চট্টগ্রামে ঈদের কেনাকাটা জমে উঠেছে টেরিবাজারের শপিং মল ঘিরে
চট্টগ্রামে থান কাপড়ের শত বছরের পুরোনো মার্কেট টেরিবাজার। যা কাপড়ের পাইকারি বাজার হিসেবে বিখ্যাত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে থান কাপড়ের সাথে বাজারটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে 'ওয়ান স্টপ শপিং মল'। পাইকারি ব্যবসার পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতাদের কেনাকাটার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এটি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী টেরিবাজারে ওয়ান স্টপ শপিং মলগুলোতে ক্রেতাদের প্রচন্ড ভিড়। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি বাজারটির ওয়ান স্টপ শপিং মলগুলোর কারণে জমজমাট ব্যবসা করছে। আগের ছোট ছোট দোকানগুলোর বেশিরভাগই এখন বড় দোকানে পরিণতে হয়েছে।
টেরিবাজারের 'মেগামার্ট' নামটি এখন চট্টগ্রামের সবার কাছে পরিচিত ব্রান্ড। পুরুষদের যাবতীয় পোষাকের একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান মেগামার্ট। টেরিবাজারের মেগামার্ট শপিং মলে বুধবার রাতে দেখা গেল প্রচন্ড ভিড়। ক্রেতাদের ভিড়ে বিক্রয়কর্মীদের কথা বলার ফুরসত নেই।
গতকাল মেগামার্টে কথা হয় ক্রেতা রাফিজ আহমেদ'র সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ঈদে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেনাকাটা করতে হয়। সারাদিন রোজা পালন করে বিভিন্ন মার্কেটে এই কেনাকাটা করা কষ্টের। তাই এমন দোকান বেছে নিয়েছি, যেখানে এক ছাদের নিচে সব কেনাকাটা শেষ করা যায়'।
মেগামার্ট শপিং মলের বিপণন কর্মী রমিজ উদ্দিন বলেন, 'গত সাত বছর আগে মেগামার্ট শপিং মল গড়ে উঠে। এটি পুরুষদের যাবতীয় পোষাকের একটি বিশাল বাজার। এখানে স্যুট, শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামার কাপড় ও তৈরি পোষাক পাওয়া যায়। এছাড়া টি শার্ট, বেল্ট, জুতা, পারফিউম, লুঙ্গিসহ পুরুষের এমন কোন পরিধেয় পণ্য নেই যা এই শপিং মলে নেই। গত চার-পাঁচ বছরে তাদের শপিং মলটি বেশ জমে উঠেছে'।
বাজারের সানা ফ্যাশন মলে গিয়ে দেখা যায়, সাত তলা বিশিষ্ট বিশাল ভবনটিজুড়ে গড়ে উঠেছে সানা ফ্যাশন। ভবনটির দ্বিতীয় ও সপ্তম তলায় বাচ্চাদের রেডি গার্মেন্টস ও শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামাসহ জেন্টস আইটেম। তৃতীয় তলায় শাড়ি ও চতুর্থ তলায় থ্রিপিস-ফ্রকসহ মেয়েদের পোষাক।
সানা ফ্যাশনের স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ বলেন, 'গত আট-দশ বছর আগে মাসুম ক্লথ স্টোর নাম দিয়ে চট্টগ্রামে আমরা ওয়ান স্টপ শপিং মল দিয়ে ব্যবসায় শুরু করি। গত কয়েক বছরে ওই প্রতিষ্ঠানে ভালো মুনাফা হয়। একটি দোকানে বসে ক্রেতারা সব ধরণের পোষাক কিনতে পারে। এতে শপিং মলগুলোর প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এরপর পরিধি বাড়িয়ে সানা ফ্যাশন মল শুরু করি'।
সানা ফ্যাশন মলে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা হাবিবা বিনতে ইলিয়াছ বলেন, 'ওয়ান স্টপ শপিং মল বা বড় দোকানগুলোতে পণ্য পছন্দ করতে ঝামেলা পোহাতে হয় না। স্বাদ ও সাধ্যের মধ্যে প্রচুর পণ্য থাকে এসব শপিং মলে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে পছন্দের কেনাকাটা শেষ করা যায়'।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, 'ঈদের কেনাকাটায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একসময় ক্রেতারা মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে কেনাকাটা করতো। এখন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ক্রেতারা একটু আরামদায়ক বা স্বস্তিতে কেনাকাটা করতে পছন্দ করছে। ফলে ক্রেতাদের আগ্রহের বিষয়টি মাথায় রেখে এসব ওয়ান স্টপ শপিং মল গড়ে উঠেছে। নতুন এই ধারার শপিং মল চট্টগ্রামে ভালো ব্যবসা করছে'।
টেরিবাজারে গত কয়েক বছরে প্রায় অর্ধ শতাধিক ওয়ান স্টপ শপিং মল গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে মাসুম ক্লথ স্টোর, বধুয়া শপিং, সানা ফ্যাশন, রাজপরী, জারা শপ, জাবেদ ক্লথ স্টোর, বৈঠক বাজার, ভাসাবি, মনে রেখ, শাহ আমানত, পরশমনি, শিরমনি, রাঙ্গুলি, ফেমাস, আলিশা, হারুন এন্ড ব্রাদার্স, রাজস্থান, মল টুয়েন্টি ফোর, মহম্মদীয়া, হ্যালো ফ্যাশন, গোল আহমদ, নিউ রাজস্থান, মৌচাক, মেগামার্ট, আলমগীর, বাগদাদ এ্যাম্পোরিয়াম, নিউ আজমির ইত্যাদি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে।
পরশমণি দোকানের মালিক মো. ইসমাইল বলেন, 'সারা বছরের বিক্রির ৪০ শতাংশই হয় রমজানকে ঘিরে। তবে করোনার কারণে গত বছর ও এবারের লকডাউনের প্রথম এক সপ্তাহ পর্যন্ত দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। যা সব ব্যবসায়ীদের উপর একটি বড় ধাক্কা গেছে'।
ব্যবসায়ীরা বলেন, কয়েক বছর ধরে ওয়ান স্টপ শপিং মলে পোশাকের বেচাকেনা বেড়েছে। ঈদবাজারে পাইকারি পোশাকের বড় বেচাকেনা এখনো টেরিবাজার ঘিরে। রোজার শুরুর আগেই ফেনী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত খুচরা ব্যবসায়ীরা এই বাজার থেকে পোশাক ও প্রসাধনী কিনে নিয়েছেন। এখন চলছে খুচরা বেচাকেনা।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এই বাজারে গড়ে প্রতিটি দোকানে দিনে কমপক্ষে দশ লাখ থেকে কোটি টাকার বিক্রি হচ্ছে।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, 'এবার ঈদকে ঘিরে কমপক্ষে দেড়-দুই হাজার কোটি টাকা বিক্রির লক্ষ্য ছিল। তবে করোনার কারণে লকডাউন থাকায় ব্যবসায়ীদের সেই লক্ষ্য পূরণ হবে না। এমনকি গত বছর পুরো রমজান বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে'।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ১৫টি অভিজাত ও ৫৮টি সাধারণ বিপণিকেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া টেরিবাজার, তামাককুন্ডি ও রিয়াজউদ্দিন বাজারে ২৬০টি ছোট আকারের মার্কেট রয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে এসব বিপণিকেন্দ্রের ৪৬ হাজার দোকানে পোশাক, জুতা, প্রসাধনী, গয়না ও তৈজসপত্রের বেচাকেনাও জমে উঠেছে।
এক সময়ের চট্টগ্রামে শাড়ীর জন্য বিখ্যাত বিপনি বিতান 'নিউ মার্কেট'। ঐতিহ্যবাহী বিপনী বিতানটিতে আগের সেই জৌলুস নেই। মার্কেটের হাজারো দোকান আগের ট্রেন্ড পরিবর্তন করে এখন বিভিন্ন ব্রান্ডের রেডি গার্মেন্টস বা তৈরি পোষাক বিক্রি করছে।
আগের চেয়ে বিকিকিনি কমেছে চট্টগ্রামের এক সময়ের নামকরা বিপনি বিতান চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, আমিন সেন্টার, ভিআইপি টাওয়ার, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর মার্কেট, বহদ্দারহাট হক মার্কেট, সজল সুপার মার্কেটসহ চট্টগ্রামের পুরানো মার্কেটগুলোতে। এসব মার্কেটের জায়গায় গত কয়েক বছর ধরে নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে টেরিবাজার কেন্দ্রিক ওয়ান স্টপ শপিং মল।
চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স নোমা ফ্যাশন ও জেবা এন্ড সন্স'র স্বত্বাধিকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, 'দীর্ঘ পনের বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করছি এই শপিং কমপ্লেক্সে। এই সময়ের মধ্যে ব্যবসার পরিধিও বাড়িয়েছি। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছর থেকে ক্রমান্বয়ে বিকিকিনি কমে আসছে। শুধু শপিং কমপ্লেক্সেই নয়, এক সময়ের পুরানো শপিং সেন্টারগুলোর প্রায় একই অবস্থা'।
এ্যাপোলো শপিং সেন্টারের রাইসা ক্লথ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আকবর বলেন, 'পুরানো বিপনিবিতানগুলোতে বিকিকিনি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো টেরিবাজার কেন্দ্রিক ওয়ান স্টপ শপিং মল। ওয়ান স্টপ শপিং মলের প্রতিটিতে কোন মার্কেটের প্রায় ৫০-১০০ দোকানের সমান পণ্য রয়েছে। ক্রেতারা একটি শপিং মলে বসেই প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটা সারতে পারে'।