চায়ের বাজার সম্প্রসারণে শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর প্রস্তাব
চা শিল্পকে রপ্তানিমুখী পণ্যের তালিকায় শক্তিশালী অবস্থানে ফেরাতে চা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (২১ মে) অন্তর্জাতিক চা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত "Tea workers of Bangladesh: challenges and accountability of actors" শীর্ষক ওয়েবিনারে এমন প্রস্তাব করেছেন অর্থনীতিবিদরা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্যও সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, চা বাগানের শ্রমিকদের একসময় ক্রীতদাস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও শ্রমিকরা এখনো সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন।
তাদের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে। আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে হবে। যেন তারা বড় হতে চায়। এজন্য তাদের শিক্ষার পরিবেশ দিতে হবে। সামাজির সুরক্ষার পরিসর বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, মালিকপক্ষ এবং এনজিওগুলো একসাথে কাজ করলে ভালো ফল আসবে।
তবে এখন আসলে পুরো শিল্প নিয়েই ভাবতে হবে। এই শিল্পের উৎপাদনশীলতা কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা দেখতে হবে। যাতে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে চায়ের বাজার বাড়ানো যায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চা একসময় আমাদের রপ্তানি পণ্যের সারিতে প্রথম দিকে ছিল। এখন সেই অবস্থানে নেই। তবে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী হয়েছে। এটা খুবই ভালো বিষয়।
কিন্তু যেহেতু দেশের বাইরেও এই পণ্যের ভালো বাজার আছে। সুতরাং কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে শ্রমিকদের সুরক্ষা দেয়া গেলে আবারো রপ্তানি বাজার বড় হবে। সেটা সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক গতি ত্বরান্বিত করবে।
চা শ্রমিকরা এখন নাগরিক সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। তবে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। এজন্য সঠিক পরিসংখ্যানে গুরুত্ব দিতে হবে। অংশীজনরা সবাই মিলে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা গেলে সামাধান আসবে।
মূল প্রবন্ধে পরিবেশ ও মানব উন্নয়ন সমিতির পরিচালক (এসইএইচডি) ফিলিপ গায়েন বলেন, নৈমিত্তিক ছুটি অন্যশিল্পে যেখানে ১০ দিন; চা শিল্পে সেটা নেই। অর্জিত ছুটিতেও আছে বৈষম্য। অন্য শিল্পে ১৮ দিন কিন্তু চা-শ্রমিকদের ২২ দিন। শ্রম আইন অনুসারে নিয়োগপত্রের মাধ্যমে নিয়োগও হয় না এখানে। অস্থায়ী শ্রমিকরা সাধারণত পুরো রেশন, চিকিৎসাসেবা ও বেতনসহ ছুটি পান না। কোম্পানি মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের পাওয়ার কথা থাকলেও তা পায় না। শ্রমিকরা চাকুরি শেষে সামান্য পেনশন পেলেও পারিতোষিক পান না।
বিবিএস ও ইউনিসেফের ২০১৮ সালের এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, চা-বাগানের ৭৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। অথচ ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে এই হার ছিল ২৪ শতাংশ।
এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে তারা বঞ্চনার শিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে চা বাগানে প্রাথমিক ২৭৩টি।
মাঝে ২০১৪ সালে যেটা অবশ্য ছিল ১,০৫৪টি। তখন ব্র্যাক একাই চা বাগানগুলোতে ৭৮৯টি প্রাথমিক স্কুল পরিচালনা করত। যা এখন বন্ধ। পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্পন্ন সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন ও কোটার মধ্যে সেখানে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, চা শ্রমিকের সন্তানদের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমরা কোটা চালু করেছি। বর্তমানে ১২ জন এখানে পড়ছে।
সিলেটের স্থানীয় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এটাকে অনুসরণ করতে পারে। তবে বহিঃবিশ্বে চায়ের বাজার বাড়াতে 'ভ্যালু এডিশন' করার প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে.এম. আবদুস সালাম বলেন, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়ন প্রাধান্য পাচ্ছে। আমরা ৫ বছরের জন্য পরিকল্পনা হাতে নিতে চাই। এজন্য আপনাদের অংশগ্রহন প্রয়োজন।
বেসরকারি সংস্থা 'নিজেরা করি'র সমন্বয়ক খুশি কবির বলেন, নারী চা শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৬ সপ্তাহের। কিন্তু অন্যদের জন্য ২৪ সপ্তাহের। এই বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, ৫ শতাংশ মুনাফা শেয়ারিংয়ের বিষয়ে সমন্বিত একটা ফান্ড করার উদ্যোগ চলমান। শ্রমিক সামজে বৈষম্য যেন না হয়, সেজন্য এটা করা হচ্ছে। কারণ সব প্রতিষ্ঠানে লাভ সমান হয় না।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি (চট্টগ্রাম) তপন দত্ত বলেন, ১৯২১ সালে মালিকরা শ্রমিকদের বেঁধে পিটাতো। এখন সেই অবস্থা না থাকলেও এখনো শ্রমিকরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। করোনাকালে বাগান খোলা থাকা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীনতার প্রশ্নও তোলেন তিনি।