খালের গতি ফেরাতে সমন্বয়ে উদ্যোগী দুই সিটি
কল্যাণপুর খালের পাড় ধরে হাটতে হাটতে কথা হচ্ছিলো নওয়াব মোহাম্মদ (৫০) এর সঙ্গে। ১২ বছর ধরে রজনীগন্ধা আবাসিক রোডে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি। খাল উদ্ধার হওয়ার পর এদিক দিয়ে যাতায়াত করেন তিনি। এর আগে দেড় কিলোমিটারের মতো ঘুরে কল্যাণপুরের মেইন রোড় ধরেই যাতায়াত ছিল তাদের। ।
তিনি বলেন, খাল উদ্ধার হওয়ার পর এ এলাকার পরিবেশ কিছুটা ফিরেছে। কিন্ত নিয়মিত পরিষ্কার না করা হলে, যা তাই হয়ে পড়ে। তবে বর্ষাকালে আগের মতো জলাবদ্ধতা না থাকার কথা জানান তিনি। কিছুদূর আগাতেই দেখা গেল খাল পাড় দিয়ে চলাচলের ওয়াকওয়ে শেষ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার ইব্রাহীমপুর খালের চিত্র ঠিক তার উল্টো। মাস তিনেক আগে পরিষ্কার করার ফলে খালের অস্থিত্ব দৃশ্যমান হলেও, এখনো গতি নেই এই খালে। অবশ্য বছর তিনেক আগে অবস্থা আরো শোচনীয় ছিল।
এদিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের কাছের খালটি উদ্ধারের পরেও এতোটাই সংকুচিত যে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এটাকে খাল বলার উপায় নেই। নালার মতো পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে পরিস্কার করা হয়। বর্ষাকালে পানির গতি বাড়ে। বছরের অন্যসময় থাকে জলাবদ্ধ।
রাজধানী জুড়ে অধিকাংশ খালের অবস্থাই নাজুক। তবে ঢাকার ওয়াসার কাছ থেকে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সিটি কর্পোরেশন বলেছে দ্রুতই উদ্ধার করে খালগুলো গতি ফেরাতে বদ্ধ পরিকর তারা । এই কার্যক্রম শুরু হবে আজ (শনিবার) থেকে।
এবিষয়ে ডিএনসিসি'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শনিবার থেকে খালগুলো পরিদর্শন করে ম্যাপ ধরে এগুলোর পরিধি চিহ্নিত করবো। এরপরে খালগুলো দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদ করে জমি উদ্ধার করা হবে।
এখন খালগুলো সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আসায় উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সমন্বয়ন সহজ হবে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আগে সিটি কর্পোরেশন এগুলো পরিষ্কার করা ব্যতীত অন্য কাজ করতে পারতো না। ফলে সমন্বয়হীনতা দেখা দিত।
খালগুলো দখলমুক্ত করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারী সংস্থাগুলোর সহায়তা নেয়া হবে। এটা নিয়ে দুই সিটি কর্পোরেশন পরিকল্পনা করছে। এছাড়া যেসব খাল একেবারেই অস্তীত্বহীন হয়ে পড়েছে সেগুলোর জমি উদ্ধার করে নতুন করে খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এর আগে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হন্তান্তরের অনুষ্ঠাননে এটিকে ঐতিহাসিক হিসেবে ঘোষণা দেন দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকার খাল-নালা উন্নয়নে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।
তখন তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানিয়েছিলেন, ডিএসসিসি এ ব্যাপারে প্রস্তুত। শনিবার থেকে ঢাকার জিরানি, মান্ডাসহ তিনটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট (পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা) পরিষ্কার করার কাজ শুরু করা হবে।
কালুনগর খাল আংশিক পরিষ্কার করা হয়েছে। এরপর ডিএসসিসি নিজস্ব অর্থায়নে ধোলাই খাল ও বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল নিয়েও কাজ করা হবে। খালগুলো উদ্ধার ও পরিষ্কার করে ঢাকা শহরকে একটি নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ার ঘোষণা দেন ফজলে নূর তাপস।
ওই অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। সিটি করপোরেশনের আওতায় আসায় ঢাকার খাল ঠিকানা পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি। আগের মতো পানির গতি ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আতিকুল ইসলাম।
সিটি জরিপ অনুসারে অনতিবিলম্বে ঢাকা শহরের খালগুলোর সীমানা চিহ্নিত করার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, খালের দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পুনঃখনন করে পানিধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাড় বাঁধাই করে সবুজায়ন, ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) এবং সাইকেল লেন তৈরি করা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা এক সময় প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হতো। নদী কমিশনের হিসেবে তখন নগরীতেই খাল ছিল ৬৫টি। আশির দশক থেকে এসব খাল ভরাট হতে থাকে। ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম আর অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ভরাট হয়ে পড়ে অধিকাংশ খাল।
তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সাথে কথা বলে ঢাকার খালের এ সংখ্যায় ভিন্নতা পাওয়া গেছে। ওয়াসার তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকায় প্রবহমান খালের সংখ্যা ২৬। পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বলছে, ঢাকায় রয়েছে ৫২টি খাল।
সরেজমিনে ঘুরে ও ম্যাপ থেকে ঢাকার প্রবহমান ও আংশিক প্রবাহমান যেসব খাল পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্যতম কল্যাণপুর খাল, মেরুল খাল, মহাখালী খাল, গুলশান খাল, রায়েরবাজার খাল, কচুক্ষেত খাল, আরামবাগ খাল, গোপীবাগ খাল, ধলপুর খাল ও ধোলাইখাল অন্যতম।
প্রবাহমান কিংবা আংশিক প্রবহমান বলা হলেও এসব খালের অধিকাংশই দৃশ্যত নালায় পরিণত হয়েছে। বাস্তবে কিছু খালের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।
ওয়াসার দায়িত্বে থাকা প্রবহমান ২৬ খালের মধ্যে ৭টি খাল পড়েছে ডিএসসিসি এলাকায়। বাকি খালগুলো পড়েছে ডিএনসিসি এলাকায়। দুই সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় থাকলেও এতোদিন এই খালগুলো দেখাশুনার দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। এই দায়িত্ব থেকে সম্প্রতি অব্যহত দেয়া হয়েছে সংস্থাটিকে।
তবে গত কয়েক দশক ধরে রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনেকেও সময়ে সময়ে উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। দুই একটা অভিযান সফলও হয়েছিল। পরে নানান জটিলতায় তা থেমে যেত। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে খালগুলো সম্পূর্ন ভার দুই সিটি কর্পোরেশনের হাতে ন্যস্ত হলো।
একেবারে সহজ না হলেও খাল উদ্ধার আগের থেকে গতি পাবে বলে মনে করে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মেয়ররা যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত সুতারাং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সাথে সমন্বয় করতে পারলে কাজ ভালো হবে। যেটা ওয়াসার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সমন্বয় করার সক্ষমতা সিটি কর্পোরেশনের সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক ম্যান্ডেড থাকায় মেয়র-কাউন্সিলদের পক্ষে খাল দখলমুক্ত করা সহজ হবে। তবে এটি করতে হলে সময়নির্ভর পরিকল্পনা নিতে হবে। উপযুক্ত জনবল নিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।
তবে এধরনের উদ্যোগ সর্বাংশে সফল করতে সবার আগে সামাজিক সক্ষমতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা না বাড়াতে পারলে এ ধরনের উদ্যোগের সফলতা আশা করা যায় না। সেজন্য ধারাবাহিকভাবে সামাজিক সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
উল্লেখ্য, রাজধানীর খালগুলো নাব্যতা সংকটে বর্ষা মৌসুমে তো বটেই শুষ্ক মৌসুমেও ভোগান্তির শেষ থাকেনা। জলাবদ্ধতার পাশাপাশি নগর দূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ এই খালগুলো। এ নিয়ে এতোদিন ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন পরস্পরকে দুষে আসছিল। সম্প্রতি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে 'ব্লেইম গেইম' শেষ হলো। খালগুলো নিয়ে দুই সিটির মেয়র শুনাচ্ছেন নতুন স্বপ্নের কথা।