গতি ফিরেছে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পে
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও বিশ্বের ১১৯ তম দেশ হিসেবে ২০২০ সালের শুরুতে ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট চালু করে বাংলাদেশ।
তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্লর্মকাণ্ডের সঙ্গে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিও বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে মহামারির প্রভাব কিছুটা কমে আসায় সরকার ইতোমধ্যেই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, দেশের ৭০টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করছেন জনসাধারণ।
তবে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের (ডিআইপি) একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নতুন মেশিন-রিডেবল-পাসপোর্টের (এমআরপি) নিবন্ধন ও পুনরায় নিবন্ধনের কাজ ইতোমধ্যে কমে গেছে। এবছরের মধ্যেই এমআরপি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ (ডিআইপি)।
ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের সহকারী পরিচালক ও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ভেরিডো'র জ্যাক ফারলে টিবিএস-কে বলেন, তারা ইতোমধ্যেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৫টি ই-গেট স্থাপন করেছেন। এবছর অন্যান্য বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে আরও ৩৫টি ই-গেট স্থাপন করা হবে।
ভেরিডো'র সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল স্থলবন্দরে তিনটি ও বুড়িমাড়ি স্থলবন্দরে আরও দুটি ই-গেট বসানো হবে।
জ্যাক ফারলে আরও জানান, প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার আবেদনকারীর তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা আছে তাদের। ভেরিডো বর্তমানে প্রতিদিন ১৫ হাজার পাসপোর্ট তৈরিতে সক্ষম বলেও জানান তিনি।
"কোভিড-১৯ মহামারি বিভিন্নভাবে আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত করেছে। মহামারির কারণে আমরা এখনো কিছু যন্ত্রপাতি আনতে পারিনি। অন্যথায়, এতোদিনে এই প্রকল্পের আরও উন্নতি হত," বলেন তিনি।
বায়োমেট্রিক সুবিধাসম্পন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসে নিযুক্ত কর্মীরা নাগরিকদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আইরিশ ও রঙিন ছবি- এসব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকেই নাগরিকরা পাসপোর্টের জন্য অনলাইনে আবেদন ও সময় নির্ধারণ করতে পারছেন, ফলে দীর্ঘদিন দেরি হওয়াও কমে আসছে। অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আহসান আল ইমন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন। সাত কার্যদিবসের মধ্যেই গত ৩ মার্চ তিনি বহুল আকাঙ্ক্ষিত ই-পাসপোর্ট পেয়ে যান।
"এর আগে আমার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ছিল। মাত্র সাত কার্যদিবসের মধ্যেই ই-পাসপোর্টে রূপান্তরের কাজ হয়ে যায়। সরাকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এধরনের সেবা পাওয়া অবিশ্বাস্য," বলেন তিনি।
আহসান আরও জানান, তিনি সিলেটের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ১০ বছর মেয়াদী ৪৮ পৃষ্ঠার এক্সপ্রেস ডেলিভারির আবেদন করেছিলেন। পাসপোর্টের জন্য তার খরচ হয় ৮ হাজার ৫০ টাকা। তবে কিছু সময় সাধারণ ই-পাসপোর্ট পাওয়া ও নাম বা ঠিকানার মতো তথ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী এবিষয়ে জানান, কিছুক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ শেষ না হলে তাদের কিছু করার থাকে না।
"দেশজুড়ে প্রতিদিন ২০ হাজার পাসপোর্ট নিবন্ধনের কাজ করছি আমরা বর্তমানে। আবেদনকারীদের সেবা দিতে দায়বদ্ধ আমরা," বলেন ইয়িনি।
"পাসপোর্ট নবায়নের প্রক্রিয়া এখন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই হয়ে থাকে। কিছু সময় মুদ্রণ যন্ত্র ও অন্যান্য সমস্যার কারণে আমরা পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারিনা," যোগ করেন তিনি।
২০২০ সালেই রাজধানীতে নতুন ই-পাসপোর্ট তৈরি ও পারসোনালাইজেশনের জন্য কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন হয়। কেন্দ্রটিতে আধুনিক প্রযুক্তির তথ্যকেন্দ্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। প্রতিদিন ২৫ হাজার ই-পাসপোর্ট তৈরির সক্ষমতা আছে কেন্দ্রটির।
এক দশক আগেও সর্বাধিক উন্নত প্রযুক্তির পাসপোর্ট হিসেবে বিবেচিত মেশিন-রিডেবল পাসপোর্ট ই-পাসপোর্টের যুগে অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ এই পাসপোর্ট ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ জানিয়েছেন, ই-পাসপোর্টের মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে এখন থেকে নতুন মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের বা মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ করা হবে না। বিদেশ যেতে প্রত্যেকেরই ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করতে হবে। এটি হয়রানি কমাবে, একইসঙ্গে সময়ও বাঁচাবে।
"ই-পাসপোর্ট থাকলে ইমিগ্রেশন সহজে পেরোনো যায়। কিন্তু মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করতে হয়। কিন্তু ই-পাসপোর্ট থাকলেই এসব কাজের দরকার পড়ে না। প্রবাসী ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্প শিক্ষিত নাগরিকদের ঝক্কি কমাবে এটি," বলেন ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান।
ই-পাসপোর্টে একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপ থাকায়, পাসপোর্টের ২ নাম্বার পৃষ্ঠায় ব্যক্তির নিজস্ব তথ্য থাকায় ও ডিজিটাল নিরাপত্তার ফিচার থাকায় প্রচলিত নন-ইলেকট্রনিক পাসপোর্টের চেয়ে এটি বেশি নিরাপদ।
কীভাবে ই-পাসপোর্ট পাওয়া যাবে?
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী জানান, যে কেউ তিনটি নির্বাচিত অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট বানাতে পারবেন।
"সব প্রক্রিয়াই অনলাইনেই করা যাবে। কোনো সমস্যা ছাড়াই অনলাইনে আবেদন করা যাবে। একজন আবেদনকারীকে ৮৭ ধরনের তথ্য প্রদান করতে হবে, এরমধ্যে ৪৩টি বাধ্যতামূলক," বলেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে দেশজুড়ে ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্ট ইস্যুর কাজ চলছে।
"ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে বাংলাদেশের ৭৫টি অফিসেই ই-পাসপোর্ট পরিষেবা চালু হবে," যোগ করেন তিনি।
ই-পাসপোর্ট প্রকল্প
২০১০ সালের জুনে বাংলাদেশ হস্তলিখিত পাসপোর্ট থেকে শতভাগ মেশিন-রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) যুগে প্রবেশ করে। ২০১৬ সালে ই-পাসপোর্ট প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০২০ সালে 'মুজিববর্ষের' উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ এবং জার্মান প্রতিষ্ঠান ভেরিডোজ জিএমবিএইচ বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে।
প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ এবং জার্মান প্রতিষ্ঠান ভেরিডো ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই চুক্তি স্বাক্ষর করে।
প্রকল্পের আওতায় আগামী ১০ বছরে ৩ কোটি ই-পাসপোর্ট সরবরাহ করা হবে।