চট্টগ্রামে এক দশকে আবাদি জমি কমেছে ৩২ হাজার একর
হাটহাজারীর এক হাজার একরের লালাচন্দ্র বিল। ইতোমধ্যে বিলটির প্রায় ৩০০ একর জমি কিনেছে একাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়রা বলছেন, গত এক দশক ধরে এই বিলে আবাসন প্রকল্প তৈরির তোড়জোড় শুরু করে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো। কৃষি বা আবাদি জমি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প করার নিয়ম না থাকলেও কোম্পানিগুলো সেই নিয়ম মানছে না। এসব কৃষিজমি পর্যায়ক্রমে আবাসন ভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
লালা চন্দ্র রায় নামে মোগল আমলে একজন বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। তিনি জাতিতে রাজপূত্র বংশীয়। কলকাতার দূর্গাপূর ছিল তার আদিনিবাস। তিনি কলকাতা থেকে হাটহাজারীর শিকারপূর এসে বসতি স্থাপন করেন। লালা চন্দ্র বিল তারই স্মৃতি বহন করে।
শুধু এই বিল নয়, আবাসনের ইটপাথর গিলে খাচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষিজমি। একসময় চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও, বায়েজিদ, পাহাড়তলি, হালিশহর, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক কৃষি জমি দেখা যেতো। বর্তমানে সেখানে শুধু ভবন আর ভবন।
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত ১০ বছরে কৃষি জমি কমেছে ৩২ হাজার একরেরও বেশি। এসব জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে বসতঘর, ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে খাদ্য উৎপাদনও কমেছে।
লালাচন্দ্র বিলের বাথুয়া অংশে সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে একাধিক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। ফসলি জমিতে খামারবাড়িও গড়া হয়েছে। রাস্তার পাশে অনেক জমিতে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে গেড়ে দেয়া হয়েছে পরিচিতি ফলক। কিছু জমিতে মাটি ভরাট করার প্রক্রিয়া চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সমির দত্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘লালাচন্দ্র বিলের সঙ্গে অনেক কৃষকের ভাগ্য জড়িত। এই বিলে চাষ করে অনেক কৃষক জীবন-যাপন করেন। তবে যে হারে এখানে ঘরবাড়ি হচ্ছে, একদিন ঐতিহ্যবাহী বিলটি হারিয়ে যাবে।’’
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাছির উদ্দিন বলেন, ‘‘মূলত ঘরবাড়ি নির্মাণের কারণে আবাদি জমির সংখ্যা কমছে। প্রতিবছর এই হার বাড়ছে। গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৩২ হাজারের বেশি একর জমি কমেছে।’’
তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত শিল্প কারখানা গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি। একেকটা ইটভাটা গড়ে উঠছে কয়েক একর জমির ওপর। বাঁধ না থাকায় ভাঙনে নদীতে বিলিন হচ্ছে ফসলি জমি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে অনেক জমিতে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলা তথা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিলো ৭ লাখ ১৮ হাজার ৪৩৭ হেক্টর। ২০১৭-১৮ সালে সেটি হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার ৬৮১ হেক্টর।
একই সময়ে এক ফসলি জমির সংখ্যাও কমেছে। ২০০৮-০৯ সালে এক ফসলি জমি ছিলো এক লাখ ৯০ হাজার ৬৬৩ হেক্টর। ২০১৭-১৮ সালে সেটি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৪২ শতাংশ জমি এখনো সেচের বাইরে। ২০০৮-০৯ সালে মোট জমির ৩৬ শতাংশ সেচের বাইরে ছিলো। এক দশকে সেচের আওতায় এসেছে মাত্র ৬ শতাংশ জমি।
তবে চট্টগ্রামে এক দশকে কৃষি পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দুই লাখ। ২০০৮-০৯ সালে কৃষি পরিবার ছিলো ১৫ লাখ ৮ হাজার ২৩০টি। ২০১৭-১৮ সালে সেটি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ১৮৮টি।
কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক ম. আবদুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের ছয়টি উপজেলায় আমরা গবেষণা কাজ চালিয়েছে। কৃষি জমি কমার প্রধান কারণ আবাসন নির্মাণ। এজন্য খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।
ফসলি জমিতে গড়ে উঠা স্থাপনা অবৈধ বলছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘‘সিডিএ কোনো আবাদি জমিতে স্থাপনা নির্মাণে নকশা অনুমোদন দেয় না। কৃষি জমিতে সেসব স্থাপনা গড়ে উঠছে সেগুলো অনুমোদনীন। অবৈধ এসব স্থাপনা যেকোনো সময় ভেঙে ফেলা হবে।’’
(https://tbsnews.net/environment/13000-hectare-arable-lands-lost-housing-industrialisation-36813)