করোনায় বদলে যাওয়া জীবন, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এখন খামারি
"করোনা মহামারিতে সারাদেশের ব্যবসা বিপর্যস্ত। কারখানাগুলো শ্রমিক শূন্য। একা একা অফিসে এসে বসে থাকতাম আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতাম। একদিন হঠাৎ চিন্তা এলো, ছোট্ট একটা খামার করার। সেই চিন্তা থেকে কারখানার পাশের জায়গায় দুটো গাভী নিয়ে শুরু করি। গত দশ মাসে আমার খামারে নানা জাতের ১২৫টি গরু পালন করেছি। এবার ঈদুল আযহায় অন্তত ৮৮টি গরু বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।"
করোনায় বদলে যাওয়া জীবনের গল্পটা এভাবেই শোনাচ্ছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সহ-সভাপতি ও আর ডি এম গ্রুপের চেয়ারম্যান রকিবুল আলম চৌধুরী।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদে তার গড়ে তোলা 'ইউনি এগ্রো ফার্মে' গিয়ে দেখা যায়, আরডি এম গ্রুপের পোশাক কারখানার পাশেই ৩০ কাঠা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মাঝারি একটি খামার। খামারে শাহিয়াল, ফ্রিজিয়ান ও ক্রস ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালন করা হচ্ছে। পাশাপাশি দুধের চাহিদা মেটাতে রয়েছে কয়েকটি অস্ট্রেলিয়ান গাভীও। অনেকেই ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে গরু কিনতে খামারে আসছেন।
রকিবুল আলম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রথম দিকে নিজের পরিবারের দুধের চাহিদার কথা ভেবে খামার প্রতিষ্ঠা করা হলেও পরবর্তিতে তা বড় করার উদ্যোগ নেই। বর্তমানে খামারে ১ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা দামের গরু আছে। ১০ মাস আগে দেশের রাজশাহী ও যশোর থেকে গরুগুলো কিনেছিলাম প্রতিটি এক থেকে দেড় লাখ টাকায়। বর্তমানে এদের একেকটির ওজন ৬ মণ থেকে ১৭ মণ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ৩৫টি গরু বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি চারটি গাভী থেকে পরিবার ও স্বজনদের দুধের চাহিদা মিটছে। প্রতিটি ২০ থেকে ২৭ কেজি দুধ দেয়।"
"শুরু থেকেই আমরা মাংসের গুনগত মানের দিকে নজর দেই। দেশীয় পদ্ধতিতে বড় করা গরুগুলোর প্রতিমাসে ৪৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো ওষুধ ব্যবহার করিনি। প্রতিদিন অনেকেই আসছেন গরু দেখতে। ভবিষ্যতে গ্রামের দিকে আরও বড় পর্যায়ে ফার্ম প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা আছে", যোগ করেন রকিবুল।
প্রতিমাসে ৪ হাজার কেজি মাংস যাচ্ছে শ্রমিকদের ঘরে
রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন "আর ডি এম অ্যাপারেল লিমিটেডসহ আমাদের ৬টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মচারী আছেন। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে কারখানায় শ্রমিকরা আসতে শুরু করলো। তখন চিন্তা করলাম শ্রমিকদের সবার তো গরুর মাংস বাজার থেকে কিনে খাওয়ার সামর্থ নেই। তাই প্রতিমাসে একবার খামার থেকে গরু জবেহ করে ৪ হাজার শ্রমিকের মাঝে ১০০ টাকা ভর্তুকিতে বিক্রি শুরু করি। এর বাইরে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ মণের মত মাংস বিক্রি করি। ভর্তুকির টাকাটা ওখান থেকে আসা লাভের সঙ্গে স্বমন্বয় করে নেই।"
ক্রেতাদের নজর কাড়ছে ব্ল্যাক বিউটি, সুন্দরী
ইউনি এগ্রো ফার্মের দুটি শেডে সারি সারি করে বাঁধা আছে প্রায় দেড়শ গরু। তবে খামারে প্রবেশ করেই ক্রেতাদের চোখ আটকে যাচ্ছে বিশাল 'ব্ল্যাক বিউটি'তে। কুঁচকুঁচে কালো শাহিয়াল জাতের গরুটি নিয়ে ক্রেতাদের আগ্রহের কমতি নেই। ১৬ মণ ওজনের ব্ল্যাক বিউটির জন্য রকিবুল আলম দাম হেঁকেছেন ৮ লাখ টাকা। পাশেই লাল টকটকে বর্ণের 'সুন্দরী'। ক্রস ফ্রিজিয়ান জাতের এই গরু কিছুটা ক্ষেপাটে। ফার্মের কর্মচারীরা জানান সুন্দরীকে বাগে আনতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। সুন্দরীর দাম চাওয়া হচ্ছে ৭ লাখ টাকা।
ইউনি এগ্রো ফার্মের কর্মচারী মোহাম্মদ আলামিন বলেন, "প্রতিটি গরুকে দুই বেলায় ৩০ কেজি করে ৬০ কেজি খাবার দিতে হয়। কারখানার পাশে হওয়ায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিটি গরুকে দিনে তিনবার গোসল করাই। ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা এসেই ব্ল্যাক বিউটি আর সুন্দরীর সাথে সেলফি নেয়।"
ফার্মের ভেতরেই কথা হয় গরু কিনতে আসা ব্যবসায়ী আলী আশরাফের সঙ্গে। তিনি বলেন, "রাকিব ভাই প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। পাশাপাশি যে উদ্যোগটা নিয়েছেন তা অসাধারণ। খামার ঘুরে বেশ ভালো লাগছে, একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে দারুণ আয়োজন। আশা আছে এবার কোরবানিতে এখান থেকেই গরু কিনবো।"
রকিবুল আলম বলেন, "আমি আরএমজি সেক্টরের মানুষ হলেও শেকড় আমার গ্রামেই, সেভাবে চলতেই পছন্দ করি। খামার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটা সেখান থেকেই। পাশাপাশি অনলাইনে পড়াশোনা করে এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জেনেছি। গরুর খাবারের জন্য আমাদের গ্রামে (ফটিকছড়ি) সাড়ে চার একর জায়গায় ভুট্টা চাষ করেছি। পাশাপাশি কাঁচা ও শুকনো ঘাস আশপাশের উপজেলা থেকে সংগ্রহ করে থাকি। প্রতি মাসে ফার্মের খরচ প্রায় ৮ লাখ টাকা।"
শিক্ষিত যুবকদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিজিএমইএ নেতা রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, "দেশে মাংস ও দুধের চাহিদা অনেক। তাই চাকরির পেছনে না ছুটে অন্তত দুটি ভালো জাতের গরু বা চারটা গাভীও পালন করতে পারেন বেকার যুবকরা। এটা ভালো একটি ব্যবসা। আশা করছি বছর শেষে তারা ভালো আয় করতে পারবেন। বর্তমান সরকারও এগ্রো খাতে প্রণোদনা দিচ্ছে। তাই শিক্ষিত যুবকদের এ খাতে এগিয়ে আসা উচিত।"