করা যাবে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
হাসপাতাল সাইট
হাসপাতালটি ঢাকা মহানগরীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের এফএসসিডি ট্রেনিং কমপ্লেক্সের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভবন নির্মিত হওয়ার কারণে মাঠের আকার সংকুচিত হয়ে পড়ায় প্রশিক্ষণরত ফায়ারম্যানদের জন্য স্থান সংকুলান করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান মিরপুর ফায়ার সার্ভিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ফায়ারম্যানরা।
এফএসসিডির কর্মীরা জানান, উদ্ধারকাজ ছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ প্রদর্শনী, যাতায়াতের সময়ে দুঘটনার কারণে বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এ জন্য বিশেষায়িত বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতালের পরিবর্তে জেনারেল হাসপাতালের মাধ্যমে এফএসসিডির কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং তাদের পরিবারে সদস্যরা অনেক বেশি উপকৃত হতে পারবে।
এফএসসিডির কর্মীরা আরও জানান, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের মতো, অন্যান্য সরকারি পেশাজীবিদের জন্য হাসপাতাল রয়েছে। ওই খানে পরিবারের সদস্যসহ সরকারি কর্মচারীরা কম খরচে চিকিৎসা নিতে পারছে। কিন্ত এফএসসিডির জন্য সাধারণ কোনো হাসপাতাল নেই। বেতন স্কেল কম হওয়ার কারণে এফএসসিডির অনেক কর্মী অসচ্ছল জীবনযাবন করে। তাদের পক্ষে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। এ কারণে সাধারণ হাসপাতালে রূপান্তর করেীই হাসপাতালটি দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করা গেলে ফায়ারম্যান ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হবে।