এসএসসির ফল: ফিরোজা বেগমের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত
ধনী হোক কিংবা গরিব; স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই! তাই তো একমাত্র ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বরগুনার চরকলোনী এলাকার দরিদ্র ফিরোজা বেগম। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে উপার্জন আর স্বামী দেলোয়ার হোসেনের রিকশা চালিয়ে আয় করা টাকায় চলত তাদের একমাত্র ছেলে হৃদয়ের লেখাপড়া।
ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নে বিভোর এই দম্পতি মোঃ সুজন মিয়া হৃদয়কে ভর্তি করিয়েছিলেন বরগুনার টেক্সটাইল অ্যান্ড ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে। দুষ্টুমিতে পটু হৃদয় লেখাপড়ায়ও একেবারে খারাপ ছিল না। সদ্য প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ ৪.১১ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে।
এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে হৃদয়কে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন এক ধাপ এগিয়ে গেলেও সেই স্বপ্নই আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে ফিরোজা বেগমের।
গত সোমবার, ঈদুল ফিতরের দিন বিকেলে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকায় পায়রা নদীর তীরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যায় হৃদয়। এ সময় পূর্বশত্রুতার জেরের পাশাপাশি সঙ্গে থাকা এক বান্ধবীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হৃদয়সহ তার কয়েক বন্ধুকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক-কিশোর।
পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করালে হৃদয়ের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সকালে মারা যায় হৃদয়।
একে তো একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোক, তার ওপর সেই হারানো সন্তানের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের খবর! সব মিলিয়ে পাথর বনে গেছেন নিহত হৃদয়ের মা ফিরোজা বেগম।
হৃদয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফল জানতে পেরে অস্ফূট কণ্ঠে ফিরোজা বেগম বলেন, 'ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর ইচ্ছা ছিল। আমাদের মতো যেন কষ্ট করতে না হয়, এজন্য হৃদয়কে শিক্ষিত বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব শেষ করে দিল ওরা।'
হৃদয়ের বাবা দেলোয়ার হোসেন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, 'রেজাল্ট দিয়ে কী হবে? আমার বাবায়ই তো আর নাই।'
ফিরোজা বেগমের প্রতিবেশী জালাল আহমেদ বলেন, 'একে তো দরিদ্র পরিবার, তার মধ্যে একটি সন্তানকে জন্মদান থেকে শুরু করে ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত লালন-পালন এবং লেখাপড়া করানোর পেছনে যে সময়, শ্রম, অর্থ এবং আদর স্নেহ ও ভালোবাসা তারা দিয়েছেন, মুহূর্তেই তা সম্পূর্ণ ধুলোয় মিশে গেছে কিছু বিপথগামী ছেলেপেলের কারণে।'
এ সময় তিনি হৃদয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, 'ফিরোজা বেগম তার একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছেন। কোনো বাবা-মা তার সন্তান হারানোর বেদনা কখনো ভুলতে পারেন না। ফিরোজা বেগমের কান্না দেখলে আমাদেরও কান্না পায়। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমরা নির্বাক।'
বরগুনার টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, 'হৃদয় ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিল না, আবার খুব খারাপও ছিল না। আমাদের প্রত্যাশা ছিল- এসএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ ৪ পেতে পারে। আমাদের ধারণাই সঠিক হয়েছে। হৃদয় জিপিএ ৪.১১ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ভালো ফলাফল করার পরও হৃদয়ের জন্য আজ আমাদের অশ্রু ঝরছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এ খারাপ লাগাটা বলে বোঝাতে পারব না।'
বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহজাহান হোসেন বলেন, 'হৃদয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১৪-১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলার প্রধান আসামিসহ ইতোমধ্যেই আমরা সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আদালত ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে তিনজনের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আমরা তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।'
বাকি আসামিদের ধরতে পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।