এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ ‘অবৈধ’ নিয়োগ
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা না মেনেই ছয় শিক্ষক ও সাত কর্মচারী 'অবৈধভাবে' নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অফিসে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাত কর্মচারীকে। একদিন পর ২৪ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরও ছয় শিক্ষক।
এসব নিয়োগ দেওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী কোনো পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলছেন, নিজের আত্বীয় স্বজনদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য ও কারও কারও নিয়োগ বাণিজ্যের পথ সুগম করতেই উপাচার্য এ পথ বেছে নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৌশল অফিসে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে দুইজনের বাড়ি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের গ্রামে, একজন উপাচার্যের বাংলোর কর্মচারীর ছেলে, দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোকানদার। বাকি দুইজন স্থানীয় বাসিন্দা। যাদের কারোই প্রকৌশল বিভাগে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে নিয়োগ পাওয়া ছয় শিক্ষকের বিষয়ে তথ্য সরবরাহে অস্বীকৃতি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইউজিসি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, 'দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন ব্যতিরেকে অ্যাডহক, দৈনিক ভিত্তিক জনবল, মাস্টার রোলে নিয়োগ দিতে পারবে না। এমনকি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও নিয়োগ দিতে হলে ইউজিসির অনুমোদন লাগবে।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ নিয়োগকে 'অবৈধ' উল্লেখ করে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহিদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোনো অবস্থাতেই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ব্যতিরেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরণের নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ নিয়ম না মেনে দেওয়া সকল নিয়োগ অবৈধ বলে গণ্য হবে।'
'ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি অবশ্যই পত্রিকায় প্রকাশ হতে হবে। আমরা তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইবো-শোকজ করবো,' যোগ করেন অধ্যাপক কাজী শহিদুল্লাহ।
ইউজিসির নির্দেশনার কথা স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান বলেন, 'আসলে এভাবে নিয়োগ দেওয়া এখন সম্ভব না' তবে কেন এই নিয়োগ এর কোনো উত্তর তিনি দেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার বলেন, 'এটি দৈনিক ভিত্তিক নিয়োগ। এ ধরনের নিয়োগে ইউজিসির অনুমতি লাগে না। রেজিস্ট্রার সাহেব আমাকে নোট দিয়েছেন। আমি সে নোট অনুমোদন করেছি।'
উপাচার্য এইসব নিয়োগকে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ বলে দাবি করলেও নিয়োগের নথিতে সাত কর্মচারিকে মাসিক ৯ হাজার টাকা বেতনে চাকরির কথা উল্লেখ রয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে আসা কিছু নথি থেকে জানা গেছে, ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবু সাইদ খানকে উদ্দেশ্যে করে লেখা হয়, 'আপনার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, নিম্নোক্ত সাতজনকে মাসিক সর্বসাকল্যে ৯ হাজার টাকা বেতনে ছয় মাসের জন্য পাম্প সহকারী হিসেবে কাজ করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।'
নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- শাহরিয়ার ইসলাম, ছানা উল্লাহ, বেলাল হোসেন, আব্দুল মুকিত, ইসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ নোমান, মো. মোরশেদ। তবে ওই চিঠিতে তাদের নিয়োগ দৈনিক ভিত্তিক, অ্যাডহক, চুক্তিভিত্তিক নাকি মাস্টার রোল তার কোনোটিই উল্লেখ করা হয়নি।
এর ঠিক একদিন পর ২৪ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয় ছয় শিক্ষককে। বিষয়টি নিশ্চিত করে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কলেজের একাদশ শ্রেনীতে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে আছে, তাদের ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তাই ৬০টি ক্লাস নেওয়ার চুক্তিতে ৬টি বিষয়ে ৬ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মাসিক বেতনের কথা উল্লেখ থাকার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দফতরে দৈনিক ভিত্তিতে যারা কাজ করছেন তারা শুধুমাত্র যেদিন কাজ করেন সেদিনই পদ অনুযায়ী নির্ধারিত ভাতা পান। তাদের কাজের তালিকা ও হাজিরা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অফিস প্রধান বিল অনুমোদন করার পর তাদের বেতন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দীর্ঘ দেড় বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস বন্ধ আছে। বর্তমানে কলেজে ২২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অন্ধকারে রেখে জরুরী ভিত্তিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের কোনো কারণে নেই।'
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা অবস্থায় কেন এই নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে পানির সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু সেটি এখন তো নেই। এক বছরের বেশি সময় ক্যাম্পাসের সব হল, ফ্যাকাল্টি বন্ধ। শুধু কিছু অফিস খোলা। এ জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে এক-দেড় মাসেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা যায়। বিজ্ঞাপন দিলে তো যোগ্যদেরই নিয়োগ দিতে হয়। এতে পছন্দের লোক নিয়োগ দেওয়া কঠিন। এখন যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের কেউই প্রকৌশল কাজে দক্ষ নন। মূলত পছন্দের মানুষ নিয়োগ দিতে এবং কারও কারও নিয়োগ বাণিজ্যের পথ সুগম করতেই ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতর ও কলেজের চাহিদা সাপেক্ষে শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্থায়ী কোনো পোস্ট না হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। যখন নিয়োগ চূড়ান্ত হবে তখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে।