কুমিল্লার মণ্ডপে পাওয়া কোরআন শরীফটি বাংলাদেশে ছাপা নয়: পুলিশ
গত বুধবার কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পাওয়া পবিত্র কোরআন শরীফটি বাংলাদেশে ছাপা হয়নি, বরং এটি সৌদি আরব থেকে আনা হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার পর বুধবার দুপুরে কুমিল্লা পুলিশ গাঢ় সবুজ রংয়ের কোরআন শরীফটি নিয়ে যায়। এটি এখন মামলার আলামত হিসেবে কোতোয়ালী থানার জিম্মায় আছে।
ছাপা, কাগজ ও ক্যালিগ্রাফির কাজ থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটি সৌদি আরবে ছাপা বলে মনে করছে পুলিশ। কোরআন শরীফটি ঘটনার আগের রাতেই আনা হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ এখন কোরআনটির পাতায় ও ওপরে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে সন্দেহভাজন আসামিদের হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখছে ।
পূজা আয়োজনের সাথে যুক্ত থাকা কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির দর্পণ সংঘের সভাপতি সুবোধ রায় গতকাল টিবিএসকে জানান, 'কোরআন শরীফটি কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ের কারো চোখে পড়েনি। হঠাৎ করেই সকালবেলা দুজন লোক এই বিষয়ে চেঁচামেচি ও লাইভ করা শুরু করেন।'
সকালে যে দুই ব্যক্তি মণ্ডপে চিৎকার করছিলেন, তারা হলেন ফয়েজ আহমেদ ও একরাম হোসেন। দুজনেই এখন পুলিশ হেফাজতে আছেন। একরাম হোসেন সকাল সাতটার দিকে জরুরি সেবা সহায়তা নম্বর ৯৯৯-এ কল করে ভুয়া পরিচয় দিয়ে কোরআন পাওয়ার কথা জানান। তার কল পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
সুবোধ জানান, একরাম পুলিশকে কোরআনটি সরিয়ে নিতে দেননি। উল্টো তিনি হঠাৎ করেই ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন। পূজামণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে রেখে যাওয়া গাঢ় সবুজ রংয়ের কোরআন শরীফটি সরাসরি না দেখলেও ফেসবুকের লাইভ ভিডিও ও ছবিতে সেটি দেখেছেন বলে জানান সুবোধ।
টিবিএসের দুই প্রতিনিধি কুমিল্লার বেশ কয়েকটি লাইব্রেরিতে ঘুরে হুবহু ওইরকমের কোরআন শরীফ খুঁজে পাননি। এর মধ্যে শুধু কান্দিরপাড়ের বিসমিল্লাহ ও মোগলটুলীর ফয়েজিয়া লাইব্রেরিতে কাছাকাছি সবুজ রংয়ের কোরআন শরীফ পাওয়া গেলেও সেগুলো মণ্ডপের কোরআন শরীফের সাথে মিলেনি। কাছাকাছি শুধু মীনা ব্রাদার্সের ছাপা একটা কোরআন শরীফ পাওয়া গেলেও তাতে বাংলা অক্ষরে ছাপা রয়েছে। মীনা ব্রাদার্সের ঢাকার অফিসে যোগাযোগ করলে তারা এরকম কোরআন শরীফ ছাপেননি বলে জানান।
কুমিল্লা সদরের আমড়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ। অনেকদিন তিনি সৌদি আরবে ছিলেন। বছরখানেক আগে তিনি সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন বলে জানান আমড়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হক।
মোজাম্মেল হোক বলেন, দেশে ফেরার পর কুমিল্লা শহরের খন্দকার হক মার্কেটে 'মোবাইল সেবা' নামে একটি মোবাইলের দোকান দেন ফয়েজ। তবে ফয়েজ কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত আছেন কি না সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি মোজাম্মেল হক।
সাম্প্রদায়িকতার থাবায় ক্ষতবিক্ষত ৭০০ বছরের ধর্মীয় সম্প্রীতি
কুমিল্লা জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে নানুয়ার দীঘি। এই দীঘির আশপাশের এলাকায় প্রায় ৭০০ বছর ধরে বাস করছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
দেশভাগের দাঙ্গার সময়েও যে জনপদে হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বে আঁচড় লাগেনি, সেই নানুয়ার দীঘির পাড়ের হিন্দুরা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
নানুয়ার দীঘির উত্তর পাড়েই পুরো এলাকার মানুষদের জন্য গোসল করবার ব্যবস্থা ও ঘাটলা আছে। মূলত এখানেই গত বেশ কয়েক বছর ধরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকার 'দর্পণ সংঘ' সংগঠন থেকে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়।
দর্পণ সংঘের অস্থায়ী পূজামণ্ডপ কমিটির কোষাধ্যক্ষ মিথুন মোদক টিবিএসকে বলেন, নানুয়ার দীঘির পাড়ে হিন্দু-মুসলমান মিলেই তারা পূজা উদযাপন করেন। এমনকি নানুয়ার দীঘির পাড় ১২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মুসলমানরাও এতে চাঁদা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
মিথুন জানান, পূজামণ্ডপ অস্থায়ী হওয়ায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। মণ্ডপের উত্তরপাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন ভবন ও পাশে পূবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক শাখা থাকলেও দুটি ভবনের কোনোটিতেই সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না।
পূজা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে একটি স্থানীয় বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা থেকে দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে রাখা হয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য। এদের একজন শাহীন ও আরেকজন মনির। ঘটনার আগের রাতে মণ্ডপ পাহারার দায়িত্বে ছিলেন শাহীন। সকাল আটটা পর্যন্ত ডিউটি ছিল তার। সকাল সাতটায় ৯৯৯-এ ফোন করার আগে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পুলিশ তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়।
মিথুন বলেন, 'সে লাইভে না গেলে উত্তেজনা ছড়াত না।'
অস্থায়ী পূজামণ্ডপের ঠিক উল্টোপাশের একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের নিরাপত্তরক্ষীর কাজ করেন মোকতার হোসেন। ঘটনার দিন সকাল সাতটা থেকে তার ডিউটি ছিল।
মোকতার জানান, তিনি বহুতল ভবনটিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এক যুবক দৌড়ে এসে তাকে পূজামণ্ডপে কোরআন শরীফ পাওয়ার খবর জানান।
মোকতার বলেন, 'শুরু থেকেই এই যুবকের [ফয়েজ আহমেদ] আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। কেমন জানি উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছিল। তাকে বিষয়টি নিয়ে হইচই না করতে বললেও সে শোনেনি। চেঁচামেচি চালিয়েই যায়।'
তিনি আরও বলেন, '৯৯৯-এ কল করার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে থানার ওসি স্যার আসেন। তিনি প্রথমে কোরআন শরীফটি বুকে করে নিয়ে যেতে চাইলে ফয়েজ আহমেদ নামে ওই যুবক ওসিকে বাধা দেয়। কী কী ইংরেজি ভাষায় ওসি স্যারের সাথেও "হট-টক" করে এই লোক।'
পরে সাড়ে সাতটার দিকে ফয়েজ নিজের মোবাইল থেকে লাইভে যান এবং মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার কথা বারবার জোর দিয়ে বলতে থাকেন বলে জানান মোকতার। এই সময় কোতোয়ালী থানার ওসি মোবাইলে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকেও লাইভে দেখাতে থাকেন ফয়েজ।
মোকতার বলেন, সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডিসি-এসপিসহ প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে হিন্দু সম্প্রদায় ও পূজা আয়োজন কমিটির লোকজনের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন। তারা পূজামণ্ডপের দুপাশের রাস্তায় বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে লোকজনের আসা বন্ধ করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাতেও তেমন একটা লাভ হয়নি। ফেসবুক লাইভের পর থেকে কয়েকশো লোকজন, যাদের বেশিরভাগই যুবক ও কিশোর বয়সী-উঠতি তরুণ, এসে হামলা শুরু করেন। বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে তারা। এতে কোতোয়ালী থানার ওসি ও ডিবির একজন আহত হন বলেও জানান ৫১ বছর বয়সি মোকতার হোসেন।
মূল অপরাধীকে অচিরেই গ্রেপ্তার করা হবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মঙ্গলবার বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনার মূল অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকার কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'মূল অভিযুক্ত বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আমরা ধরে ফেলতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। কুমিল্লায় কেন সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তা জানব।'
তিনি আর বলেন, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও অপপ্রচার ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে, তাদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। তাদের জবাব দিতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। জবাব দিতে হবে তাদের, কেন তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বিনষ্ট করছে।
যোগাযোগ করা হলে, কুমিল্লা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, তদন্তে 'ভালো অগ্রগতি' হয়েছে এবং শিগগিরই বিস্তারিত জানানো হবে।